পশ্চিমবঙ্গের সদর-মফস্সলের থানাগুলির প্রবেশ পথে অতঃপর একটি নোটিস ঝুলাইয়া দিলে মন্দ হয় না: ‘অভিযোগ দায়ের করিবার পূর্বে দয়া করিয়া অভিযুক্তের রাজনৈতিক পরিচয় যাচাই করিয়া লউন। তিনি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে শাসক দলের সহিত যুক্ত থাকিলে অহেতুক অভিযোগ লিখাইতে চাহিয়া নিজের সময়, পুলিশের শ্রম ও সরকারের অর্থ অপচয় করিবেন না।’ অনুব্রত মণ্ডল হইতে তাপস পাল, আর অম্বিকেশ মহাপাত্র হইতে সুমন মুখোপাধ্যায়, প্রত্যেকেই নিশ্চয়ই এমন নোটিসের যাথার্থ্যের পক্ষে সাক্ষ্য দিবেন। তৃণমূল কংগ্রেসের ছত্রছায়ায় আশ্রিত কাহারও বিরুদ্ধে যাহাতে অভিযোগ জমা না পড়ে, পড়িলেও যাহাতে সেই অভিযোগের কোনও সুরাহা না হয়, তাহা নিশ্চিত করিতে পুলিশ অবশ্য সাধ্যাতীত চেষ্টা করে। নদিয়ার পুলিশ সুপার অর্ণব ঘোষ যেমন তিন মাসেও তাপস পালের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া দুই পৃষ্ঠার অভিযোগপত্রটি খতাইয়া দেখিয়া উঠিতে পারেন নাই। তবুও কিছু অভিযোগ কী ভাবে যেন আদালতের আওতায় চলিয়া যায়। তখনই সরকারের বিপদ। তাপস পালের মামলায় যেমন হইল। বিচারপতি দীপঙ্কর দত্তের সিঙ্গল বেঞ্চের রায় উল্টাইয়া দিতে সরকারের শূন্য রাজকোষ হইতে দশ লক্ষ টাকা গলিয়া গেল, তবু হুকুম কার্যত নড়িল না। অনুব্রত মণ্ডলকে বাঁচানোর চেষ্টাতেও করদাতাদের কিছু গচ্চা যাইবে। থানার সিংহদুয়ারে নোটিসটি ঝুলাইয়া দিলে এই সব বালাই চুকিত।
এহেন নোটিসে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হইবে, সেই আশঙ্কাও নাই। নির্লজ্জ পক্ষপাত এখন এমনই প্রকাশ্য যে তাহাকে লুকাইবার চেষ্টাও হাস্যকর। তাপস পাল নামক ব্যক্তিকে বাঁচাইবার জন্য সরকারের সর্বশক্তিতে ঝাঁপাইয়া পড়া সেই নির্লজ্জতার প্রমাণ। তিনি শাসক দলের সাংসদ হইতে পারেন, কিন্তু সরকারের সহিত তাঁহার কী সম্পর্ক? দল তাঁহার পার্শ্বে দাঁড়াইতে পারে, তাঁহার ভাই-বেরাদররাও বিলক্ষণ পারেন, কিন্তু সরকার এই দুই গোত্রের কোনওটিতেই পড়ে না। তবুও, সরকার তাঁহাকে বাঁচাইতে মরিয়া। অনুব্রত, মনিরুলকে বাঁচাইতেও। চক্ষুলজ্জার ন্যায় কিছু বালাই বর্জন করিতে পারিলে কত কিছু সম্ভব, সরকার প্রতি দিন তাহার নব নব উদাহরণ সৃষ্টি করিতেছে।
সরকার বা প্রশাসনের চক্ষুলজ্জা থাকিলে অবশ্য রোশেনারা মিশ্রকে কিঞ্চিৎ কম হয়রান হইতে হইত। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরবিজ্ঞানের এই শিক্ষিকার বেশ কয়েকটি অপরাধ— তাঁহার পিতার নাম সূর্যকান্ত মিশ্র; তিনি এখনও শঙ্কুদেব পণ্ডার নিকট বশ্যতা স্বীকার করেন নাই; তিনি রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ ক্যাম্পাসে কোনও অনাচার দেখিলে তাহার প্রতিবাদ করেন। অপরাধগুলির কোনওটিই আদালতগ্রাহ্য না হওয়াতেই সম্ভবত শাসকদের তাঁহার বিরুদ্ধে হার ছিনতাইয়ের অভিযোগ সৃষ্টি করিতে হইয়াছে। যে পুলিশ তাপস পালের বিরুদ্ধে যাবতীয় প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও ৮৫ দিনে এফআইআর করিয়া উঠিতে পারে নাই, সেই পুলিশই রোশেনারার বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়ামাত্র এফআইআর করিয়া তদন্তে নামিয়া পড়িয়াছে। অনুমান করা চলে, রাজ্যে শাসকদের বিরুদ্ধে কলরবের মাত্রা কিছু কম থাকিলে এত দিনে রোশেনারার হাজতবাসেরও ব্যবস্থা হইত— অম্বিকেশ মহাপাত্রের যেমন হইয়াছিল। কিন্তু, তাপস পাল আর রোশেনারা মিশ্রের ক্ষেত্রে পুলিশ যে সম্পূর্ণ দুই ভঙ্গিতে, দুই বেগে কাজ করিবে, তাহাতে আর কেহ বিস্মিত হন না। পরিবর্তিত পশ্চিমবঙ্গে দল আর প্রশাসনে কোনও প্রভেদ বাঁচিয়া নাই। আইন আর নিজের পথে চলিতেছে না, এমন কথা বলিলে অবশ্য মস্ত ভুল হইবে। আইন নিজের পথেই আছে, কিন্তু এই রাজ্যে এখন আইনের দুইটি পথ। কাহার জন্য আইন কোন পথে চলিবে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেটুকু স্থির করিয়া দিতেছেন মাত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy