Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
girl child

রক্ষণে অধিকার, ভক্ষণেও

অর্ধেক আকাশ যে মূলত ভোগ্যপণ্য, নিজেকে বাদ দিয়ে আর সকলকে সন্তুষ্ট করাই যে তার আসল কাজ, এই শিক্ষা প্রথম থেকেই সমাজ পুরুষকে দিয়ে থাকে।

সোনালী দত্ত
শেষ আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০১৯ ০০:৪১
Share: Save:

তিয়াত্তর বছরের গণতান্ত্রিক দেশের গলায় মা-ভারতের ঝলসানো কাবাবের মালা দুলছে। এর পরও আমরা সকালে উঠে চায়ের কাপে সুখচুমুক দিয়ে দেশের ভালমন্দ নিয়ে আলোচনা করব। বেটিকে বাঁচানো, পড়ানোর অঙ্গীকার করব, কন্যাশ্রীর মেডেল পরাব। আর সেই বেটি বা সেই কন্যা কোথাও ধর্ষিত লাশ হয়ে পড়ে থাকবে, কোথাও তন্দুর হয়ে যাবে, কোথাও তার যৌনাঙ্গ খুঁড়ে ফেলবে লোহার রড। এই যে আমরা চন্দ্রযান নিয়ে বড়াই করি, সার্জিকাল স্ট্রাইক করে বুক ঠুকি— আমাদের লজ্জা করে না?
কাদের দোষ দেব? সেই চার ট্রাকচালককে? আর যারা এলাকার নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল, তারা? যে পুলিশ অসহায় বাবার আর্তি দেখেও এফআইআর নিতে পাঁচ ঘণ্টা লাগায়, তারা? যে নির্মম মৌলবাদীরা ধর্ষণের পিছনে মেয়েদের পোশাক, চালচলনের অজুহাত খুঁজে বেড়ায়, তারা? তাদের হিংস্রতার ছাপ নেই ওই তরুণী চিকিৎসকের পোড়া শরীরে?

ভারতে প্রতি পনেরো মিনিটে এক জন নারী ধর্ষিত হন। খাস রাজধানী দিল্লিতেই প্রত্যেক দিন পাঁচ জন নারী ধর্ষিত হন। ক’জন অপরাধীর শাস্তি হয়? বেশির ভাগ অপরাধের রিপোর্ট তো থানায় করাই হয় না? করতে গেলে পুলিশ নেয় না। নিলেও উপরমহল থেকে চাপ আসে তদন্ত বন্ধ করে দেওয়ার। অনেকেই বলেন, পুলিশ কী করবে? সরকার কী করবে? কোন মেয়ে কোন সময় কোথায় যাচ্ছেন, তা কি জানা সম্ভব? এই প্রশ্ন তোলার ঔদ্ধত্য তখন আর তাঁর থাকে না, যখন নিজের মেয়ে, বোন বা স্ত্রী বাড়ি ফিরতে সামান্য দেরি করেন।

সন্তান যখন জন্মায়, তখন আসলে তো মেয়েও হয় না, ছেলেও হয় না— ‘ছেলে’ বা ‘মেয়ে’ আমরা তৈরি করি। খুব গরম পড়লেও মেয়ে সন্তানকে (শিশু হলেও) খালি গায়ে রাখা চলে না। হাতে হাতে মায়ের সঙ্গে তাকে কাজ শিখতেই হয়— শ্বশুরবাড়ি গিয়ে করবে কী? টিউশনে গেলে বাবা সঙ্গে যান— রাত করে বাড়ি ফেরা চলে কী করে। বদলির চাকরি নেওয়া চলে না। লেখাপড়া করলেও ‘মেয়েদের বিষয়’-এ করাই জরুরি।

আরও পড়ুন: জেএনইউ আর পার্শ্ব শিক্ষকদের আন্দোলন একই সুতোয় বাঁধা​

কিন্তু কেন এত সব? মেয়েটির ভালর জন্য? তার নিরাপত্তার জন্য? আর তার ভাই? সে ছোটবেলা থেকেই কাঁদে না, তার মা খুব গর্বভরে এ কথা সকলকে বলে বেড়ান। ছেলেদের যে কাঁদতে নেই। স্পোর্টসের মাঠে মেয়েদের কাছে হারতে নেই। নাচ শিখলে, রান্না করলে, কাপড় কাচতে নেই। এ সব করলে তার যৌনতা নিয়েই সন্দেহ জাগবে। আর টিভি সিরিয়াল? সেখানে তো একটা ছেলে যখন-তখন বিয়ে করে আগের বৌকে তাড়িয়ে দিতে পারে।

ধর্ষণের সঙ্গে এই সবের কী সম্পর্ক? সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ। এক সদ্যোজাত শিশুকে তার পরিবার, তার সমাজ একটু একটু করে প্রতি পদক্ষেপে বোঝায়— তুমি ছেলে। তুমি উন্নততর। তুমি দায়িত্ববান। আর তোমার দিদি, বোন বা বান্ধবী হল এলেবেলে। সে লেখাপড়া শিখবে, চাকরিও করবে হয়তো। কিন্তু সে তোমার উচ্চতায় পৌঁছতে পারবে না। আসলে মানুষের যত গুণই থাকুক, লিঙ্গভিত্তিক পরিচয়ই তার আসল পরিচয়। এক শিক্ষিকাকে বলতে শুনেছিলাম, ইঞ্জিনিয়ার ছেলের বৌ আনবেন ছেলের চাইতে একটু হলেও কমা। নইলে ‘মাথায় চড়ে বসবে।’ বিজ্ঞানের মেধাবী ছাত্রী স্ত্রীকে দেখেছি টাকা জমানোর ব্যাপারে বি কম ফেল স্বামীর উপদেশ নিতে। কারণ মেয়েদের শেখানো হয়, তারা কাজ সবই করে কিন্তু ‘কাজের কথা’ তাদের এক্তিয়ারে নেই। তাদের চার পাশের পুরুষ মনে করে, মেয়েদের রক্ষণের ভার তাদের। অতএব ভক্ষণেও তাদেরই অধিকার। মেয়েরা পড়বে, অফিস যাবে— কিন্তু ওইটুকুই। অফিসে টুর আছে? তোমায় যেতে হবে না। ছাত্রীদের নিয়ে এক্সকার্শন আছে? তোমার ঘরসংসার নেই? তুমি যেয়ো না। তোমার টাকা সংসারে সুবাতাস আনুক। তোমার টিকি থাকবে পুরুষের হাতে বাঁধা। তা হলে আসলে মেয়েরা কী? যে ভূমিকাতেই অভিনয় করুক, আসলে মেয়ে হল ভোগ্যপণ্য। যতই শিক্ষিত হোক, অর্থোপার্জন করুক— তার নিজের বাড়ি নেই, ঘর নেই, বারান্দা নেই, অবকাশ নেই। তার মূল পরীক্ষা, সে সংসারকে, তার পুরুষকে কতটা আনন্দ দিতে পারল।

অর্ধেক আকাশ যে মূলত ভোগ্যপণ্য, নিজেকে বাদ দিয়ে আর সকলকে সন্তুষ্ট করাই যে তার আসল কাজ, এই শিক্ষা প্রথম থেকেই সমাজ পুরুষকে দিয়ে থাকে। ফলে রাতের বিছানায় ধর্মসিদ্ধ স্ত্রীকে বা প্রেমসিদ্ধ ‘মেয়ে’কে আইনসিদ্ধ ধর্ষণ করে অভ্যস্ত পুরুষ ভাবতেই পারে দিল্লির বাসে, বাংলার গ্রামের পথে বা তেলঙ্গানার টোল প্লাজ়ায় দাঁড়িয়ে, বসে থাকা মেয়েরাও তাদের অধিকারের বস্তু। পরিবার থেকেই তো মানুষের মধ্যে সমাজভাবনা আসে।

খারাপ লাগছে সেই পুরুষের জন্য যে নিজের কন্যার নিরাপত্তা নিজেরই কোনও ভাইবেরাদরের হাতে তছনছ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় রাত ন’টা না বাজতেই বার বার মোবাইল টেপে, বাড়ির সামনে উত্তেজনায় পায়চারি করে। সব পুরুষ দোষী নয়, এ আমরা সকলেই জানি। তবু কিছুর লোভ, নৃশংসতা সকলকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেয়। ওই তরুণী শুধু নন, ঝলসে যাচ্ছি আমরা সবাই। কেউ আগামী অপরাধের শিকার হওয়ার ভয়ে। কেউ আগামী অপরাধের জন্য দায়ী হওয়ার গ্লানিতে।

অন্য বিষয়গুলি:

Girl Child India Girl Child Girl Security
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy