নুসরত জাহান, বাংলা থেকে যে ক’জন সাংসদ হয়েছেন, তার মধ্যে অন্যতম। বিতর্ক তাঁর পিছু ছাড়ছে না। কিছু দিন আগে তিনি শাঁখা-সিঁদুর পড়ে সংসদে শপথ নিয়েছেন। তার পর শোনা গিয়েছে দারুল উল দেওবন্দ থেকে তাঁকে নাকি ফতোয়া দেওয়া হয়েছে।
পরে অবশ্য জানা গিয়েছে যে না সে রকম কোনও ফতোয়াই দেওয়া হয়নি। এর পিছনেও এক শ্রেণির পেটোয়া সংবাদমাধ্যমের ভুমিকা ছিল অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। সে বিতর্কে না ঢোকাই ভাল, তা হলে বিতর্কটা ফেক নিউজের দিকে চলে যাবে। তার পর আরও একটা ঘটনা ঘটেছে। নুসরত রথযাত্রার উদ্বোধনে সামিল হয়েছেন। সেই দেখে অনেকেই বলা শুরু করেছেন এই তো আসল ধর্মনিরপেক্ষতা। তার মানে কি দাঁড়াল এক জন সংখ্যালঘু মানুষ যদি সংখ্যাগুরুর উৎসবে সামিল হয়ে পড়েন তা হলে সেটা হল ধর্মনিরপেক্ষতা আর সংখ্যাগুরু যদি সংখ্যালঘুর উৎসবে যোগ দেন তা হলে কি সেটা ধর্মীয় তোষণ?
কিংবা যদি কোনও সংখ্যালঘু মানুষ সংখ্যাগুরুর উৎসবে সামিল না হতে চান বা শুধুমাত্র দর্শনীয় স্থান হিসেবে কোনও জায়গায় যান, তা হলে কি তিনি ভারতের এই যে সবাইকে নিয়ে চলার দর্শন, সেই দর্শন থেকে দূরে থাকবেন?
এই প্রশ্নের উত্তর এই মুহূর্তে ভারতের প্রায় সমস্ত নাগরিককে খুঁজতে হবে। তা হলে কি নুসরত জাহান যেটা বলেছেন সেই মতটাকেই মেনে নিতে হবে? না কি যে কোনও মানুষ তাঁর নিজের ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে থাকতে পারবেন অন্যকে আঘাত না দিয়েও। এমনকি, কোনও ধর্মে বিশ্বাস নেই— এমন বিশ্বাস নিয়েও থাকতে পারবেন এক জন মানুষ? আজকের ভারতে এক দিকে যখন রোজ খবর আসছে একটি স্লোগান ক্রমশ রাজনৈতিক উৎপীড়নের হাতিয়ার হয়ে উঠছে, রোজ কোথাও না কোথাও কোনও না কোনও সংখ্যালঘু মানুষ আক্রমণের শিকার হচ্ছেন, তখন কি এই প্রশ্নগুলো নিরসন হওয়া জরুরি নয়?
সংবিধান কী বলে? ভারতের সংবিধান যা বিশ্বের বৃহত্তম লিখিত সংবিধান, সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটির বিশেষ গুরুত্ব আছে। কিন্তু এই শব্দের মানে জানাটা খুব জরুরি। ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ এই নয় যে, রাষ্ট্র ধর্মবিরোধী হবে অথবা রাষ্ট্রে ধর্মের কোনও স্থান থাকবে না। বরং ভারতীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী সব ধর্মের অবাধ বিচরণভুমি এই ভারত। আভিধানিক অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে এ কথা বোঝায় না যে রাষ্ট্র ধর্মবিরোধী হবে। বরং এটা বোঝায় যে রাষ্ট্র ধর্মীয় বিষয়ে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা বজায় রেখে চলবে। যেহেতু, ধর্ম প্রতিটি মানুষের বিবেকের বিষয় সেহেতু রাষ্ট্র ধর্মীয় বিষয়ে কোনও হস্তক্ষেপ করবে না সেটাই বাঞ্ছনীয়। এটার মানে দাঁড়ায় যে যদি কোনও মানুষ নিজের ধর্ম পালন করেন, তাঁর এ-ও দায়িত্ব বর্তায় তাঁর পাশের মানুষটি যদি অন্য ধর্মের হন তা হলে তিনিও যেন নিজ ধর্ম পালন করতে পারেন।
ধর্মনিরপেক্ষতা কি খুব কিছু কঠিন বিষয়? ভারতের মতো দেশে যেখানে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ আছেন, সেখানে শুধু মাত্র নিজের ধর্ম পালন করাটাই কাজ, নিজের ধর্ম অন্যের উপর না চাপিয়ে দিলেই হয়। কোনও মুসলিম মানুষ কি আশা করেন যে রমজানের সময়ে কোনও হিন্দু মানুষ রোজা রাখবেন? কিংবা কোনও হিন্দু মানুষ কি আশা করেন পুজোতে বা কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এক জন মুসলিম মানুষ অংশগ্রহণ করবেন? এই প্রশ্নের উত্তর— না। এই যে একটা সূক্ষ্ম বেড়া আছে, সেটা মেনে চললেই হয়তো ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষিত হয়। কিন্তু একে অন্যের ধর্মের প্রতি যদি কেউ উদাসীন হন বা বিদ্বেষ পোষণ করেন, তা হলেই সমস্যা বাড়ে।
আজ থেকে কিছু বছর আগেও কি এত সমস্যা ছিল? হয়তো ছিল সুপ্ত ভাবে। কিন্তু আমরা বুঝতে পারিনি। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে কি এক জন মুসলিম মানুষ পুজো করছেন বা এক জন হিন্দু মানুষ মাথায় ফেজ টুপি পরে নামাজ পড়ছেন, সেই ছবি? না কি প্রতি দিনের ভারতে যে ছবি আমরা দেখতে অভ্যস্ত ছিলাম কিছু দিন আগেও, সেই পুরনো ছবিগুলো ফিরে পাওয়া বেশি জরুরি। যা পাওয়া যায় হয়তো স্কুল-কলেজে, অফিসে বা কারখানায়? যেখানে শুক্রবারের নামাজের জন্য এক জন মুসলিম সহকর্মীর কাজ করে দেন এক জন হিন্দু! কিংবা উল্টোটা? এর পাশাপাশি আরও একটা কাজ জরুরি। ছোটবেলা থেকে এক সম্প্রদায়ের মানুষ অন্য সম্প্রদায়ের মানুষের জীবনযাত্রা, ধর্মীয় আচার আচরণ সম্পর্কে উদাসীন থাকবেন না, প্রতিবেশীকে জানার চেষ্টা করবেন।
(চলবে)
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তুকার
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy