নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ছ’মাস অতিবাহিত। বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উঠছে, মোদী সরকার কি এত দিনের পচে যাওয়া রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সত্যি সত্যিই কোনও বদল আনতে পারছেন?
ভারত দীর্ঘ দিনের নেহরু-গাঁধী পরিবারের শাসন দেখেছে। এ বার কি তবে নেহরু-গাঁধী যুগের অবসান ঘটিয়ে সত্যি সত্যিই মোদী যুগের সূচনা হতে চলেছে?
যেখানেই যাই, তা সে দিল্লি বইমেলাই হোক বা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও আলোচনা সভা— উপস্থিত মানুষজনের প্রশ্ন, আচ্ছে দিন সচমুচ আ গ্যায়ে হ্যায়?
যাঁরা মোদীর কট্টর সমালোচক, তাঁরা তো প্রথম থেকেই বলতে শুরু করেছেন, কোনও কিছুই বদলায়নি। কোনও কিছুই বদলাচ্ছে না। কোনও কিছুই বদলাবে না। এই শ্রেণির সমালোচকরা আরও বলেন, প্রথমত নির্বাচনে মোদীর জয়লাভ, এটা প্রচুর টাকা খরচ করে কৃত্রিম উপায়ে জনমত তৈরি (ম্যানুফ্যাকচারড পাবলিক ওপিনিয়ন)। দ্বিতীয়ত, মোদীর কাছ থেকে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। কারণ, গত দশ বছরে মনমোহন সিংহ সরকারের নীতিপঙ্গুতা, দুর্নীতি, প্রশাসনিক ব্যর্থতা— এগুলিও বড় নির্মম সত্য। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সেই আমলাতন্ত্র, সেই ব্যবস্থার হাতেই বন্দি। তিনি যোজনা কমিশনের নাম বদলে নীতি আয়োগ ঘোষণা করতে পারেন, কিন্তু নাম বদলালেও আসলে বোতলের ভিতরে থেকে যায় পুরনো মদ। ঘুণ ধরা দেওয়ালে চুনকাম কি প্রকৃত সংস্কার?
এর চেয়েও বড় আর একটি অভিযোগ কিছু কিছু প্রাবন্ধিক উত্থাপন করছেন। তাঁদের বক্তব্য, গোধরার দাঙ্গার রক্ত যাঁর হাতে এখনও লেগে আছে, তিনি বহুত্ববাদী ভারতকে প্রতিনিধিত্ব করবেন কী ভাবে? আর তাই সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ এখনও নির্মম ভাবে মোদীকে তাড়া করে ফিরছে। আরএসএস এবং সঙ্ঘ পরিবারকে অসন্তুষ্ট করে তিনি আর্থিক সংস্কারের রথ চালাবেন, এমন কোনও সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। দিল্লির সংবাদপত্রে যাঁরা প্রবন্ধ লেখেন, তাঁদের গড়পরতা মনোভাব এক কথায় যদি বলতে হয়, সেটি হল, নরেন্দ্র মোদীর কিছু করার আগ্রহ আন্তরিক। কিন্তু এখনও পর্যন্ত ইচ্ছার প্রকাশ দেখা গেলেও তার বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। সুতরাং এখনও পর্যন্ত বিবৃতি, ঘোষণা, মন কি বাত, টুইট, ফেসবুক— এ সবের মধ্যেই তিনি আবদ্ধ। ক্ষমতায় যখন এসেছেন, তখন তিনি দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় থাকতে চাইবেন, এটা তো স্বাভাবিক। তার জন্য কিছু করে দেখানোর ইচ্ছা থাকাটাও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সকলেই যেমন কবি নন, কেউ কেউ কবি। তেমনই সকলেই কি প্রধানমন্ত্রী তথা রাজনেতা হন? কেউ কেউ হন।
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বেশ কয়েক বার কথা বলার সুযোগ আমার হয়েছে। আমার মনে হয়েছে, কিছু করার একটা তীব্র আকাঙ্ক্ষা ওঁর ডিএনএ-তেই আছে। এক বার লালকৃষ্ণ আডবাণী আমাকে বলেছিলেন, কোনও ব্যক্তির অভিলাষ যদি খুব তীব্র হয়, তবে তাঁর আকাঙ্ক্ষাও পূরণ হয়। যেমনটি হয়েছে নরেন্দ্র মোদীর ক্ষেত্রে। ওবিসি চা-ওয়ালার ছেলে দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়া— এটাও খুব সাধারণ ঘটনা নয়। কিন্তু নরেন্দ্র মোদীরও এ সব শঙ্কা যে নেই, তা নয়। তিনিও জানেন, ভারতের মতো এত বড় জটিল একটি দেশে কিছু করা চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। ১৯৮৪ সালে মায়ের মৃত্যুর পর রাজীব গাঁধী চারশোর উপর আসন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। মাত্র তিন বছরের মধ্যে ‘মিস্টার ক্লিন’ বফর্স গাঁধীতে পরিণত হলেন।
নরেন্দ্র মোদী জানেন, তাঁর সরকার যদি নীতি-রূপায়ণ আগামী কয়েক বছরের মধ্যে দেখাতে না পারে, তা হলে মানুষ তাঁকেও পরিত্যাগ করতে দ্বিধা করবেন না। নরেন্দ্র মোদী এটিও জানেন, প্রত্যাশা গগনচুম্বী হতে পারে, কিন্তু তাঁর হাতে আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ নেই। তিনি অরণ্যদেবও নন। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে একটা রাজ্য পরিচালনার চেয়ে রেস কোর্স রোডের বাড়িতে বসে দেশ চালানো যে কঠিন কাজ, সেটিও তিনি বিলক্ষণ জানেন। দীর্ঘ দিনের দাপুটে আমলাতন্ত্র, তার লালফিতের বাঁধন, প্রতি দিন প্রতি মুহূর্তে তিনি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। গুরুচরণ দাসের মতো প্রাবন্ধিক বলেছেন, মনমোহন সিংহকে সংস্কারের কাজ করতে দেয়নি সনিয়া গাঁধীর জাতীয় উপদেষ্টা পর্ষদ। আর মোদীকে কাজ করতে দিচ্ছে না মোহন ভাগবতের আরএসএস। শুধু গুরুচরণ দাস নন, রামচন্দ্র গুহ, গোপাল গাঁধী, প্রতাপভানু মেটা, নিহাল সিংহ প্রমুখ প্রাবন্ধিক একই কথা বলছেন। প্রতিশ্রুতি ঢক্কানিনাদের রূপায়ণ কোথায়?
নরেন্দ্র মোদী পারবেন না, আমি মাত্র পাঁচ মাসেই এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলার বিরুদ্ধে। এই মূল্যায়ণে বিজেপি, কংগ্রেস, তৃণমূল, সিপিএম— এ সব আমার বিবেচ্য বিষয় নয়। এটি ঠিক, রাজনৈতিক মতাদর্শ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর কোনও কোনও নীতি বাস্তবায়নের পথে বাধা হয়। যেমন কতটা বেসরকারিকরণ হবে, কতটা হবে না, তা নিয়ে বিভিন্ন দলের মধ্যে মতাদর্শগত ভাবে পার্থক্য থাকতে পারে। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা বলছে, ভারতের রাজনীতিতে এই নীতি রূপায়ণের ক্ষেত্রে মতাদর্শের প্রাসঙ্গিকতা কমছে। কংগ্রেস এবং বিজেপি, এই দুই বৃহত্ দলের মধ্যে বেসরকারিকরণই হোক আর বিদেশ নীতিই হোক, ফারাক অনেক কম। আবার সঙ্ঘ পরিবারের প্রধান ইস্যু হলেও ৩৭০ বা অভিন্ন দেওয়ানি বিধি মোদীর পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা সরকার হওয়া সত্ত্বেও বাস্তবে রূপ দেওয়া এত সহজ নয়। গোটা দেশের মানুষের জনমত, তার একটা অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ শক্তি কিন্তু আছে। সেটাই ভারতবর্ষের মনন।
কিন্তু যাঁরা প্রথমেই নরেন্দ্র মোদী পারবেন না বলে শুরু করেন, তাঁদের সঙ্গে আমার তফাত একটাই। সেটা হল, সমালোচনাটা করার আগে আগামী কয়েক বছর মোদীকে সময় দেওয়াটাও প্রয়োজন। না পারলে পাঁচ বছর পর আমরাই সমালোচনা করব। যোজনা কমিশন বদলে দিয়ে তিনি এই সংস্থার ভূমিকাটা বদলে দিতে চাইছেন, ঠিক কী ভাবে সেটা তো আমরা জানি না। দীর্ঘ দিনের মাইন্ডসেট, এত বছর ধরে চলে আসা প্রতিষ্ঠান, তাকে বদলানো যাবে না। কিন্তু আমরা তো এখনও দেখিনি মোদী যোজনা কমিশন নিয়ে আসলে কী করতে চাইছেন। সংস্থার নাম বদলেছে। পরিচালকদের নাম ঘোষণা হয়েছে। কিন্তু ঠিক কী ভূমিকা হবে এই নতুন সংস্থার, সেটা না জেনেই সমালোচনা করব?
নরেন্দ্র মোদী মানুষটাকে আমি বহু বছর ধরে চিনি। মানুষটি কিন্তু একগুঁয়ে। কোনও কিছু করব ভাবলে করেই ছাড়েন। ৭ রেস কোর্স রোড তাঁর নতুন ঠিকানা। রাজ্য-রাজনীতি ছেড়ে দিল্লিতে এসে সিংহাসনে বসা, সেটাও হালে। আস্তে আস্তে দিল্লির আবহাওয়ায় নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছেন তিনি। মনের কোণে একটা ক্ষোভও আছে, দিল্লির সংবাদমাধ্যম অভিজাত প্রেমী। অতীতে সর্দার বল্লভভাই পটেলের খাটো ধুতি পরা নিয়ে সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যম অনেক ব্যঙ্গবিদ্রূপ করেছে। মোরারজি দেশাইয়ের মূত্র-থেরাপি ব্যক্তিগত বিষয় হিসাবে রাখতে দেয়নি। আর তিনিও চা বিক্রেতার ছেলে। সম্ভবত সেই কারণে দিল্লির সংবাদমাধ্যম তাঁর মতো অনভিজাত ব্যক্তিত্বকে গ্রহণ করতে চায় না। এই মানসিকতার বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই এখন অব্যাহত। প্রশ্ন একটাই, দেশের বহুত্ববাদী সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়া কি সত্যই সম্ভব হবে নরেন্দ্র মোদীর পক্ষে? আসুন, সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমরা কিছু দিন অপেক্ষা করি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy