ঠি ক বলেছেন মাননীয়া হেমা মালিনীজি। ভুলটা সোনমের বাবারই। ভুলটা আমাদের। কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল: তার হিসেব করার একটা মাপকাঠি থাকে সব সভ্য সমাজে। একটা মানদণ্ড, একটা বিচার করার স্কেল। কিন্তু আমরা ভুলে গিয়েছিলাম, সাধারণ টুনটুনি পাখির বাসায় যে কাঠের স্কেল থাকে আর রাজার ঘরে যে বহুমূল্য রত্নখচিত ধাতুর তুলাযন্ত্র থাকে: দুটো একেবারে আলাদা। তাই ওঁদের উচিত-অনুচিত, ঠিক-বেঠিক, শোভন-অশোভন বোধে আর সাধারণ নজরের নিক্তি-ওজনে এমনধারা গরমিল হয়ে যায়।
কিছু দিন আগেই মুম্বই থেকে কলকাতায় ফিরছিলাম। প্লেনের ছাড়ার সময় হয়ে গিয়েছিল, এমন সময় সিঁড়িটা সরতে সরতে সামনের দরজা থেকে পিছনের দরজায় এসে স্থির হল। বুঝলাম শেষ মুহূর্তে কেউ ছুটতে ছুটতে এসে পৌঁছেছেন, তাই দয়ালু কর্তৃপক্ষ এই বন্দোবস্ত করেছেন। কিন্তু তা নয়। প্লেনের দিকে এক জন এগিয়ে আসছিলেন এবং ধীরেসুস্থে। মাইকেল জ্যাকসন-সম পোশাকের বাহার, খিড়কি দরজা দিয়ে ঢুকে আমাদের পাশের রোয়েই বসলেন।
একটা গণতান্ত্রিক দেশে এক দল মানুষকে ঘিরে এ রকম বেনিয়ম লাগাতার চলছে। তাঁদের মেকআপে দেরি হয়েছে বলে প্লেন দাঁড়িয়ে থাকে, রেস্তোরাঁয় লাইন ভেঙে অন্যের আগে খাবার সাজিয়ে দেওয়া হয়, নেমন্তন্নবাড়িতে সোফা ছেড়ে দিতে হয়। তার পর, যাঁরা তাঁদের এই সুযোগ করে দিচ্ছেন, তাঁদের সঙ্গেই এই মহান জীবরা দুর্ব্যবহার করেন। রাস্তাঘাট, পাবলিক প্লেসে আসার দরকারটা এড়িয়ে যেতে পারেন না, কিন্তু এলে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রাখেন। কপালে ঠোঁটে বিরক্তির প্রদর্শনী। এই বেনিয়মটা হওয়াই নিয়ম। সোনমের বাবা বুঝতে পারেননি, ট্রাফিক সিগনাল নয়, তিনি আসলে এই নিয়মটা ভেঙেছেন বলেই হেমা মালিনী তাঁকে তিরস্কার করেছেন।
তিরস্কারই প্রাপ্য। আমাদের কথা বলছি। বিনোদন-জগৎ নিয়ে এতখানি উল্লাস আর উন্মাদনা আমাদের, ওই মানুষদের প্রতি এতটাই আকর্ষণ ও ভালবাসাবাসি, যে তাঁদের আকাশের তারাই বানিয়ে ফেলেছি। কাউকে কাউকে তো ভগবানের আসনও উৎসর্গ করে বসে আছি। অথচ, এই দেবতা বানিয়ে ফেলার অভ্যাসটাই যে যাচ্ছেতাই। নিজেরাই তো ঠিক করেছি, এই যে এঁরা এঁরা রাগী দেবতা। এঁদের ভাল করে ভোগ চড়াও। দিন রাত পূজা করো, তার পর তাঁর রোষ আর লোভের ভয়ে কাঁপো। কালীঠাকুরের কোপ, শনিঠাকুরের দৃষ্টি: সবই আমাদের সৃষ্টি। ‘দেবতার জন্ম’ মানুষের হাতে, ‘দেবতার গ্রাস’ও মানুষেরই কল্পনা। তাই এখন দেবতার উৎপাতও সহ্য করো। কারণ প্রিয় দেবতার হাত ধরেই তো রং নম্বরের অত্যাচার শুরু। দেবত্বকে সামনে রেখেই তো আসরে নামে রাজতন্ত্র, স্বৈরাচার আর বর্ণাশ্রম।
এই একবিংশ শতাব্দীর সেলেব্রিটি-সার্কাসে তার সবটাই দেখা যায়। কেউ সিনেমার এক নম্বর, অর্থাৎ ভারতের বেতাজ বাদশা। সব ভক্ত তাঁর প্রজা। মাঝেমাঝে বাংলোর বাইরে এসে ঝরোখা দর্শন দিয়ে যান। কেউ আবার নির্ডর নায়ক। ভালবাসলে প্রাণ উজাড় করে দেবেন, কিন্তু মুড হলে হরিণ-ময়ূর শিকার করেন, অসাবধানে মানুষ মরলেই বা কী? অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিলেই চুকে গেল। দেশের আইন তাঁর মর্জি-মেজাজে উঠছে-বসছে। এই নয়া মডেলেই আবার জেগে উঠেছে প্রায় তলানিতে চলে যাওয়া বর্ণাশ্রম। পরদায় মুখ দেখানো মাত্র, অনেক মানুষই ভাবতে লাগলেন তাঁরা এই আধুনিক সমাজের ‘উঁচু জাত’টায় উঠে বসে আছেন। তাঁদের আশকারা দিয়ে, অনেক সাধারণ ও ‘অসাধারণ’ মানুষও তাঁদের সবাইকে নিয়েই কিম্ভূত আদেখলাপনা শুরু করল। রাস্তায় দেখলেই তাঁদের স্বস্তি ও ব্যক্তিগততে আঘাত। ব্যথা কমাবার ইঞ্জেকশন নিলে ব্রেকিং নিউজ। রাজ্যের শাসক হওয়া সত্ত্বেও টিভির মানুষ দেখলেই বেলাগাম উচ্ছ্বাস। এ সবের মিলিত উসকানিতেই এই হতভাগ্য দেশে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে সেলেবতন্ত্র। তার শেকড় আমাদের রক্ত-মজ্জায়। সে জন্যেই পরদার মানুষ দেখে আমরা অসভ্যতা করি। ও দিকে স্ক্রিন-দেবতারাও আমাদের দেখলে নিকৃষ্ট জীব মনে করে হ্যাট হ্যাট করেন। মুখ ঘুরিয়ে নাক উঁচিয়ে বোঁ করে বেরিয়ে যান।
রক্তে ভাসতে ভাসতে, শরীরে অত যন্ত্রণার মধ্যেও সেলেবতন্ত্রের এই কেতাগুলোই কি হেমা মালিনীর মনটায় রাজত্ব করছিল? অ্যাক্সিডেন্টে কি মনটাও নিখাদ বেরিয়ে আসে? আজ একটু সুস্থ হয়ে যতই টুইটে পালটা উকিলি যুক্তি সাজান, কেমন যেন পরিষ্কার দেখা যায় ছবিটা। ড্রিমগার্লের খুউউব লাগল। তিনি কাতর থেকে কাতরতর হয়ে পড়লেন। এবং চেনা ছকে, ভেবে নিলেন, সব রকম সেবা-শুশ্রূষা-আহা-উহু-চটজলদি ব্যবস্থা এক্ষুনি সব কাজ ছেড়ে তাঁর দিকে ধেয়ে আসবে। হলও তাই। তিনি বড় হাসপাতালের দিকে ছুট লাগালেন এবং বাকি মানুষপোকারা পড়েই রইল। অন্য ভিআইপি ও মিডিয়াবর্গ তাঁকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সেলেবতন্ত্রের নিয়ম। কিন্তু ওই একই স্বার্থপরতা, সংবেদনহীনতা এক জন বয়স্ক জনপ্রতিনিধির দেখানোর কথা না কি? এ কেমন সৃষ্টিছাড়া কাণ্ড?
অন্তত, ওঁর মায়ের প্রাণটাও তো ককিয়ে ওঠার কথা! হিরোইন-সত্তা কি সেই আত্মাটাকেও অহংকারের খাঁচায় আটকে রেখেছে? অবাক লাগে! যাঁরা ‘সেলেব-সুলভ আচরণ’ করেন, কখনও ভাবেন, কোন অধঃপাতে নামছেন? রোগ কতটা কঠিন হলে, তা বুদ্ধি আর অনুভবকে এতটা অসাড় করে দিতে পারে? খুব বিশ্রী অসুখ এই সেলেবপুজোর অভ্যেস। ভুগছে দু’পক্ষই, ধুঁকছে গোটা সমাজ। এর সঙ্গে যুদ্ধ করার উপায় খুঁজতে হবে এই বেলা। ভারী সোজা একটা রাস্তা আছে কিন্তু। শুধু যুক্তির সুস্থ নজর মেলতে হবে। সিরিয়াল, সিনেমা, গানের স্টেজ বা রিয়েলিটি শো: যেখানেই তাঁকে দেখা যাক, দিনের শেষে ওটা তো একটা পেশা। এ পেশায় ভীষণ খাটুনি। মাথা আর শরীরকে এক সঙ্গে নিংড়ে নেয়। সময় কেড়ে নেয়। অক্লান্ত কসরত করে নিজেকে দর্শনীয় করে রাখতে হয়। তার পরে আসে রিহার্সাল করে করে করে দুরন্ত পারফরমেন্স বের করে আনার বিষয়টুকু। এত কষ্টের পরে মেলে এ কাজের কেষ্ট। আরে বাবা, অভিনয় করলে লোক তো চিনবেই। রেলে চাকরি করলে প্রায়শই ভারতদর্শনে বেরোতে পারে কি না কিছু কিছু মানুষ? মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হলে দুনিয়া দেখা হয়ে যায় তো? স্কুলে পড়ালে ছোটবেলার মতো গরমের ছুটি পুজোর ছুটি মেলে। এ রকম সব জীবিকারই কোনও না কোনও স্পেশাল ইনসেন্টিভ থাকে। সেটা পেশারই অঙ্গ। অভিনেতার তো আবার এই সুবিধাটাই এক প্রকার মূলধন। লোকে তাঁকে যত চিনবে, যত তাঁকে চাইবে, তত সফল হবেন তিনি। সেই সাফল্যে পা দিয়ে দিয়ে আরও কত দূর এগিয়ে যেতে পারেন। কোনও রকম যোগ্যতার তোয়াক্কা না করে এমনি এমনিই ভোটে দাঁড়িয়ে যেতে পারেন। মানুষ চেনে, ভালবাসে বলেই তাঁকে জিতিয়ে নিজেরাই হেরে বসে থাকে।
কে না জানে, পেশাকে জীবনের সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে সব কিছুই বড্ড শক্ত আর জটিল হয়ে যায়। কিন্তু সরল কথাটা সহজ ভাবে বুঝলে তো এ পৃথিবীটাও শিশুর বাসযোগ্য হয়ে যেত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy