Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

‘Who the Devil you are?’ চেঁচিয়ে উঠে বললেন বঙ্কিম

মুর্শিদাবাদে তাঁর কর্মকালে, জেলার আনাচ কানাচে তাঁকে নিয়ে ছড়িয়ে রয়েছে অজস্র কাহিনি, হোক না কর্মসূত্রে, এ জেলায় বসেই তাঁর কলমে উঠে এসেছে মণিমানিক্য, লিখছেন সুদীপ জোয়ারদার 

শেষ আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০২০ ০০:৫৮
Share: Save:

বেরা, একটি উৎসব। একেবারে মুর্শিদাবাদের নিজের ব্যাপার। অন্য কোনও কারণ না ঘটলে, প্রতি বছর ভাদ্রের শেষ বৃহস্পতিবার, এই উৎসব বেশ সাড়ম্বরে পালিত হয় মুর্শিদাবাদে। ১৮৭০ সালে এই উৎসবে কিন্তু বেশ একটা মৌলিক পরিবর্তন ঘটে যায়। সৌজন্যে এক বিখ্যাত বাঙালি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

বঙ্কিম বহরমপুরে বদলি হয়ে এসেছিলেন ১৮৬৯-র ২৯ নভেম্বর (মতান্তরে ১৫ ডিসেম্বর ১৮৬৯)। অর্থাৎ, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর। পরে অবশ্য এখানে তাঁর পদন্নোতি হয়, অন্য দায়িত্বও তাঁকে দেওয়া হয়। তবে আলোচ্য সময়ে তিনি ওই একই পদে আসীন। প্রতি বারের মত সে বারেও নবাব পরিবারের পক্ষ থেকে বেরায় আমন্ত্রণ জানানো হল জেলার সরকারি আমলাদের। বঙ্কিমচন্দ্র কিন্তু আমন্ত্রণ পত্র ফিরিয়ে দিলেন। কারণ তিনি শুনেছিলেন এই উৎসবে আমন্ত্রিত অভ্যাগতদের মধ্যে শুধু সাহেবরাই নবাব প্রদত্ত জরিমানা দ্বারা উৎসব মঞ্চে বৃত হন। নবাব পরিবারের কর্মচারীকে বঙ্কিমচন্দ্র স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, যেখানে আপ্যায়নে এই বৈষম্য সেখানে তিনি আমন্ত্রণ গ্রহণ করতে অপারগ।

ব্যাপারটা এখানে থেমে থাকল না। নবাব পরিবারের উঁচু মহলে রীতিমতো আলোচনা শুরু হল। এর পর তাঁদের তরফ থেকে বঙ্কিমচন্দ্রকে আবার আমন্ত্রণ জানিয়ে বলা হল, এখন থেকে এ ধরনের পক্ষপাত ও বৈষম্যমূলক আচরণ ঘটবে না। সে দিন বেরা উৎসবে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতিবাদ এ ভাবেই দেশীয় অভ্যাগতদের জন্য বহন করে নিয়ে এসেছিল সমানাধিকার এবং সমমর্যাদা। বহরমপুরে থাকাকালীন মর্যাদার প্রশ্নেই বঙ্কিমচন্দ্রকে আরও এক বার বেশ বড়সড় লড়াই করতে হয়েছিল। শীতের অপরাহ্ন সে দিন। বঙ্কিমচন্দ্র পাল্কিতে ফিরছিলেন কোর্ট থেকে ব্যারাকের মাঠের পাশ দিয়ে। মাঠে ক্রিকেট খেলছিলেন গোরা সাহেবেরা। বঙ্কিমচন্দ্রের পাল্কির এক দিকের দরজা বন্ধ ছিল। হঠাৎ সেই বন্ধ দরজায় সজোরে করাঘাত। বঙ্কিম পাল্কি থেকে লাফিয়ে নেমে এক সাহেবকে দেখে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘Who the Devil you are?’ সাহেবটি ছিলেন সেনা দলের অধ্যক্ষ। নাম কর্নেল ডাফিন। বঙ্কিমচন্দ্রের চিৎকারে ডাফিন কোনও কথা না বলে তাঁর হাত ধরে দূরে সরিয়ে দিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র মাঠে গিয়ে পরিচিত বেনব্রিজ সাহেবকে পেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘Have you seen how I have been dealt with by that person?’ কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রকে হতাশ করে বেনব্রিজ সাহেব জানালেন, ‘O Babu, I am short sighted, I have not seen anything.’ বঙ্কিমচন্দ্র অন্য সাহেবদেরও শুধোলেন কেউ কিছু দেখেছেন কিনা। সকলেই দেখার কথা অস্বীকার করলেন।

পরদিন কোর্টে গিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র ডাফিনের নামে মানহানির মামলা করলেন। কোর্টের প্রায় দেড়শো উকিল মোক্তার স্বেচ্ছায় তাঁর ওকালতনামায় সই করলেন। ডাফিন মামলা চালাতে গিয়ে কোনও উকিল মোক্তার পেলেন না। অগত্যা মধ্যস্থতা করবার জন্য ডাফিন ডিস্ট্রিক্ট জজ বেনব্রিজ সাহেবের শরণাপন্ন হলেন। বেনব্রিজ বললেন, মধ্যস্থতা তিনি করতে পারেন যদি কর্নেল বঙ্কিমবাবুর কাছে ক্ষমা চান। ডাফিনের তখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা। প্রকাশ্য আদালতে বঙ্কিমচন্দ্রের হাত ধরে ডাফিন বললেন, ‘আপনার যে হাত ধরে আমি আপনাকে সরিয়ে দিয়েছিলাম, সেই হাত ধরে ক্ষমা চাইছি। আমাকে ক্ষমা করুন।’ ক্ষমা করলেন বঙ্কিমচন্দ্র, তুলে নিলেন মামলা। শোনা যায় ডাফিনের পরাজয়ের দৃশ্য দেখবার জন্য সে দিন আদালতে নাকি লোক ভেঙে পড়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্র বহরমপুরে ছিলেন প্রায় পাঁচ বছর। নিজের বুদ্ধি ও বিবেচনা মতো কাজ করতে গিয়ে তিনি কমিশনারের নির্দেশ লঙ্ঘন করতেও পিছপা হননি। তাঁর জনপ্রিয়তাও প্রচুর ছিল। তাঁর বদলি ঠেকাতে বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রায় দেড়শো আবেদনপত্র জমা পড়েছিল। ম্যাজিস্ট্রেট ও কমিশনার এই সব আবেদনপত্র দেখে বঙ্কিমচন্দ্রের বদলি রুখে দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি নিজেই স্বাস্থ্যের কারণে বহরমপুরে থাকতে চাইছিলেন না। বদলির আবেদনও তিনি নিজেই করেছিলেন। তাই শেষ পর্যন্ত বঙ্কিমচন্দ্রকে আর ধরে রাখা গেল না। ছোট লাটের অফিসের সেক্রেটারিকে ধরে তিনি বারাসতে বদলি হয়ে গেলেন।

বঙ্কিমচন্দ্রের বহরমপুর-পর্ব তাঁর সাহিত্যজীবনে একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বহরমপুর থাকার সময়েই ১৮৭২ সালের ১২ এপ্রিল (বাংলা ১২৭৯ বঙ্গাব্দের ১ বৈশাখ) বের হয় তাঁর সম্পাদনায় বিখ্যাত মাসিক পত্রিকা ‘বঙ্গদর্শন’। ছাপা প্রথম বছর কলকাতার ভবানীপুরের এক নম্বর পিপুলপটি লেনের ‘সাপ্তাহিক সংবাদযন্ত্র’ এবং দ্বিতীয় বছর থেকে সঞ্জীবচন্দ্র স্থাপিত কাঁঠালপাড়ার প্রেসে হয়। কিন্তু পত্রিকার লেখা সংগ্রহ, সম্পাদনার সমস্ত কাজই বঙ্কিমচন্দ্র করতেন বহরমপুরে বসে।

‘বঙ্গদর্শনে’র প্রথম সংখ্যা নিয়ে বহরমপুরে বঙ্কিম-পরিবারে বেশ একটা মজার ঘটনা হয়। লেখকের স্ত্রী পত্রিকার সদর পৃষ্ঠায় ‘ব’ এর নিচে একটা শূন্য বসিয়ে ফেলেন। দ্বিতীয়ভাগ পাঠরতা বঙ্কিমের কনিষ্ঠা কন্যা পত্রিকাটা হাতে করে নিয়ে গিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রকে শুধোন-‘বাবা, তুমি যে বলেছিলে বঙ্গদর্শন, এ যে রঙ্গদর্শন!’ বঙ্কিমচন্দ্র কিন্তু পত্রিকাটা হাতে নিয়েই বুঝে ফেলেন ব্যাপারটা। হাসতে হাসতে তিনি বলেন, ‘আমি তো বঙ্গদর্শনই লিখেছিলাম, তোমার গর্ভধারিণীর গুণে রঙ্গদর্শন হয়েছে। আমি কী করব মা!’ বঙ্কিমচন্দ্র বারাসতে বদলি হয়ে আসেন ১৮৭৪ সালের এপ্রিলের শেষ দিকে। ‘বঙ্গদর্শনে’র প্রথম সংখ্যা থেকে ১৮৭৪ এর এপ্রিল পর্যন্ত সংখ্যায় বঙ্কিমচন্দ্রের যে যে উপন্যাস আত্মপ্রকাশ করে সে গুলো হল ‘বিষবৃক্ষ’, ‘ইন্দিরা’, ‘যুগলাঙ্গুরীয়’ এবং ‘চন্দ্রশেখর’। এই সব উপন্যাসের আত্মপ্রকাশ যেহেতু বঙ্কিমচন্দ্রের বহরমপুর অবস্থান কালে, তাই এইসব উপন্যাস রচনা বহরমপুরে বসে হয়েছিল এরকম ধরাই যায়। ‘বিষবৃক্ষ’ নিয়ে অবশ্য বিতর্ক রয়েছে। অনেকের ধারণা, বহরমপুরে আসার আগেই বঙ্কিমচন্দ্র ‘বিষবৃক্ষ’ প্রথমাংশ রচনা করে ফেলেন। বঙ্কিম-বন্ধু এবং একই সময়কালে বহরমপুর কোর্টে ওকালতি করা অক্ষয়চন্দ্র সরকার অবশ্য লিখেছেন-‘বিষবৃক্ষ’ বহরমপুরে হয়।’

এ ছাড়া মহারাজা যোগীন্দ্রনারায়ণ রায়ের অতিথি হিসাবে বঙ্কিমচন্দ্রের লালগোলায় অবস্থান কালে ‘আনন্দমঠ’ লেখা হয়েছিল বলেও একটা দাবি রয়েছে এই জেলার। যদিও সে দাবি কতদূর সঙ্গত তা বিচারের অপেক্ষা রাখে। কেননা অক্ষয়চন্দ্র সরকারের সাক্ষ্যে রয়েছে যে ‘আনন্দমঠে’র গোড়াপত্তন হয়েছিল হুগলিতে। এ ছাড়া বহরমপুর পর্বের বহু পরে ১৮৮০ সালের ১৫ জুলাই বঙ্কিমচন্দ্র নবীনচন্দ্র সেনকে যে চিঠি লিখেছিলেন তাতে রয়েছে, ওই সময়কালেই তিনি হাত দিয়েছেন ‘আনন্দমঠ’ রচনায়।

বহরমপুর পর্বের উপন্যাসে তৎকালীন মুর্শিদাবাদও ছড়িয়ে আছে নানা জায়গায়। ‘চন্দ্রশেখর’ উপন্যাসে তো চন্দ্রশেখর, প্রতাপ, শৈবালিনীর বাড়িই মুর্শিদবাদের অনতিদূরে গঙ্গার কোলে বেদগ্রামে। এ ছাড়া এই উপন্যাসে যে বৃহৎ তাঁবুতে নবাবের দরবার বসে, অনুমান সেটিরও স্থান মুর্শিদাবাদ। উপন্যাসের মত বঙ্কিমচন্দ্রের বহু প্রবন্ধেরও সূতিকাগার বহরমপুর। সমালোচক, বিজ্ঞানচিন্তক, ‘কমলাকান্ত’, বঙ্কিমের আত্মপ্রকাশও তাঁর বহরমপুরে অবস্থানকালে। সে দিক দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যজীবনের বোধহয় সবচেয়ে উজ্জ্বল এই বহরমপুর পর্বই।

শিক্ষক,ভগবানগোলা হাইস্কুল

তথ্যঋণ: ‘বঙ্কিমচন্দ্র (জীবন ও সাহিত্য)’/গোপালচন্দ্র রায়। ‘বঙ্কিমচন্দ্রজীবনী’/অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য। ‘ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বঙ্কিমচন্দ্র এবং বহরমপুর’/কেশব কুমার বাগচী (মুর্শিদাবাদ অনুসন্ধান)

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy