২০১৪ লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল নরেন্দ্র মোদীর উত্থানকে প্রশ্নাতীত স্বীকৃতি দিল। তাঁর নেতৃত্বে বিজেপি যে জয় লাভ করল, চাইলে কোনও শরিক ছাড়াই তাদের পক্ষে সরকার গঠন করা সম্ভব। ২০০২-এর গুজরাত দাঙ্গার দায় নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে প্রবল প্রচার সত্ত্বেও তিনি বডোদরা এবং বারাণসীতে জয়ী বডোদরায় বিপুল ভোটে। প্রশ্ন হল, ভারতীয় রাজনীতিতে মোদী কীসের প্রতীক?
প্রথমত, নরেন্দ্র মোদী দুর্নীতিমুক্ত সুশাসনের ভিত্তিতে যে শক্তিশালী ভারত গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তাতে ভোটাররা বিপুল সাড়া দিয়েছেন। লক্ষণীয়, বিজেপি দীর্ঘ কাল যে সব বিতর্কিত বিষয় নিয়ে প্রচার করে এসেছে, নির্বাচনী প্রচারের গোড়ার দিকে তিনি সেগুলি নিয়ে কথাই বলেননি। তাঁর বক্তৃতায় রামমন্দির, সংবিধানের ৩৭০ ধারা বা অভিন্ন দেওয়ানি আইনের কথা শোনা যায়নি। তিনি দেশের উন্নয়ন নিয়ে, সুশাসন নিয়ে কথা বলেছেন। সেই প্রচার সাধারণ মানুষের মনে নাড়া দিয়েছে, তাঁরা মোদীকে ভোট দিয়েছেন।
দ্বিতীয়ত, ইউপিএ সরকারের সম্পর্কে মানুষের বিপুল ক্ষোভ জমা হয়েছিল। মোদী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি বিজয়ী হলে একটি শক্তিশালী, কার্যকর সরকার গঠন করবেন। দৃশ্যতই মানুষ সেই প্রতিশ্রুতি বিশ্বাস করেছেন।
তৃতীয়ত, ২০১৩ সালের মুজফফরনগরের দাঙ্গা সম্ভবত হিন্দু ভোটারদের প্রভাবিত করেছে, বিশেষত উত্তর ভারতের হিন্দি বলয়ে। হিন্দুরা ভয় পেয়েছেন, কারণ উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতাসীন সমাজবাদী পার্টি তাঁদের নিরাপত্তা দেয়নি। নরেন্দ্র মোদী যাঁকে উত্তরপ্রদেশের প্রধান সেনাপতি করে পাঠিয়েছিলেন, সেই অমিত শাহ এই পরিস্থিতিকে নির্ভুল ভাবে কাজে লাগিয়েছেন।
চতুর্থত, মোদীর জয় দেখিয়ে দিয়েছে, তাঁর প্রতিপক্ষ ২০০২-এর গুজরাত দাঙ্গাকে যতটা গুরুতর ব্যাপার বলে দেখাতে চেয়েছিলেন, দেশের তরুণ ভোটদাতারা তাকে সেই গুরুত্ব দেননি। ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংস বা ২০০২ সালে গুজরাতের দাঙ্গা, কোনওটাই ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁদের কাছে বিশেষ প্রাসঙ্গিক নয়। মোদী দুর্নীতি এবং অপশাসন দূর করার যে স্লোগান দিয়েছেন, সেটাই তাঁদের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সেই কারণেই তাঁরা বিজেপি’র নায়ককে অকৃপণ ভাবে ভোট দিয়েছেন। কার্যত গোটা দেশ জুড়ে এটাই ঘটেছে।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এই ভোট কি সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্যবাদকে জয়ী করল? আমাদের দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন না পেয়েও কোনও দল বা প্রার্থী জয়ী হতে পারেন। তবে এটা পরিষ্কার যে, দেশ জুড়ে মোদীর সপক্ষে একটা প্রবল হাওয়া তৈরি হয়েছে, যে হাওয়ায় শ্রেণি, জাতপাত বা অন্যান্য বিভাজনরেখাগুলি মুছে গেছে। বিহার ও উত্তরপ্রদেশে বিজেপি’র অপ্রত্যাশিত সাফল্য দেখে মনে হয়, মানুষ ভোট দেওয়ার সময় জাতপাতের নিয়মে চালিত হননি। সেই অর্থে বলা চলে, মোদী জাতপাতভিত্তিক নির্বাচনের রাজনীতিটাকে ভেঙে দিয়েছেন।
মোদীর উত্থানে তাই ভারতকে একটা দেশ, একটা জাতি হিসেবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে। এটা তাত্পর্যপূর্ণ যে প্রচারপর্বের শেষ দিকে তিনি বিতর্কিত বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনার কথা তুলেছেন। তাঁর নির্বাচনী সাফল্য দেখিয়ে দিচ্ছে, দেশের মানুষ এই বিষয়গুলি নিয়ে বিতর্ক চান। সংবিধানের ৩৭০ ধারায় কাশ্মীরকে যে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে তা বজায় রাখা উচিত কি না, সংখ্যাগরিষ্ঠের আবেগকে স্বীকৃতি দিয়ে রামমন্দির তৈরি করা দরকার কি না, অন্য নানা উদার গণতান্ত্রিক দেশের মতো ভারতেও অভিন্ন দেওয়ানি আইন প্রবর্তন করা বিধেয় কি না এ সব প্রশ্ন নিয়ে সওয়াল-জবাবে মানুষের আপত্তি নেই। পূর্ববর্তী শাসকরা ভোটব্যাঙ্ক হারানোর ভয়ে সরাসরি এই বিষয়গুলির মুখোমুখি দাঁড়াতে চাননি। এই সব প্রশ্নে জাতীয় বিতর্কের পথ খুলে মোদী রাজনৈতিক আলোচনার পরিসরটাকে পালটে দিয়েছেন।
সুতরাং, ২০১৪’র নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদীর জয়ের পিছনে অনেকগুলি ব্যাপার সমবেত ভাবে কাজ করছে। এক দিকে ক্ষমতাসীন ইউপিএ’র প্রতি মানুষের বিপুল বিরাগ জমা হয়েছিল, বিশেষত বিভিন্ন কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ে মনমোহন সিংহের দ্বিতীয় দফার সরকার সমস্ত জনসমর্থন হারিয়েছিল। অন্য দিকে, মোদী দেশের ভোটদাতাদের বিশ্বাস করাতে পেরেছেন যে, বিভিন্ন ধরনের বিভাজনের ওপর নির্ভরশীল ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতির বদলে তিনি একটা জাতীয় লক্ষ্য নির্মাণের কাজে নেতৃত্ব দিতে সমর্থ। সুতরাং এটা যেমন নরেন্দ্র মোদীর জয়, তেমনই ভারতীয় গণতন্ত্রেও বিরাট সাফল্য।
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy