ভোগ আর উপভোগ নিয়েই তো জীবন। দেখব না, খাব না, পরব না, শুধু শুকনো মুখে বসে থেকে ‘সব অনিত্য, সব অনিত্য’ বলে ধুয়ো তুলব, তাতে বাপু কিছুই হওয়ার নয়। এক দিক থেকে দেখলে সত্যি সবই অনিত্য। ঘটিবাটি, জীবনযৌবন, সূর্যচন্দ্র, ঠাকুরদেবতা, সব। কেউ দশ বছর, কেউ একশো বছর, কেউ কয়েক কোটি বছর বাঁচবে, কিন্তু তার পর তো এক দিন না এক দিন ফুরোবেই। তাই অনিত্যের দোহাই দিয়ে ভোগ-উপভোগে লাগাম দেওয়ার দরকার নেই। ‘বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি’ সে আমাদের জন্য নয়।
বরং অনিত্য বলেই ভোগ করা উচিত। ওমর খৈয়াম মনে করুন, ‘এইখানে এই তরুতলে/ তোমায় আমায় কুতুহলে/ এ জীবনের যে কটা দিন কাটিয়ে যাব প্রিয়ে/ সঙ্গে রবে সুরার পাত্র/অল্প কিছু আহার মাত্র/ আরেকখানি ছন্দ মধুর কাব্য হাতে নিয়ে।’ যার যাতে হয়। যার যা রুচি। কারও কাব্য-খাদ্য-সুরা, কারও ফুটবল-ক্রিকেট-সিনেমা …। তবে কি না উপভোগ কেমন করে করব তা শিখতে হয়, জানতে হয়। সুরাসক্ত বা খাদ্যমত্ত হয়ে পড়লেই তো ডাক্তারখানা।
রামকৃষ্ণদেব চমত্কার একখানি গল্প বলেছিলেন। নুনের পুতুল গেছে সাগরের জল মাপতে। তা, পুতুলের দ্বারা কি আর সাগরের জল মাপা হয়? সে তো মিশেই গেল জলে। কথামৃতে এই গল্পটি যে অর্থে তিনি ব্যবহার করেছিলেন তার থেকে একটু অন্য ভাবে বিষয়টিকে গ্রহণ করতে পারি আমরা। বলতে পারি, যা উপভোগ করতে চাও, চাখতে চাও, সেইটি যেন আবার নিজে হয়ে যেয়ো না। একটু দূরত্ব যেন থাকে। নইলে উপভোগটাই মাটি। মদে মত্ত হলে সুরা পানের আনন্দ নষ্ট। সুরায় আর সুরাপায়ীতে তফাত থাকা চাই।
ব্যক্তিগত জীবনে কোনও গভীর শোকের মুখোমুখি হলে আমরা কাঁদি, ভেঙে পড়ি। নাটকে, সিনেমায় ট্র্যাজেডি দেখলে আমাদের কিন্তু বেশ লাগে, তখন ‘বেদনার আনন্দ’ উপভোগ করতে পারি। কারণ আমাদের ব্যক্তিগত শোক এতটাই গভীর যে ঘটনার সঙ্গে দূরত্বটুকু থাকে না, নুনের পুতুল যেমন জল মাপতে গিয়ে সাগরে মিশে গিয়েছিল তেমনি আমরা ব্যক্তিগত জীবনে ঘটনার সঙ্গে মিশে যাই। কিন্তু ‘ট্র্যাজেডি’ যখন দেখি তখন জানি ঘটনাটা আমার জীবনের নয়। রোমিয়ো-জুলিয়েটের মরণবিচ্ছেদ আমরা মগ্ন হয়েই দেখি, কিন্তু এক হয়ে যাই না তো। ফলে উপভোগ করতে পারি। এই কায়দাটা শিখে ফেললেই কিন্তু উপভোগে আর বিপদ নেই।
ভারতবর্ষ তো খালি ত্যাগের দেশ নয়, ভোগেরও দেশ। তবে সেই য ভোগ ‘নির্বিচার’ ভোগ নয়, ভোগের শিক্ষা থাকা চাই। প্রয়োজনে ভোগের জন্যই খানিকটা ত্যাগ করতে হবে, দূরত্ব রাখতে হবে।
আসলে রসে থাকতে গেলে নিজেকে যে খানিকটা বশে রাখতে হয় এই সত্যটা আমরা ভুলে যাই। বিগত এক মাস ধরে বাঙালি যে ফুটবল দৃশ্যে মজেছিল, তাতে কেউ কেউ নিজের উপর এই বশটুকু হারিয়ে ফেলেছিলেন। বিশ্বকাপ ফুটবল ভারত খেলে না বলে বাঙালিরা ফুটবল দেখবে না, এমন ‘অমানবিক’ অনুজ্ঞার মানেই হয় না। যাঁরা তা বলেন তাঁরা একেবারে অবুঝ। যা করতে পারি না, তা তো পারি না বলেই দেখব। আশির দশকে বাঙালি টিভিতে ভাল ফুটবল দেখেছিল বলেই তো বুঝেছিল, ময়দানে ফুটবলের নামে যা চলে তা আলুনি। সুতরাং দেখবে, হাজার বার দেখবে। রাত জাগবে। দিনে ঢুলবে। গোল দেখে নাচবে। উত্তেজনায় কাশবে। দরকার মতো দল বেছে ভরপুর সাপোর্টও করবে। বাবা ব্রাজিল তো ছেলে আর্জেন্টিনা হবে। তাতে বেশ একটা থ্রিলিং কাণ্ড ঘটবে। ব্যালকনিতে কাপড় ঝোলাবার দড়িতে নীল সাদার পাশাপাশি সবুজও উড়বে। বলের পিছু পিছু রাতজাগা চোখ ঘুমহারা হয়ে ছুটতে ছুটতে দিনের বেলায় অনেক কিছু ভুল করবে।
কিন্তু এই উপভোগেরও একটা সীমা থাকা চাই। ব্রাজিল হেরে ভূত। বাঙালির দিল টুকরো টুকরো। বিষাদ। কান্না। তাদের কালো রাজপুত্তুরের দেশের এ কী দশা! তার পর ফাইনালে আবার নীল সাদার পরাজয়। বিদায় আর্জেন্টিনা। কাগজে রঙমাখা ভেঙে পড়া বাঙালি মুখের ছবি। শূন্যদৃষ্টি।
এরই মাঝে আর্জেন্টিনার পরাজয়ে অধুনা রাজস্থাননিবাসী কলকাতার তরুণের আত্মহত্যার খবর। সংবাদে প্রকাশ, প্রিয় দলের পরাজয়ের বেদনা, তারই সঙ্গে প্রিয় দলের জন্য যে টাকা বাজিতে লাগিয়েছিলেন, সেই টাকার পঞ্চত্ব প্রাপ্তি, মাথায় দেনার পাহাড়। দুইয়ের যোগফল স্বেচ্ছায় অপমৃত্যু। এখানেই সেই সাবধানবাণী। ভোগ করো, কিন্তু নিজেকে হারিয়ে ফেলো না। উত্তেজনার আঁচ পোহাও, কিন্তু সেই আঁচে পুড়ে যেয়ো না। তুমি আমি কোন ছার! ধর্মপুত্র মানুষ রাজসভায় বসে পণ রেখে পাশা খেলতে খেলতে হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন।
তাই সাবধান: আনন্দসাগর আনন্দেই মাপো, কিন্তু নুনের পুতুল হোয়ো না।
বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy