—প্রতীকী ছবি
বিখ্যাত বিজ্ঞান-পত্রিকায় প্রকাশিত হইল আশ্চর্য তথ্য: বিগত বৎসরের শেষে পৃথিবীতে মনুষ্যসৃষ্ট পদার্থসমূহের সম্মিলিত ভর বিশ্বের জীবিত প্রাণের সম্মিলিত ভরকে ছাপাইয়া গিয়াছে। প্রাণের তথা বিজ্ঞানের ইতিহাসে এহেন ঘটনা ইহাই প্রথম। বিংশ শতাব্দীর শুরু হইতে আজিকার দিন পর্যন্ত মানুষ এই বিশ্বে যাহা যাহা বানাইয়াছে— প্রধানত প্লাস্টিক, ইট, কংক্রিট, অ্যাসফল্ট— এবং সেই সকল দিয়া আবার যাহা কিছু তৈরি করিয়াছে, সেই সমস্ত কিছুর সম্মিলিত ভর (১ টেট্রাটন) নির্ধারণ করিয়াছেন বিজ্ঞানীরা, এবং তাহা তুলনা করিয়াছেন এই মুহূর্তে বিশ্বের সকল প্রাণী ও উদ্ভিদের (শরীরের জলের ভর বাদ দিয়া) একত্রিত ভর বা ‘বায়োমাস’-এর সহিত। তাহাতেই প্রমাণিত, পৃথিবীর বুকে মনুষ্য-অস্তিত্বের ভার প্রকৃতিভারকে ছাপাইয়া গিয়াছে। ১৯৫০-এর পর হইতে এই প্রবণতা বাড়িয়াছে, সাম্প্রতিক কালে প্রতি বিশ বৎসরে তাহা দ্বিগুণ হইতেছে, অন্য দিকে কমিতেছে প্রাণী ও বিশেষত উদ্ভিদ— অরণ্য ও অন্যান্য প্রকৃতি-পরিসরে। এই ভাবেই বাড়িতে থাকিলে, ২০৪০ সালের মধ্যে তাহা তিন গুণ হইবে!
অর্থাৎ, মানুষের হাতে পড়িয়া পৃথিবী আমূল বদলাইয়া গিয়াছে। বিজ্ঞান তো তাহার কাজ করিল, দর্শন কী বলিবে? কিংবা ধর্ম, বা নীতিশাস্ত্র? মনোবিজ্ঞান বলিবে, মানুষ কাজ না করিয়া, পুরাতনের চর্চা বা নূতনের সৃষ্টি ব্যতীত স্থিত থাকিতে পারে না, ক্রমাগত উৎপাদন ও পরিবর্ধনেই তাহার তৃপ্তি ও বিকাশের বোধ। কোনও এক বৈশ্বিক আইনে যদি আজ হইতে সকল প্রকার রাস্তা, বাড়িঘর ও কলকারখানার কাজ বন্ধ করিয়া দেওয়া হয়, তাহাতে মানুষ হয় নৈরাশ্যে মারা যাইবে, নয় ঘুরপথে বা লুকাইয়া-চুরাইয়া কাজে লাগিয়া পড়িবে। কাজ তাহাকে করিতে হইবেই, এবং তাহার চারিপার্শ্বের প্রকৃতি যে হেতু সঙ্কুচিত ও কর্তিত হইয়া পড়িয়াছে, তাহার কাজ তাই মুখ্যত স্ব-সৃষ্ট বস্তুসমূহ লইয়াই। প্রকৃতির সহিত আশ্লিষ্ট, ন্যূনতম চাহিদাযুক্ত তাহার প্রাগৈতিহাসিক বা প্রাচীন পূর্বজদের জীবনে সে আর ফিরিতে পারিবে না, তাহার সেই জিন পাল্টাইয়া গিয়াছে। বহিঃসৃষ্টিমুখর, উৎপাদনসর্বস্ব জীবনে দুই দণ্ড জিরাইতে গিয়া গৃহ হইতে বহু দূরে অরণ্যমধ্যে রিসর্টের ভাড়া গনিবার সময় সে এখন বিরক্ত হইয়া ভাবে, আরও পাঁচটি হোটেল থাকিলে এহেন বিড়ম্বনা হইত না। জলাভূমি বুজাইয়া, সবুজ ঘুচাইয়া ইট-কংক্রিটের ইমারত তুলিয়া সে এখন বিজ্ঞাপন দেয়, এইখানে প্রত্যেকের বাড়িতে এক টুকরা সবুজ বাগান থাকিবে, ত্রিশ তলার উপর কাকচক্ষু সরোবর মিলিবে, হইলই বা কৃত্রিম। অথচ নীতিশাস্ত্রকে তালাবন্ধ করিয়া না রাখিলে, অরণ্যভেদী পথে বন্য মৃগকে রাস্তা পার হইতে দেখিয়া উল্লসিত সে বুঝিতে পারিত, আসলে হরিণ রাস্তা পার হইতেছে না, তাহার হাতে তৈরি পিচরাস্তাই অরণ্যকে নিষ্ঠুর কাটিয়া-কুটিয়া চলিয়া যাইতেছে।
উপযোগবাদ বলিয়া একটি পশ্চিমি তত্ত্ব আছে, তাহা বলে— যে কাজে সুখ হয় তাহাই ঠিক, যে কৃতি দুঃখবহ, তাহা ভুল। মানুষ এই ঢাল খাড়া করিতে পারে, নদীতে বাঁধ দিয়া, ডায়নামাইটে পাহাড় উড়াইয়া আমার সুখ হইতেছে, অতএব উহা ঠিক। উপরন্তু, এই সকলই তো মানুষেরই কাজে লাগিতেছে, সবুজ মুছিয়া সেখানে জনবসতি গড়িলে কত লোক থাকিতে পারে, নূতন কারখানা হইলে কত মানুষের কর্মসংস্থান হয়। সুতরাং এই সুখ স্বার্থান্ধ নহে, বরং সহমানুষের শুভঙ্কর। প্রাচ্য তথা ভারতের শাস্ত্রতত্ত্ব কিন্তু অন্য কথা বলে। উপনিষদে ‘অভ্যুদয়’ তথা জাগতিক সমৃদ্ধির সঙ্গেই ওতপ্রোত রহিয়াছে ‘নিঃশ্রেয়স’ তথা আত্ম-উপলব্ধির সাধনার কথা। অর্থাৎ, বাহিরের স্বাচ্ছন্দ্য ও ভিতরের বিকাশ দুই-ই হইবে, একা প্রথমটি নহে। ইহা স্রেফ ধর্মকথা নহে, সমাজ-সংসারের, ব্যবহারিক জীবনেরও কথা। মানুষের লাগামহীন চাহিদাকে শমিত করিতে নীতি, আইন, নির্দেশিকার অন্ত নাই, পৃথিবী ও প্রকৃতির রাজা হইবার নেশায় সে তবু থামিতেছে না। প্রকৃতিকে ভরে-ভারে লঙ্ঘনের বিপদ সম্পর্কে বিজ্ঞান তাহাকে সতর্ক করিতে পারে, দুর্যোগের নিখুঁত পূর্বাভাস জানাইয়া দিতে পারে। কিন্তু প্রতিনিয়ত তাহার ব্যাপক বিপুল সৃষ্টি যে কেবল বহিরঙ্গের বোঝা হইতেছে, সেই দিকে তাহার দৃকপাত নাই। প্রতিটি মানুষের শরীরের ভর যত, প্রতি সপ্তাহে তাহা অপেক্ষা বেশি ভরের বস্তুসকল সে তৈরি করিতেছে তাহার চারিপার্শ্বে। এই উৎপাদনের কতটুকু আসলেই তাহার প্রয়োজন, কতখানি সে ভোগ করিতেছে, কোন সীমানার পরে আর না হইলেও চলে, তাহা তাহাকে জানাইবে কে? প্রকৃতি সংহার করিয়া তাহার এই অতিসৃষ্টির তাড়না যে আসলে এক অপ্রাকৃত বিকার, বুঝাইবে কে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy