মুখটা ভেটকে, হাত দুটো কনুই থেকে ভাঁজ করে মুখের সামনে ন্যালবেলিয়ে ঝুলিয়ে, কুঁজো হয়ে, হাঁটু থেকে পা জোড়া বেঁকিয়ে থপথপিয়ে হেঁটে দেখিয়ে সিকিয়োরিটি গার্ডের পোশাক পরা লোকটা বলছিল, ‘জানি জানি, মেন্টাল কেস!’ যার দিকে ইঙ্গিত করে কথাটা বলা, হুইলচেয়ারে বসা সেই বারো বছরের ঋজু অবাক হয়ে বলল, ‘লোকটা পাগল নাকি!’ শুনে হেসে গড়িয়ে পড়ল মাক্সমুয়েলার ভবনের অডিটোরিয়ামে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে থাকা খুদে দর্শকেরা। তারা ততক্ষণে জেনে ফেলেছে, ‘স্পাইনা বিফিডা’ নামে একটা রোগের দরুন ক্রাচ অথবা হুইলচেয়ার ছাড়া হাঁটতে না-পারা ঋজু আসলে ‘প্রতিবন্ধী’ নয়, বরং ওর বয়সি যে-কোনও কিশোরের মতোই দুরন্ত! যে সারা ঘর দাপিয়ে হুটোপাটি করে মায়ের বকুনি খায়, ছোট বোনের সঙ্গে খেলে আবার ঝগড়াও করে এবং কখনও একা একা খেলার সময় সুপারম্যান সাজে!
ঋজুর ভূমিকায় যে অভিনয় করছে, তার বয়স বারো নয়, প্রায় তার দ্বিগুণ! কিন্তু বাচ্চারা তাকে বন্ধু ভেবেই ফেলেছে। ফলে প্রোমোটারের ফাঁকা জমি পাহারায় থাকা ওই সিকিয়োরিটি গার্ড যখন তেড়ে এসে বলে ওদের বেরিয়ে যেতে, কারণ ‘ইয়ে প্রাইভেট প্রপার্টি হ্যায়’, তখন সামনের সারি থেকে একটা কচি গলা চেঁচিয়ে ওঠে, ‘নেহি হ্যায়’! বড়রা হেসে ওঠেন। একটা ভারিক্কি গলার টিপ্পনি শোনা যায়, ‘ইন্টারঅ্যাক্টিভ থিয়েটার’। অনেকেই হয়তো ‘মিস’ করে যান যে, ক্রমশ খেলার জায়গা হারিয়ে যেতে থাকা শহরের একদল বাচ্চা ওদের একেবারে নিজস্ব একটা সমস্যা নাটকের মধ্যে নির্ভুল শনাক্ত করল। জার্মানির ‘গ্রিপ্স থিয়েটার’ আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্যই এই: শিশু-কিশোরদের সমস্যাগুলো তুলে ধরা। অবশ্যই বড়দের বোঝার মতো করে, কিন্তু ছোটদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সমস্যাগুলোকে দেখানো।
বার্লিনের হানসা প্লাত্স-এর গ্রিপ্স থিয়েটার ষাটের দশকের শেষ দিকে রক্ষণশীলদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, যেহেতু নিয়ম মতে চলতে অভ্যস্ত জার্মান শিশুদের অস্বস্তিকর প্রশ্ন করতে শেখাচ্ছিল চলতি প্রথার বিরোধী এই থিয়েটার।
ফলকার লুডভিগ-এর গ্রিপ্স থিয়েটার প্ররোচিত ‘রোল রিভার্সাল’-এর নানা অনুষঙ্গও তাই ছড়িয়ে আছে নাট্যকর্মী জয়তী বসুর ‘সূত্রপাত’ গোষ্ঠীর ‘আমিও সুপারম্যান’ নাটকের দৃশ্যভাবনায়। আর আছে অত্যন্ত জরুরি একটা প্রসঙ্গ। তথাকথিত প্রতিবন্ধী বাচ্চাদের বাড়ির মধ্যে বা স্পেশাল স্কুল অথবা কোনও হোমের গণ্ডিতে আটকে না রেখে, জীবনের মূলস্রোতে শামিল করার ভাবনা। ১৯৭৯ সালে বার্লিনে গ্রিপ্স থিয়েটার নাট্যধারার দশ বছর পূর্তিতে যে প্রথম বিশ্ব শিশু-কিশোর নাট্যোত্সব হয়, তার জন্য ফলকার লুডভিগ এই নাটকটা লিখিয়েছিলেন ব্রিটিশ-জার্মান লেখক রয় কিফট্-কে দিয়ে। সে কালের জার্মানিতে প্রতিবন্ধীদের সম্পর্কে মানুষের চিন্তাভাবনা বদলের প্রয়োজনটা ছিল। জার্মানি-সহ সারা ইউরোপ ক্রমশ সচেতন হয়েছে, ভারতের মতো দেশে বোধটা সব স্তরে ছড়ায়নি।
অথচ খুব সাধারণ কিছু ব্যাপার। ঋজু ওর বোন পলা আর বন্ধুর সঙ্গে মাল্টিপ্লেক্স গিয়েছিল স্পাইডারম্যান দেখতে। কিন্তু ঋজু হুইলচেয়ার নিয়ে সিনেমা হলে ঢুকতে পারবে না। কারণ, সেটা রাখার জায়গা নেই। কয়েকটা সিট সরিয়ে জায়গা করতে হবে, তার জন্য আগে থেকে জানাতে হবে হল কর্তৃপক্ষকে, বা হুইলচেয়ার বাইরে রেখে ঢুকতে হবে। পলা রেগে গিয়ে বলে, কেন, এক সারি সিটের ধারে যে খালি জায়গা, সেখানেই তো দিব্যি ধরে যায় একটা হুইলচেয়ার। হলের ম্যানেজার বলেন, দমকলের বিধি মেনে যাতায়াতের ওই রাস্তা ফাঁকা রাখতে হয়। পলা প্রশ্ন করে, তা হলে ঋজু কী ভাবে বেরোবে যদি আগুন লাগে? যদি ওকে হুইলচেয়ার বাইরে রেখে যেতে হয়! ম্যানেজার বলেন, অত কথার সময় তাঁর নেই।
খুব ভাল হত, যদি বাচ্চাদের স্কুলে স্কুলে ‘আমিও সুপারম্যান’ নাটকটা দেখানো যেত। আমরাও তো অনেক সময় ভেবে ফেলি, ওরা এক ধার সে সব ‘মেন্টাল কেস’!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy