ভয় পেয়ো না। তারা সহদেবের ‘সমর্থনে’ সমবেত ‘হিন্দু সমাজ’। রাঁচি, অগস্ট ২০১৪। ছবি: পিটিআই
ঝাড়খণ্ডের জাতীয় স্বর্ণপদকজয়ী মহিলা শুটার তারা সহদেব রণজিৎ কোহ্লি নামে এক যুবকের প্রেমে পড়ে হিন্দু মতেই বিয়ে করেন। তাঁর অভিযোগ, বিয়ের পর তিনি জানতে পারেন, রণজিৎ আসলে রাকিবুল হাসান খান, যে তাঁকে ইসলামে ধর্মান্তরিত হওয়ার জন্য চাপ দেয়, নির্যাতন করে। ‘তারা’ কোনও ক্রমে নিজেকে মুক্ত করে থানায় সব জানালে হইহই পড়ে যায়। সংঘ পরিবারের নানান শাখা সংগঠন রাঁচিতে বন্ধ ডাকে, রাস্তায় মিছিল করে প্রতিবাদ জানায়, ভাঙচুর, লুঠপাট, অগ্নিসংযোগে লিপ্ত হয়। এ রকমই আর একটি বিক্ষিপ্ত ঘটনায় উত্তরপ্রদেশের মেরঠ জেলার সারওয়া গ্রামের এক মাদ্রাসার হিন্দু শিক্ষিকার অভিযোগ, তাঁকে অপহরণ ও গণধর্ষণের পরে ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে। তা নিয়েও দেশ জুড়ে হইচই। এই সব ঘটনাকে ‘প্রেম জেহাদ’ বা ‘রোমিয়ো জেহাদ’ আখ্যা দেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, মুসলিমরা পরিকল্পিত ভাবে, ষড়যন্ত্র করে অসহায় হিন্দু মেয়েদের ‘সস্তা ঝুটো মুক্তোর ঝলকানিতে’ প্রলুব্ধ করে বা স্রেফ ভয় দেখিয়ে, বলপ্রয়োগ করে প্রেমের অভিনয় করছে, তার পর নিকাহ্নামা পড়িয়ে বেগম বানিয়ে পর্দানশিন করে ফেলছে। এর পিছনে নাকি রয়েছে আন্তর্জাতিক চক্র, যারা অর্থ জোগাচ্ছে ধর্মান্তরকরণের এই অভিনব প্রকরণে। রীতিমত রোমহর্ষক।
গল্পটা কিন্তু চলছিল গত বেশ কিছু কাল ধরেই। প্রথম দিকে কর্নাটক ও কেরলে এই প্রেম-জেহাদের ‘ঘটনা’ প্রথম শোনা যায়। কেরলে নাকি হিন্দু ও খ্রিস্টান উভয় ধর্মের মেয়েদেরই প্রেমের অভিনয়ে ফুসলিয়ে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে, গোঁড়া ক্যাথলিক চার্চ পর্যন্ত যা ঠেকাতে সংঘ পরিবারের শাখাগুলির সঙ্গে হাত মেলায়। দলে-দলে হিন্দু মেয়েরা নাকি মুসলিম তরুণদের প্রেমে পড়ছে, তাদের বিয়ে করে ধর্মান্তরিত হচ্ছে। এটা নাকি বিস্তৃত চক্রান্ত, যার বিশদ তদন্ত করে দোষীদের চিহ্নিত করা ও শাস্তি দেওয়া জরুরি। রাস্তার আন্দোলনের চাপে, এমনকী রাজনৈতিক দলের চাপেও (কেরলে সিপিআইএম মুখ্যমন্ত্রী ভি এস অচ্যুতনন্দন এমন অভিযোগ আনেন) পুলিশ ও সিআইডি বিশদ তদন্ত করেও অভিযোগের পক্ষে কোনও প্রমাণ পায়নি, গোটা বিষয়টাকে মনগড়া ও গুজব বলেই উড়িয়ে দেয়। কিন্তু দক্ষিণ ভারত থেকে ‘লাভ জেহাদ’-এর ধুয়োটা ক্রমে আর্যাবর্তের উর্বর হিন্দু হৃদয়পুরে আমদানি হয়, শাখা বিস্তার করে।
হিন্দু মেয়েদের মুসলিম ছেলেদের প্রেমে পড়া ও পরিণামে ইসলামে ধর্মান্তরিত হওয়া ‘জেহাদ’ বলে গণ্য হবে কেন? কেনই বা ধরে নেওয়া হবে যে, প্রেম যখন জাতপাতের অবরোধ মানে না, তখন ধর্মের বা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বাধা মানবে? একই গ্রামে পাশাপাশি বাস করা হিন্দু-মুসলিম তরুণতরুণীদের স্বাভাবিক যাতায়াত, উৎসবে আনন্দে অংশীদার হওয়া, স্কুলে বা কলেজে সহপাঠী হিসাবে পড়াশোনা করা কিংবা কোচিং ক্লাসে যাওয়া-আসার পথে বা নোট নেওয়ার ফাঁকে ভাল লাগা, সলজ্জ চাহনি বিনিময় করা, দেখা করার মধ্য দিয়ে প্রেমে পড়া কি এতই অসম্ভব কোনও প্রকল্প যে, তা অস্বীকার করতে একটা বিশাল আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের গল্প ফাঁদতে হবে?
ষড়যন্ত্রবাদীরা কি আসলে বিশ্বাসই করতে পারেন না যে, তাঁদের ঘরের মেয়েরা বিধর্মী মুসলমানের প্রেমে মজতে পারে? তাতে কি তাঁদের পৌরুষে আঘাত লাগে? বিধর্মী তরুণদের তুলনায় নিজেদের অপকৃষ্ট ও অযোগ্য মনে হয়? মনে হয়, প্রেমের যুদ্ধে তাঁরা মুসলিম তরুণদের কাছে হেরে যাচ্ছেন? হিন্দু পিতৃতন্ত্রের পক্ষে এই ‘পরাজয়’ শিরোধার্য করা তো দুঃসহ। এই পিতৃতন্ত্র আজও খাপ পঞ্চায়েতের ফরমান দিয়ে ঘরের মেয়ে-বউদের অসূর্যম্পশ্যা রাখতে চায়, স্বগোত্রে বিবাহ নিষিদ্ধ করে, অসবর্ণ বিবাহে চোখ রাঙায়, দলিত যুবকদের উচ্চবর্ণীয় মেয়েরা বিয়ে করলে বা প্রেম করলে দু’জনকেই জ্যান্ত ফাঁসি দেয় বা চণ্ডীমণ্ডপে মেয়েটিকে সমবেত ভাবে ধর্ষণ ও ছেলেটিকে আধমরা করে টাঙিয়ে বা পুড়িয়ে দেয়। হিন্দু নারী হিন্দু পুরুষের, হিন্দু পিতৃতন্ত্রের একান্ত লীলাক্ষেত্র। সেখানে কোনও অনধিকার প্রবেশ বরদাস্ত হবে না। পরিবার ও সনাতন ধর্মের মর্যাদা ও সম্মান রক্ষায় প্রয়োজনে বিধর্মীর দিকে ঝোঁকা মেয়েদের হত্যা করা হবে, যাকে কাগজওয়ালারা ‘অনার কিলিং’ বলে। কিন্তু হিন্দু পুরুষের পৌরুষ কলঙ্কিত হতে দেওয়া যায় না। শাস্ত্রে বলেনি, ‘স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহ’?
লোকসভায় গোরক্ষপুর থেকে নির্বাচিত বিজেপির সাংসদ যোগী আদিত্যনাথ তাই হুঙ্কার ছেড়েছেন— ওরা যদি আমাদের একটা মেয়েকে বিয়ে করে, আমরা তবে ওদের একশোটা মেয়েকে বিয়ে করব। মুশকিল হল, হিন্দু পুরুষের বহুবিবাহ বেআইনি। যোগী-বাবা-সন্ত-মোহন্তদের ক্ষেত্রে না-হয় ভারতীয় দণ্ডবিধি সে ভাবে প্রযোজ্য হল না, কিন্তু দিনগত পাপক্ষয়ে মগ্ন সাধারণ হিন্দু গৃহস্থরা কী করে যোগীর কথা মানবে? তার চেয়ে বরং মুসলিম বিদ্বেষ লালন করা ও ছড়িয়ে দেওয়ার সহজ পথটাই বেছে নেওয়া ভাল। বিদ্বেষ ও ঘৃণা অপেক্ষাকৃত সহজ হয়, যদি তাকে নারীর সম্ভ্রম, শ্লীলতা, সতীত্ব ও যৌনতার ধারণার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নেওয়া যায়। প্রেম-জেহাদের ধারণাটা সে দিক থেকে বেশ উপযোগী। আপাতত উত্তরপ্রদেশ ও ঝাড়খণ্ডের মতো নির্বাচনমুখী রাজ্যে এর ফসল তোলার সম্ভাবনাও রয়েছে। মুজফ্ফরনগর ও সহারনপুরের দাঙ্গার মধ্য দিয়ে উত্তরপ্রদেশে যে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ঘটানো গেছে, প্রেম জেহাদের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধ চালিয়ে তা আরও ধারালো করে তোলা যাবে। ঝাড়খণ্ডেও আদিবাসী-অনাদিবাসী মেরুকরণকে চাপা দিয়ে হিন্দু-মুসলিম মেরুকরণ রাজ্য-রাজনীতির মুখ্য উপাদান হয়ে উঠবে।
কিন্তু এই প্রচার অভিযানের অন্য বিপদ রয়েছে। আর সেই বিপদ হিন্দু নারীর, যা আসতে চলেছে হিন্দু পিতৃতন্ত্রের কাছ থেকে। প্রেম জেহাদ থেকে হিন্দু নারীদের রক্ষা করার নামে তাদের উপর নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ আরও কড়া হবে। তাদের বাইরে বের হওয়া, সকলের সঙ্গে অবাধে মেলামেশা করায় নিষেধের দেওয়াল উঠবে, তাদের সদ্য-সূচিত ক্ষমতায়নের প্রকল্প মাঝপথে ধাক্কা খাবে। প্রেম-জেহাদ থেকে রক্ষা করার অজুহাতে হিন্দু নারীর প্রতি পিতৃতন্ত্রের বৈষম্য ও পীড়ন আরও বৃদ্ধি পাবে। নারীর বিরুদ্ধে ঘটতে থাকা পারিবারিক ও সামাজিক হিংসাও আরও প্রতিকারহীন হবে। পরিবারের সম্মানরক্ষার নামে ‘বিপথগামী’ মহিলাদের নিধন বাড়তে থাকবে (গত বছরে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে এই সংখ্যাটা ৮৫, এ বছর মার্চ পর্যন্ত ২৭)। ভারতীয় সমাজে নরনারীর প্রেম ও বিবাহের ক্ষেত্রে জাতপাত, ধর্ম-সম্প্রদায়ের কৃত্রিম ও পুরুষতান্ত্রিক বেড়া ভাঙার খরস্রোত রুদ্ধ হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy