যথা নিযুক্ত... লাদখ সীমান্তে ভারতীয় সেনা। নভেম্বর ‘৬২। গেটি ইমেজেস।
সেই কবে আরবের দার্শনিক আল বিরুনি মন্তব্য করেছিলেন, ভারতীয়দের ইতিহাসবোধ নেই! এ বার বোঝা গেল, কোন নথি গুপ্ত আর কোনটা প্রকাশ্য, সে বিষয়েও জননেতা থেকে সংবাদমাধ্যম কারও ধারণা স্পষ্ট নয়। নইলে হেন্ডারসন ব্রুকস রিপোর্ট নিয়ে আজও শোরগোল হয়!
রিপোর্টটি বহু আগেই ফাঁস হয়ে অস্ট্রেলীয় সাংবাদিক নেভিল ম্যাক্সওয়েলের হাতে পৌঁছেছিল। ‘ইন্ডিয়া’জ চায়না ওয়র’ বইয়ে ওই নথি থেকে তিনি অনেক কিছু উদ্ধৃত করেছিলেন। সে বই না হয় চল্লিশ বছর আগের! কিন্তু তিনি যে গত ফেব্রুয়ারিতেই নথিটি ইন্টারনেটে আপলোড করে দিয়েছেন, নেতারা সে খবরও রাখেন না?
পাঁচ দশকের পুরনো নথি। ১৯৬২ সালে চিন-ভারত যুদ্ধে ভারত শোচনীয় ভাবে হারল কেন তা নিয়ে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হেন্ডারসন ব্রুক্স আর ব্রিগেডিয়ার প্রেম ভগতের অন্তর্তদন্ত। ক্ষেপণাস্ত্র আর স্পাই স্যাটেলাইটের যুগে আজ তার সামরিক মূল্যও নেই। তবু, বাজার গরম করতে রাজনীতিকরা থেকে থেকে দলিলটিতে মৃতসঞ্জীবনী ছিটিয়ে থাকেন।
যেমন, নতুন প্রতিরক্ষামন্ত্রী অরুণ জেটলি। গত ইউপিএ আমলে প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনি সাফ জানিয়েছিলেন, দলিল প্রকাশ ‘সম্ভব নয়। বিষয়টি সংবেদনশীল, সামরিক দিক দিয়ে আজও তাত্পর্যপূর্ণ।’ বিরোধী বিজেপি তখন তোপ দেগেছিল। রাজ্যসভায় দলনেতা অরুণ জেটলি প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘প্রকাশ করা যাবে না কেন? হারের কারণ কী ছিল জানতে হবে। হিমালয়প্রমাণ ভুল, না নেহরুর ভুল?’ প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে তিনিই ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়েছেন।
আবার ঠিক ততটাই ঘুরে গিয়েছে কংগ্রেসও। সে দলের মুখপাত্র, ভূতপূর্ব তথ্য সংস্কৃতি মন্ত্রী মণীশ তিওয়ারির বোধোদয়: রিপোর্টটি প্রকাশ করাই উচিত। তামাদি হয়ে যাওয়া একটা ফৌজি নথি নিয়ে এমন অলীক কুনাট্য এই ভারতের মহাপলিটিশিয়ানদের সাগরতীরেই সম্ভব!
প্রতিরক্ষামন্ত্রী এত দিনে বিতর্কিত রিপোর্টটি পড়ে ফেলেছেন, তাঁর অবস্থান বদলেই প্রমাণিত। ঘটনা হল, প্রধানমন্ত্রী শব্দটি রিপোর্টে উল্লিখিত হয়েছে দু’বার। প্রথম বার অষ্টম পৃষ্ঠায়: ৯ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর অফিসে প্রতিরক্ষামন্ত্রী, সেনাপ্রধান, বিদেশ সচিব ও গোয়েন্দাপ্রধানের বৈঠক। দ্বিতীয় বার ৯৫ পৃষ্ঠায়: ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে ফের বৈঠক। এ দুটি কারণে নেহরুর ঘাড়ে বিপর্যয়ের দায় চাপানো যায় না।
রিপোর্টে নেহরুর ‘ফরওয়ার্ড পলিসি’র কথা আছে। আকসাই চিন হাতছাড়া হওয়ার পর সেনাবাহিনিকে নির্দেশ দেওয়া হয়, শিবির তৈরি করে ম্যাকমেহন লাইনের দিকে এগিয়ে যাও। লাদাখের চুসুল, দৌলত বেগ ওল্ডিতে ভারতীয় সেনা ৩২টি নতুন শিবির করে। অরুণাচলে ঢোলা, ওয়ালং, নামখা চুতে তৈরি হয় সেনাশিবির। রাস্তা নেই, এক একটি শিবিরে মেরেকেটে পাঁচ ছয় জন সৈন্য, চিনারা ঘিরে ফেললে পালানোই একমাত্র পথ। ‘ফরওয়ার্ড পলিসি চিনাদের সরাতে জরুরি ছিল। কিন্তু দরকারি ব্যবস্থা না করেই সেনা দফতর সেটি চালু করে।’ রিপোর্ট জানাচ্ছে, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী থেকে গোয়েন্দাপ্রধান, বিদেশ সচিব সকলে সেনা অফিসারদের বলেছেন, এগিয়ে যান। চিন পাল্টা আক্রমণ করবে না। সেটা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ, না প্রতিরক্ষামন্ত্রী কৃষ্ণ মেনন আগ বাড়িয়ে বলেছিলেন? উত্তর নেই।
ম্যাক্সওয়েল অবশ্য সহজ রাস্তায়। গত চার দশক ধরে তাঁর ভাষ্য: নেহরুর ফরওয়ার্ড পলিসির জন্যই চিন আক্রমণ করেছিল, অতএব তিনিই দায়ী, এবং সেই কারণেই ভারত রিপোর্ট প্রকাশ করে না। মুশকিল, ভারতীয় রাজনীতিক এবং সাংবাদিকরাও এই মহাভাষ্য শিরোধার্য করেন! রিপোর্টটি আপলোড করে ম্যাক্সওয়েল আমাদের কৃতজ্ঞতাভাজন, অবশ্যই। কিন্তু যে সাংবাদিক ‘চতুর্থ সাধারণ নির্বাচনই ভারতের শেষ নির্বাচন, গণতন্ত্র এ দেশে সম্ভব নয়’ বা ‘উনিশ শতকে তিব্বত চিনের অধীনে ছিল’ গোছের ভাষ্য রচনা করেছিলেন, তাঁর ইতিহাসজ্ঞান বা রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, কোনওটাকেই বিনা প্রশ্নে মেনে নেওয়া যায় কি?
রিপোটের্র্ ১১২ থেকে ১৫৭ নম্বর পৃষ্ঠা নেই। ম্যাক্সওয়েলের ‘সোর্স’ ওই ৪৫ পৃষ্ঠা কেটে তাঁকে নথিটি দিয়েছিল। পড়লে স্পষ্ট হয়, সেখানে অরুণাচলে সেনাবাহিনির স্ট্র্যাটেজিক অবস্থান লেখা ছিল। বাকিটা, কোথায় নিজেদের অহং-এর কারণে অফিসারদের মধ্যে সমন্বয় থাকেনি, হিমালয়ে তিন দিনের দূরত্বকে দিল্লিতে বসে-থাকা সেনাকর্তারা এক দিনের পথ ঠাউরেছেন, এই সব।
মনে রাখা দরকার, সেনাপ্রধান জেনারেল জয়ন্তনাথ চৌধুরী ব্রুক্স এবং ভগতকে তদন্তের পাঁচটি দিক স্থির করে দিয়েছিলেন: প্রশিক্ষণ, অস্ত্রশস্ত্র, কম্যান্ড সিস্টেম, সেনাদের শারীরিক পটুত্ব ও বাহিনির ওপর কম্যান্ডারদের প্রভাব। প্রমথ চৌধুরীর এই ভাইপো অত্যন্ত সংবিধানমনস্ক ছিলেন। দেশজোড়া হট্টগোলে বিচলিত না হয়ে স্থির করেছিলেন, তদন্ত থাকবে ফৌজি কাঠামোর মধ্যে। ‘কে দায়ী’ গোছের ডাইনি শিকার বা রাজনৈতিক ওপরওয়ালাদের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত, সে সব নিয়ে একটি শব্দও নয়। তিনি যদি এই কাঠামো স্থির না করতেন, গণতন্ত্র টিঁকত?
এবং, কোনও প্রতিরক্ষামন্ত্রীর পক্ষে সরকারি ভাবে এই রিপোর্ট প্রকাশ সম্ভব? সিভিলিয়ানের ধর্ম, প্রশ্ন তোলা। ফৌজের ধর্ম, প্রশ্নহীন আনুগত্যে শৃঙ্খলা বজায় রাখা। প্ররোচনায় পা না দিয়ে যে যার স্বধর্মে স্থিত থাকলেই ভারতীয় গণতন্ত্রের মঙ্গল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy