Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Manna Dey

মানা নামটা ক্রমশ অবাঙালি উচ্চারণে হয়ে উঠল মান্না

বন্ধুদের থেকে প্রায় পালিয়ে বাঁচতে বাহানা দেন প্রবোধ, প্রতিযোগিতায় গাইলে কাকা রাগ করবেন। ১ মে ছিল সঙ্গীতশিল্পী মান্না দে-র জন্মদিন। তাঁকে স্মরণ করালেন অনির্বাণ জানা সুর দিয়ে মানুষের এত গভীর পর্যন্ত নাড়া দেওয়া যায়? মনে মনে ঠিক করে নেন প্রবোধ তাঁর জীবনের লক্ষ্য।

মান্না দে

মান্না দে

শেষ আপডেট: ০৩ মে ২০২০ ০৩:৩২
Share: Save:

কৃষ্ণনগর রাজবাড়ি। গত শতাব্দীর প্রথমার্ধের ঘটনা। তখন রাজবাড়িতে রাত্রিব্যাপী গানের অনুষ্ঠান হত। একটা অল্পবয়সী ছেলে তার বাবুকাকার সঙ্গে অনুষ্ঠানে এসেছে। প্রবোধ তানপুরা বাজাবে কাকার গানের সঙ্গে। চার দিকে ঝাড়বাতি জ্বালানো। বিশাল ফরাসে বসা অসংখ্য মানুষ। গানের সমঝদার রাজামশাইও রয়েছেন। আর সেই সময়ের গানের জগতের নাম করা সব ব্যক্তিত্ব সেই অনুষ্ঠানে হাজির।। কে না নেই— শচীন কর্তা, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামী, রাইচাঁদ বড়াল। শুরু করলেন শচীন দেববর্মন। শেষ শিল্পী ছিলেন কানাকেষ্ট, কৃষ্ণচন্দ্র দে। ভাইপোকে তানপুরা ছাড়তে বলে শুরু করলেন রাগ কাফি। মাদকতা ছড়িয়ে গেল শ্রোতাদের হৃদয়ে। একটা গান থেকে আরেকটা গানে, একটা রাগ থেকে অন্য রাগে। আস্তে আস্তে ভোর হয়ে আসে। কাকা ধরেন অসামান্য এক কীর্তন। মুগ্ধ হয়ে ছড় টানতে ভুলে যায় প্রবোধ। একজন ঠেলা দিয়ে বলেন ‘‘কী হল মানা, থেমে গেলে কেন?’’ মানা বা প্রবোধ সম্বিৎ ফিরে আবার তানপুরার তারে হাত দেন।

সুর দিয়ে মানুষের এত গভীর পর্যন্ত নাড়া দেওয়া যায়? মনে মনে ঠিক করে নেন প্রবোধ তাঁর জীবনের লক্ষ্য।

মনের ভিতর ইচ্ছেটা রয়ে গেল। ছাত্র হিসেবে খারাপ ছিলেন না প্রবোধ। স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হলেন। কলেজ জীবনে টেবিল বাজিয়ে গান তো প্রায় প্রত্যেকেই গায়। বিশেষ করে, কৃষ্ণচন্দ্র দে-র ভাইপো যখন ক্লাসে রয়েছেন, তখন অফ পিরিয়ডে শেষের দিকের বেঞ্চে কাকার গাওয়া বা শচীনকত্তার গান গাওয়া হবে না তাই কী হয়? কখনও ‘নিশীথে যাইও ফুলবনে রে ভ্রমরা’, কখনও ‘টাগডুম টাগডুম বাজাই বাংলাদেশের খোল’ গাইতে হত প্রবোধকে। এ দিকে ইন্টারকলেজ গানের কম্পিটিশন হচ্ছিল সে বছর। বন্ধুবান্ধবেরা প্রায় জোর করে ওঁর নাম দিয়ে দেয় সেই প্রতিযোগিতায়। সে রকম ভাবে গানের তালিম নেওয়া ছিল না। তানপুরার তার টানা এক জিনিস আর সবার সামনে বসে গান গাওয়া এক জিনিস। প্রায় পালিয়ে বাঁচতে বাহানা দেন প্রবোধ— প্রতিযোগিতায় গাইলে কাকা রাগ করবেন। তো বন্ধুবান্ধবরা ছাড়ার পাত্র নয়। তারা কৃষ্ণচন্দ্রকে গিয়ে ধরল। কাকা বুঝে ফেললেন ভাইপোর অভিপ্রায়। প্রবোধের পক্ষ নিয়ে বললেন যে ওর তো প্রতিযোগিতায় নামার মতো প্রথাগত সঙ্গীতশিক্ষা নেই। ওর গান না গাওয়াই ভাল। কিন্তু বন্ধুরা খোদ প্রিন্সিপাল আরকুহার্ট সাহেবকে দিয়ে চিঠি লিখিয়ে আবার হাজির কাকার কাছে। এ বার আর কিছু করার ছিল না।

প্রতিযোগিতার আগের দু’মাস চললো দুই বেলা করে তালিম। ঠুংরি আর আধুনিক গান ছাড়া সব বিভাগে প্রথম হলেন প্রবোধ। ওই দুটো বিভাগে শুধু দ্বিতীয়। পর পর তিন বছর ইন্টারকলেজ মিউজিক কম্পিটিশনে চ্যাম্পিয়ন হয়ে রূপোর তানপুরা পুরস্কার পেয়েছিলেন প্রবোধ। কিন্তু প্রবোধ থেকে মান্না দে হয়ে ওঠার পথটায় অনেকই লড়াই ছিল।

ছোটকাকার প্রশ্রয়ে, কিছুটা বাড়ির অমতে গানের জগতে আসা মান্না দে-র। কাকা কৃষ্ণচন্দ্র তখন স্টুডিয়ো পাড়ার গানের জগতে বেতাজ বাদশা। ‘কচ ও দেবযানী’ সিনেমার সঙ্গীত পরিচালনায় ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র। প্রবোধকে করে নিলেন নিজের সেকেন্ড অ্যাসিস্ট্যান্ট। এর মধ্যে অডিশন দিয়ে রেডিয়োয় শাস্ত্রীয়সঙ্গীত গাওয়ার সুযোগ পাওয়া গিয়েছে। সেখানে খেয়াল, ঠুংরি আর লঘু সঙ্গীত গাওয়া চলছে নিয়মিত। তবে সত্যিকারের মোড় ঘুরল ১৯৪২ সালে, কাকার সঙ্গে মান্না পাড়ি দিলেন মুম্বই। লক্ষ্মী প্রোডাকশনের ছবি ‘তমান্না’র সঙ্গীত পরিচালক কৃষ্ণচন্দ্র দে আর তাঁর সেকেন্ড অ্যাসিস্ট্যান্ট হলেন প্রবোধ। ওই ছবিতেই একটা ডুয়েট ছিল— ‘জাগো আই উষা’। কৃষ্ণচন্দ্র গানটা গাওয়ালেন ভাইপোকে দিয়ে আর তাঁর সঙ্গে কণ্ঠ মেলালেন মিষ্টি দেখতে একটি বাচ্চা মেয়ে। পরবর্তী কালে হিন্দি সিনেমার ইতিহাসে মেয়েটি চিরকালের জন্য স্থান করে নেবেন সুরাইয়া নামে।

প্রথম প্লেব্যাক সিঙ্গার হিসাবে পাকাপাকি ভাবে গাওয়া ‘রামরাজ্য’ সিনেমায়। পরিচালকেরা এসেছিলেন কৃষ্ণচন্দ্রকে দিয়ে গান গাওয়াতে। কাকা রেকমেন্ড করলেন প্রবোধের নাম। সঙ্গীত পরিচালক শঙ্কর রাও ব্যাসজি প্রবোধের গান শুনে মুগ্ধ, হিন্দি এবং মরাঠি দুই ভার্সনেই গান গাইলেন প্রবোধ। ধীরে ধীরে উত্থান হতে লাগল এক নক্ষত্রের। বড় সুযোগ এসে গেল ‘অমর ভূপালী’ নামের একটি গান-নির্ভর ছবিতে। এটাও ডুয়াল ভার্সন, বাংলা ভাষার গানগুলোর গীতিকার ছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। প্রবোধের কণ্ঠে বাঙালি শুনল— ‘ওঠো ওঠো পোহাইল রাতি’, ‘ঘনশ্যাম সুন্দর শ্রীধর’। গানগুলো বেশ হিট হল।

তখনও কিন্তু প্রবোধ নামেই গাইছেন মানা। মানাটা অবাঙালি উচ্চারণে ক্রমশ মান্না হয়ে যাচ্ছিল। খারাপ লাগত না প্রবোধের। বরং প্রথম নামটাই ছিল তাঁর কাছে বেশ অপছন্দের। ‘মান্না দে’ মন্দ কী!

সেই সময়টা ছিল মান্না দে-র কাছে বিশাল এক লড়াইয়ের সময়। অধিকাংশ সিনেমাতে তিনি সহকারী সঙ্গীত পরিচালক। যে দু’-চারটে সিনেমায় স্বাধীন ভাবে পরিচালনার কাজ পাচ্ছিলেন সেগুলো মোটেই পাতে দেওয়ার মতো নয়। আর গানের জগতে মুম্বইয়ে তখন রাজত্ব করছেন মহম্মদ রফি, তালাত মামুদ, মুকেশ, কিশোরের মতো শিল্পীরা। তাঁদের চেয়ে অন্য রকম কিছু করতে না পারলে গানের জগৎ তাঁকে পাত্তা দেবে কেন?

ক্লাসিক্যালের জন্য ঈশ্বরপ্রদত্ত গলাটা ঝালিয়ে নিতে লাগলেন পাশাপাশি। গান শিখতে লাগলেন উস্তাদ আমন আলি খাঁ, উস্তাদ আব্দুল রহমান খাঁ, উস্তাদ গোলাম মুস্তফা খাঁসাহেবের কাছে। কিন্তু ভাল ব্রেক আর পাচ্ছেন কোথায়? অভিমান জমছিল ভিতর ভিতর। কত গুণী বাঙালি রয়েছেন মুম্বইয়ে, কই কেউ তো তাঁকে সেই ভাবে কাজের জন্য ডাকছেন না! এই অভিমানের মাঝখানে এক দিন তাঁকে ডেকে পাঠালেন শচীন দেববর্মন। গাইতে দিলেন 'মশাল' ছবির বিখ্যাত গান ‘উপর গগন বিশাল’। গগনে নতুন তারকার জন্ম হল, মান্না দে-র গান শুনতে শুরু করল আসমুদ্রহিমাচল।

যত দিন গান থাকবে বাঙালির হৃদয়ে তিনি রয়ে যাবেন। তিনিই তো গেয়ে গিয়েছেন— ‘‘হৃদয়ে লেখো নাম, সে নাম রয়ে যাবে।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Manna Dey Music
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy