সঙ্গী। শিবসেনার কর্ণধার বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ ও উদ্ধব ঠাকরে। মুম্বই, সেপ্টেম্বর ২০১৪। ছবি: পিটিআই
মহারাষ্ট্রে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে গৈরিক ব্রিগেড যে কংগ্রেস এবং ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টির (এনসিপি) ক্ষমতাসীন জোটকে পর্যুদস্ত করবে, সেটা এখন প্রায় সবাই ধরেই নিচ্ছেন। ২০১৪’র লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস-এনসিপি মাত্র ছ’টি আসন পেয়েছে, বিজেপি-শিবসেনা বাকি ছত্রিশটি। বিধানসভা নির্বাচনের ফল এর থেকে বিরাট আলাদা হবে, এমনটা মনে করার কোনও কারণ নেই। এবিপি নিউজ-এসি নিয়েলসেন-এর এক সমীক্ষা অনুসারে, বিজেপি-শিবসেনা জোট এ বারের নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে পারে। কিন্তু প্রাক্নির্বাচনী সমীক্ষার ফলাফল আর ভোটের ফলাফল, দুইয়ের মধ্যে অনিশ্চয়তা আছেই, পেয়ালা ও ঠোঁটের মধ্যে যেমন।
১৯৯২-৯৩ সালের মুম্বই দাঙ্গা এবং সন্ত্রাসবাদী বিস্ফোরণের প্রেক্ষিতে ১৯৯৫-এর বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি-শিবসেনা হিন্দুত্বের মঞ্চে দাঁড়িয়ে লড়াই করে জয়ী হয়েছিল। এ বার পরিস্থিতি আলাদা। বস্তুত, হিন্দুত্ব দিয়ে যথেষ্ট ভোটার টানা যায়নি বলেই ১৯৯৯, ২০০৪ এবং ২০০৯, পর পর তিনটি বিধানসভা নির্বাচনে সফল হয়ে কংগ্রেস-এনসিপি টানা পনেরো বছর রাজ্যে ক্ষমতায় আছে। হিন্দুত্ব দিয়ে কাজ হবে না বুঝেই বিজেপি সামাজিক বিভাজনকে কাজে লাগিয়ে ভোটব্যাঙ্ক তৈরির চেষ্টা শুরু করে, যার নাম সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। ওবিসিদের মধ্যে নিজের প্রতিপত্তি বাড়ায় তারা এবং রামদাস আঠবলে-র রিপাবলিকান পার্টি অব ইন্ডিয়া (আরপিআই-এ)’কে জোটের শরিক করে দলিতদের একটি অংশের সমর্থন জোগাড় করে। পাশাপাশি বিজেপি জোটে নিয়ে আসে মহাদেব জানকর-এর রাষ্ট্রীয় সমাজ পার্টিকেও (আরএসপি), যে দলটির সামাজিক ভিত্তি হল পশুচারণের বৃত্তিধারী ধনগর গোষ্ঠী। প্রধানত কৃষ্ণা নদীর অববাহিকা তথা পশ্চিম মহারাষ্ট্রের কৃষকদের দল স্বাভিমানী শেতকরী সংগঠনের (এসএসএস) দিকেও হাত বাড়িয়ে দেয় বিজেপি। আবার, মরাঠা সমাজের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে শিব সংগ্রামকেও (এসএস) শরিক করে নেয়। এই নতুন সহযোগীদের নিয়ে বিজেপি-শিবসেনা ২০১৪’র লোকসভা নির্বাচনে লড়াই করে ও সফল হয়। এই বৃহত্তর জোটের প্রধান কারিগর ছিলেন গোপীনাথ মুন্ডে। তিনি ওবিসি গোষ্ঠীর মানুষ, বরাবরই সঙ্ঘ পরিবারের বাইরে ছিলেন, এবং তিনিই ছিলেন মহারাষ্ট্রে বিজেপির একমাত্র জননেতা। তাঁর আকস্মিক প্রয়াণ এই জোটকে অবশ্যই সমস্যায় ফেলেছে। এখন রাজ্যে বিজেপির অনেক ম্যানেজার আছেন, যথার্থ নেতা কেউ নেই।
২০১২ সালে বাল ঠাকরের মৃত্যুর পরে শিবসেনারও অনেকটা একই অবস্থা। ১৯৮৪ সাল থেকে বালাসাহেবই ছিলেন বিজেপি-শিবসেনা জোটের চালকের আসনে। ১৯৯৫-৯৯ প্রথম বার গেরুয়া জোটের সরকার চলার পরে বিজেপি আর ছোট শরিক হয়ে থাকতে চায়নি, কিন্তু শিবসেনার নায়ক বাল ঠাকরে জোটের নেতৃত্ব ছাড়তে নারাজ ছিলেন। ১৯৯৯ নির্বাচনে আলাদা আলাদা ভাবে লড়েও কংগ্রেস-এনসিপি পরে জোট সরকার গঠন করে। শিবসেনা ও বিজেপির মধ্যে মর্যাদার লড়াইয়ের ফলেই এই জোট সম্ভব হয়েছিল। বিজেপির প্রয়াত নেতা প্রমোদ মহাজন আমাকে বলেছিলেন, ‘শিবসেনা যদি গোপীনাথ মুন্ডেকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিত, তা হলে এনসিপি’কে নিয়ে আমরা সরকার গড়তে পারতাম।’ এ বারের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি আসন ভাগাভাগির সূত্রটি বদলাতে বদ্ধপরিকর। পুরনো ফর্মুলায় সেনা ১৭১টি আসনে প্রার্থী দিতে পারবে, বিজেপি মাত্র ১১৭টিতে।
বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ সতর্ক ভঙ্গিতে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, দু’দশকের পুরনো সূত্র তাঁরা আর মেনে নেবেন না। এবং তিনি বলেছেন, বিজেপি যদি শিবসেনার চেয়ে বেশি আসনে জয়ী হয়, তা হলে তারা মুখ্যমন্ত্রীর পদের জন্য দাবি জানাবে। রাজ্য বিজেপির মুখপাত্র মাধব ভান্ডারিও জানিয়েছেন, দলের কর্মীরা আর একেবারেই ছোট শরিক হয়ে থাকতে চান না এবং তাঁর মতে কর্মীদের এই দাবি ‘যথাযথ’। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের কর্মীদের মধ্যে এই ধারণা অত্যন্ত প্রবল যে, (শিবসেনার সঙ্গে) জোট থাকার ফলে মহারাষ্ট্রে আমাদের দলের প্রসার বাধা পেয়েছে। মাত্র ১১৭টি বিধানসভা আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ পেয়ে এসেছি আমরা, তার মানে হল— রাজ্যের মাত্র চল্লিশ শতাংশ এলাকায় আমরা আটকে আছি। জোটে নতুন দলকে স্থান দেওয়ার ফলে আসন রফা নিয়ে সমস্যা আরও বেড়েছে। তবে অমিত শাহ জানিয়ে দিয়েছেন, বিজেপি-শিবসেনা জোট নিয়ে কোনও অনিশ্চয়তা নেই। ৪ সেপ্টেম্বর মুম্বই সফরে গিয়ে তিনি শিবসেনার নায়ক উদ্ধব ঠাকরের সঙ্গে দেখা করেন। প্রয়াত বালাসাহেব ঠাকরের প্রভূত স্তুতির পরে তিনি কিন্তু এটাও বলেছেন যে, নির্বাচনে বিজেপি ও শিবসেনা সমান মর্যাদার দুই শরিক হিসেবেই লড়াই করবে। তাঁর ভাষায়, এই জোটে কোনও বড়ভাই-ছোটভাই-এর ব্যাপার নেই। পরে পার্টির এক সম্মেলনে তিনি ঘোষণা করেন, মহারাষ্ট্রে বিজেপি ‘সুশাসন’ আনবে।
লোকসভা নির্বাচনে বিপর্যয়ের পরে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য কংগ্রেস-এনসিপি সরকার সরকারি চাকরিতে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মরাঠাদের জন্য ১৬ শতাংশ এবং মুসলিমদের জন্য ৫ শতাংশ সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। এর ফলে মহারাষ্ট্রে সংরক্ষণের সামগ্রিক মাত্রা ৭৩ শতাংশে পৌঁছে যাবে। লক্ষণীয়, মরাঠাদের মধ্যে কুণবী নামে একটি ওবিসি গোষ্ঠীর জন্য সংরক্ষণ আগে থেকেই চালু আছে। রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ৩১.৫ শতাংশ মরাঠা। তাঁরা প্রধানত কৃষিজীবী এবং রাজ্য রাজনীতিতে বিশেষ প্রভাবশালী। রাজ্যের সমস্ত প্রধান রাজনৈতিক দলই তাঁদের জন্য সংরক্ষণের নীতি সমর্থন করেছে। শিবজির বংশধর সম্ভাজীরাজে ছত্রপতির নেতৃত্বে ২৩টি সংগঠনের গোষ্ঠী মরাঠা আরক্ষণ মহামোর্চা মরাঠাদের জন্য সংরক্ষণের দাবি জানিয়ে রাজ্য সরকারের কাছে চরমপত্র দাখিল করেছিল। সম্ভাজীরাজে ঘোষণা করেছিলেন, ‘মরাঠা জনগোষ্ঠীগুলি লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস-এনসিপি জোটের প্রতি সমর্থন বা বিরোধিতার কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি। সরকার যদি সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত না নেয়, বিধানসভা নির্বাচনে আমরা তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেব।’ দেখা যাক, শেষ মুহূর্তে মরাঠাদের জন্য বাড়তি সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে ক্ষমতাসীন জোট ভোটে কতটা ফসল তুলতে পারে।
মরাঠা জনগোষ্ঠীই ছিল কংগ্রেসের সামাজিক ভিত্তি, তার কল্যাণেই মহারাষ্ট্র ছিল এই দলের দুর্গ। এখন কংগ্রেস আর এনসিপি’র মধ্যে সামাজিক ভিত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে টানাপড়েন চলছে। এই টানাপড়েনের প্রেক্ষাপটটি দীর্ঘদিনের। এনসিপি’র নেতা শরদ পওয়ার কংগ্রেস-বিরোধিতার রাজনীতি করে নিজের প্রতিপত্তি বাড়িয়েছেন। কংগ্রেস-বিরোধী শক্তিগুলিকে একত্র করেই তিনি ১৯৭৮ সালে মহারাষ্ট্রের সর্বকনিষ্ঠ মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। ১৯৮৬ সালে তিনি কংগ্রেসে প্রত্যাবর্তন করেন এবং রাজ্যে কংগ্রেস-বিরোধী পরিসরটি দখল করে শিবসেনা। ১৯৯৯ সালে পওয়ার সনিয়া গাঁধীকে ‘বিদেশিনি’ বলে দল থেকে বহিষ্কৃত হন, তাতে বিজেপির সুবিধে হয়। এই মরাঠা কুলপতির প্রধান সমর্থন-ভিত্তি পশ্চিম মহারাষ্ট্রে, বিশেষত কৃষ্ণার অববাহিকায়। ২৮৮ সদস্যের বিধানসভায় বরাবর তাঁর হাতে থেকেছেন পঞ্চাশ থেকে আশি জন বিধায়ক। তিনি মহারাষ্ট্রের জ্যোতি বসু হতে পারেননি, এখন তৃণমূল কংগ্রেস হওয়ার চেষ্টা করছেন। এনসিপি’র লক্ষ্য মরাঠা ভোটব্যাঙ্ককে সংহত করা, সে জন্য রাজ্যের প্রভাবশালী সমবায় প্রতিষ্ঠান, চিনিকল, অর্থ লগ্নি সংস্থা, কৃষিপণ্য বিপণন সংস্থা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণে রাখা। ধনগর সমাজ আরক্ষণ সংঘর্ষ কৃতি সমিতিও (ডিএসএএসকেএস) ধনগরদের জন্য তফসিলি জনজাতি হিসেবে সংরক্ষণের সুবিধে চাইছে। ডিএসএএসকেএস-এর আহ্বায়ক নবনাথ পাডলকর বলেছেন, ধনগরদের দীর্ঘকাল যাবৎ সংরক্ষণ থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে। তাঁর বক্তব্য, ‘ছয় দশক ধরে আমাদের বিরুদ্ধে এই অন্যায় জারি থেকেছে।’ ওঁরা এ বার প্রতিকার চান। ধনগর কমিউনিটি এসটি কোটার দাবিতে রাজ্যব্যাপী আন্দোলন করেছে। শরদ পওয়ার সে আন্দোলন সমর্থন করলেও তাঁর দলেরই বিভিন্ন জনজাতি গোষ্ঠী বিরোধিতা করেছে। এনসিপি’র এক জনজাতীয় নেতার বক্তব্য, ‘আমরা ধনগরদের জন্য সংরক্ষণের বিরোধী নই, কিন্তু আমরা চাই, তফসিলি জনজাতির সামগ্রিক সংরক্ষণের অংশ হিসেবেই তাদেরও কোটা রাখা হোক, স্বতন্ত্র ভাবে নয়।’ ধনগরদের আলাদা এসটি কোটা দেওয়ার প্রশ্নে কংগ্রেস কোনও স্পষ্ট অবস্থান নিতে পারছে না, কারণ তারা রাজ্যের জনজাতীয় অঞ্চলে জনসমর্থন হারাতে চায় না।
মহারাষ্ট্রে বিধানসভা নির্বাচন নিয়ে তাই বেশ একটা আগ্রহ এবং উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। পুরনো জোটগুলির শরিক দলেরা— বিজেপি-শিবসেনা এবং কংগ্রেস-এনসিপি, দুই শিবিরই বেশ অস্বস্তিতে। দু’দিকেই সর্বভারতীয় দলগুলি বড়ভাইয়ের ভূমিকা নিতে চায়, কিন্তু আঞ্চলিক দলগুলিও নিজেদের দাবি ছাড়তে নারাজ। দ্বন্দ্বটা আদর্শ, কর্মসূচি বা ইস্তাহার নিয়ে নয়, সামাজিক ভিত্তি সংহত করা নিয়েই টানাপড়েন চলছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy