জয়যাত্রা। ঝাড়খণ্ডের বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে দুমকায় এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ছবি: পিটিআই
এই বছরটা যে নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদীর ছিল, তাতে কোনও সন্দেহই নেই। অন্য কোনও বছর হলেও তিনি প্যাভিলিয়নে থাকতেন ঠিকই, হয়তো প্যাড-গ্লাভস পরে তৈরি হয়েই থাকতেন, কিন্তু বাইশ গজে নয়। এই বছরটা তাঁকে রাজনীতির বাইশ গজের একাধিপতি করেছে। বছরের গোড়া থেকে, লোকসভা নির্বাচনের প্রচার পর্বে, তিনি যে পিচেই দাঁড়িয়েছেন, লাগাতার ছক্কা হাঁকিয়ে গিয়েছেন। এ বছর তিনি যা পেয়েছেন, ভবিষ্যতে আর কোনও একটি বছরে ততটা অর্জন করা শুধু কঠিন নয়, তার জন্য বোধ হয় ম্যাজিকও প্রয়োজন হবে।
তাঁর এ বছরের সাফল্য আরও বেশি চোখে পড়ছে, কারণ প্রায় কেউই ভাবেননি যে তিনি এতখানি সফল হবেন। তাঁর অতীতের কথা মাথায় রেখেই ভাবেননি। গুজরাতের নির্বাচনী ময়দানে তিনি বরাবর সফল, সত্যি, কিন্তু লোকসভা নির্বাচন অন্য খেলা। কিন্তু, খেলাটা ঘুরিয়ে দিলেন তিনি। তাঁর গুজরাতের সাফল্যকেই তিনি সর্বভারতীয় প্রচারে নিয়ে এলেন। তাঁর যে একটা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা রচনার ক্ষমতা আছে— অন্তত নিজের জন্য— সেটা প্রতিষ্ঠা করে ফেললেন। সাধারণ মানুষ তাঁকে ‘কাজের লোক’ হিসেবে চিনল, এবং দেখল যে তিনি মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারেন। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে এখানেই আলাদা হয়ে গেলেন মোদী। তবে, কপালও তাঁর সঙ্গে ছিল, অস্বীকার করা যাবে না। নির্বাচনী ময়দানে তাঁর বিরুদ্ধে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই অতি প্রবীণ, অসম্ভব একঘেয়ে, এবং চেনা সুরে চেনা কথা বলতে অভ্যস্ত রাজনীতিক। তাঁদের সেই চেনা কথার মধ্যে এমন কিচ্ছু ছিল না যেটা শুনে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। বরং, তাঁদের সব ক’টা কথাই শুনতে বড্ড অন্তঃসারশূন্য, মিথ্যে ছিল।
তাঁর উত্থানের মঞ্চটি যে তাঁর বিরোধীরাই সাজিয়ে রেখেছিলেন, তাতে সন্দেহ নেই। অজস্র কেলেঙ্কারি, দুর্নীতি, সরকারি নীতিপঙ্গুত্ব এবং সার্বিক অকর্মণ্যতায় মানুষ সম্পূর্ণ বীতশ্রদ্ধ হয়ে ছিল। নরেন্দ্র মোদী সুযোগটি পেয়েছিলেন। তাঁর কৃতিত্ব, তিনি সেই সুযোগটি হেলায় নষ্ট করেননি। এই কারণেই ২০১৪ সালটি তাঁর। তিনিই এই বছরটির চরিত্র তৈরি করে দিয়েছেন। তাঁর নির্বাচনী প্রচারপর্বে মোদী যে কথাগুলো বলেছিলেন, সেগুলো অন্য সময় হয়তো অন্তঃসারশূন্য, সাদামাটা, এমনকী অতিনাটকীয় শোনাত। কিন্তু, দ্বিতীয় ইউপিএ সরকার নিজের বিশ্বাসযোগ্যতার যে বিপুল ঘাটতি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল, সেই প্রেক্ষিতে মোদীর কথাগুলো মানুষের মনে ধরেছে। ইউপিএ সরকারের সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা যিনি করেছিলেন, তাঁর নাম মনমোহন সিংহ। মানুষের কাছে তাঁর অভিজ্ঞান ছিল তাঁর সততা। কিন্তু দেখা গেল, তিনিই ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারের শীর্ষপদে বসে থাকলেন সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় ভাবে। এমন নিষ্ঠুর পরিহাসের তুলনা মেলা ভার। এই আবহে নরেন্দ্র মোদীর অতীতের অন্ধকার দিকগুলো মানুষের মনে দাগ কাটতে ব্যর্থ হল। গুজরাতের যে আর্থিক সাফল্যের কথা মোদী তাঁর প্রচারযজ্ঞে ফলাও করে বললেন, সেগুলো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাঁরই কৃতিত্ব কি না, মানুষ এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধানেও আগ্রহ বোধ করল না।
২০১৪ সাল যখন পড়ল, দেশের মানুষ তখন এক জন নেতার খোঁজে হন্যে। এমন এক জন নেতা, যাঁকে বিশ্বাস করা যায়। ঠিক এই পটভূমিকাতেই নরেন্দ্র মোদীর আবির্ভাব। তিনি জানালেন, তাঁর কাছে সব সমস্যার চটজলদি, হাতে-গরম সমাধান আছে। মানুষ ঠিক এই কথাটাই শুনতে চাইছিল। কোনও বিস্তারিত যুক্তি নয়, আমলাতান্ত্রিক জটিলতার ব্যাখ্যা নয়, শুধু চটপট সব মুশকিল আসান করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। মোদী জানালেন, তিনি একেবারে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় ঠিক করে দেবেন সব কিছু। দেশের মানুষ যখন ঘুমোবে, তখন তিনি আর তাঁর প্রদীপের দৈত্যরা কাজ করবেন অতন্দ্র একাগ্রতায়, যাতে মানুষ এক নতুন ভারতে নতুন প্রভাতের সূচনা করতে পারে। সাধারণ মানুষ বিলক্ষণ বিশ্বাস করেছেন এই প্রতিশ্রুতিতে। তাঁদের মনে হয়েছে, গোটা দেশ যদি এমন দ্রুত দুর্নীতির অতলে পৌঁছে যেতে পারে, তবে সেই অতল থেকে প্রত্যাবর্তনও সমবেগেই ঘটবে না কেন? দেশটাকে ফিরিয়ে আনতে আর যা কিছু করার ছিল, দেশের মানুষ সবই করে ফেলেছিলেন। বাকি ছিল শুধু নরেন্দ্র মোদীর মুশকিল আসানের প্রতিশ্রুতি। মানুষ তাতে বিশ্বাস করেছেন বলেই বছরটা এমন ভাবে মোদীর হতে পেরেছে।
রাজনীতিতে মোদী একেবারেই নবাগত নন। কিন্তু এত দিন তিনি সীমাবদ্ধ ছিলেন তাঁর রাজ্যের ভৌগোলিক পরিসরে। দিল্লি দরবার তাঁর কাছে নতুন। ঠিক সেই কারণেই সর্বভারতীয় রাজনীতির কাদার দাগ তাঁর গায়ে লাগেনি। সে দিক থেকে তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা অক্ষুণ্ণ ছিল। ঘটনা হল, মোদী নির্বাচনে জিতেছেন ঠিকই, কিন্তু আর এমন কিচ্ছু হয়নি যাতে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে তিলমাত্র পরিবর্তন আসতে পারে। আন্তর্জাতিক বাজারে টাকা এখনও টলমল করছে, শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদনের হারে জোয়ার আসার কোনও চিহ্ন এখনও নেই, রিয়াল এস্টেটের বাজার এখনও এলোমেলো। কিন্তু, এই না হওয়াগুলোর কোনওটাই মোদীর প্রতিশ্রুতির বিশ্বাসযোগ্যতার গায়ে এখনও আঁচড় কাটতে পারেনি। আমরা সদ্য ভাল থাকায় বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছি, হতাশার গহ্বরে ফিরে যাওয়ার সময় এখনও হয়নি। এই আশাবাদের হাওয়াতেই শেয়ার বাজার পাল মেলে দিয়েছিল, সেনসেক্সের নৌকা বইছিল তরতরিয়ে। কিন্তু, সেই হাওয়ায় সারবত্তার অভাব ছিল, ফলে বাজারের উচ্ছ্বাসও খানিক হলেও ধাক্কা খেয়েছে। পাশাপাশি মনে রাখা প্রয়োজন, ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নেও মোদীর প্রতিশ্রুতি ধোপে টেকেনি। অস্বীকার করার উপায় নেই, দু’একটা ছুটকো ঘটনা বাদ দিলে নরেন্দ্র মোদীর সরকার ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে এখনও কোনও ভুল পদক্ষেপ করেনি। কিন্তু এই ২০১৪ সালে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর জোর যে বেড়েছে, তা-ই বা অস্বীকার করব কেমন করে?
শিল্পমহলের হাওয়ায় কান পাতলে যে গুঞ্জন শোনা যাবে, সেটাও ইতিবাচক নয়। আশঙ্কার কালো মেঘ এখনও কাটেনি, এখনও বড় মাপের উৎপাদনের সিদ্ধান্ত করা হয়নি। কেনই বা হবে? এখনও অবধি আমাদের দেশে বড় মাপের বিনিয়োগের পথে বাধাই তৈরি হয়েছে শুধু। কী ভাবে চেন্নাইয়ে নোকিয়া-র কারখানাটি বন্ধ হয়ে গেল, ভেবে দেখুন। একই সঙ্গে এক বার খোঁজ করে নিন, বিনিয়োগের পরিবেশের নিরিখে গোটা দুনিয়ায় ভারত কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। আইন ও আইনহীনতার জটিলতার ভয়ে বড় পুঁজি ভারতে বিনিয়োগের বিষয়ে অতি সতর্ক। এই জোগানের অভাবের চক্করে দেশে চাহিদা তেমন বাড়তে পারল না। এখন শোনা যাচ্ছে, রেল থেকে প্রতিরক্ষা, এবং সম্ভাব্য অন্য সব কিছু, সব ক্ষেত্রেই নাকি বিদেশি বিনিয়োগের জন্য দরজা খুলে দেওয়া হবে। কিন্তু, সেই খোলা দরজা দিয়ে ভারতের অর্থনৈতিক সুদিন আসবে? বিদেশি পুঁজি শুধু লাভের সন্ধানেই আসে। এই দেশকে বিদেশি পুঁজির চোখে আকর্ষক করে তুলতে হলে একটা টগবগে অভ্যন্তরীণ বাজার প্রয়োজন। সেই বাজার তৈরি করে নেওয়াই নরেন্দ্র মোদীর সরকারের পরীক্ষা। ২০১৫ শেষ হওয়ার আগেই কিন্তু এই পরীক্ষার খাতা দেখা হবে।
বিমা ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগের প্রশ্নটি ইতিমধ্যেই অর্ডিন্যান্স জারি করে ফয়সলা করে নিয়েছেন অরুণ জেটলি। অনুমান করা চলে, পরিকাঠামো ক্ষেত্রে যে প্রকল্পগুলি আটকে রয়েছে, কাল না হোক পরশুর পরের দিন সেগুলিরও সুরাহা হবে। ধরে নেওয়া যেতে পারে, বিদেশি বিনিয়োগও কিছু বেশি দিন থাকার জন্যই আসবে। কিন্তু, অনেকের কাছেই নরেন্দ্র মোদী মানে শুধু এইটুকু নয়। তাঁর আবেদন অন্যত্র। এই প্রথম কোনও প্রধানমন্ত্রী এমন কিছু বিষয়ের দিকে নজর দিলেন, যেগুলো দীর্ঘ দিন ধরে আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, অথচ আমরা কখনও যেগুলোর দিকে ফিরেও তাকাইনি। এমন তিনটে বিষয়ের কথা আলাদা করে উল্লেখ করা প্রয়োজন। পরিচ্ছন্নতা, উচ্চ প্রযুক্তির নির্মাণ এবং শিশুদের যথাযথ মূল্যবোধের মাধ্যমে প্রতিপালন করা। তিনটি বিষয়ই যে অতি গুরুত্বপূর্ণ, আমরা বিলক্ষণ জানতাম। কিন্তু তার জন্য কোনও নেতা কখনও এক পাও এগোননি। কেন? আমাদের কাছে এ প্রশ্নের উত্তর ছিল। আমরা জানতাম, এর কোনওটি সংস্কৃতির প্রশ্ন, কোনওটার জন্য আমাদের দেশ বড্ড গরিব, আবার কোনওটা করা আমাদের পক্ষে অসুবিধেজনক। কিন্তু, আমাদের চেষ্টার অভাব এই প্রশ্নগুলোকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেনি। এর প্রত্যেকটাই আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বিচিত্র প্রভাব ফেলে।
নরেন্দ্র মোদী এই প্রশ্নগুলোকে নাড়াচাড়া করেছেন। এই কথাগুলো আমাদের জীবনের এত কাছাকাছি, যে সেগুলো নিয়ে কথা বললে মানুষের মনে সঙ্গে সঙ্গে দোলা লাগা স্বাভাবিক। কিন্তু, তার বিপদের দিকটা হল, এই প্রশ্নগুলোর ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করতে পারলে সেটাও মানুষ সঙ্গে সঙ্গেই টের পান। তার জন্য কোনও বিশেষজ্ঞের মতামতের প্রয়োজন নেই। কোনও তুল্যমূল্য বিচারও চাই না। পরিচ্ছন্নতা বা মহিলাদের নিরাপত্তার মতো প্রশ্নের ক্ষেত্রে কথাটা আরও বেশি সত্যি। দেশে পরিচ্ছন্নতা সত্যিই বেড়েছে কি না, সেটা বলে দেওয়ার জন্য আমরা কোনও বিশেষজ্ঞের অপেক্ষায় থাকি না। মেয়েদের নিরাপত্তা বেড়েছে কি না, সেটা বুঝে নিতেও আমরাই যথেষ্ট সক্ষম। কাজেই, এই ক্ষেত্রগুলোয় চোখে পড়ার মতো কাজ মোদীকে করতেই হবে। কিন্তু, বছরের পর বছর ধরে যে বিপুল ঘাটতিগুলোর কারণে আমাদের প্রগতি থমকে রয়েছে, নরেন্দ্র মোদী যে সেগুলোর বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন, তার কোনও প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি। ২০১৪ সাল শেষ হয়ে এল। এখনও সরকারের তরফে শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা অসংগঠিত শ্রমিকদের উন্নতির বিষয়ে কোনও প্রতিশ্রুতিও পাওয়া গেল না। স্বাস্থ্য আর শিক্ষার প্রশ্নগুলো সম্পূর্ণ অবহেলিত থেকে গেল, আর শ্রম সংস্কারের প্রশ্নটি এগোচ্ছে শম্বুকগতিতে। কোন দিকে যে যাবে, সেটাও বোঝে কার সাধ্য।
নগরায়ণ আর স্মার্ট সিটি তৈরির কথা হচ্ছে। সত্যিই যদি হয়, নিশ্চিত ভাবেই খুব বড় ব্যাপার হবে। কিন্তু, এখনও অবধি তার কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি। হয়নি এমন অনেক কিছুই। তবে বছরটার দিকে ফিরে তাকালে স্পষ্ট হবে, এখনও হতাশা আসেনি। এখনই কেউ বিশ্বাস হারাতে রাজি নন। প্রত্যেকেই চাইছেন, এই সরকার যেন সফল হয়। এবং সেই চাওয়ার তীব্রতা দেখে মনে হচ্ছে, সবাই এই সরকারকেই ভারতের ঘুরে দাঁড়ানোর শেষ আশা বলে ধরে নিয়েছেন।
ঠিক যখন রাজনৈতিক দলের প্রতিশ্রুতিতে আমাদের বিশ্বাস সম্পূর্ণ হারিয়ে যেতে বসেছিল, ঠিক যখন আমরা ধরে নিতে আরম্ভ করেছিলাম যে কখনও কোনও সরকার কোনও কাজ করবে না, তখনই ভারতের জাতীয় রাজনীতির দিগন্তে উদয় হলেন নরেন্দ্র মোদী। এবং, তিনি আমাদের সম্মিলিত আশাগুলো ফের জাগিয়ে তুললেন। অনুমান করছি, মোদীর বিরোধীরাও অনেকেই চান যে তিনি সফল হোন। আমাদের প্রত্যেকেরই একটা কার্যকর দেশ প্রয়োজন। সেটা না থাকলে গণতন্ত্র দিয়ে কী হবে?
নয়ডায় শিব নাদার বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ও সেন্টার ফর পাবলিক অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড ক্রিটিকাল থিয়োরি-র নির্দেশক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy