জীবনের উনিশ থেকে তেইশ বছর জেলবন্দি ছিলেন মীনাক্ষী সেন (১৯৫৪-২০১৪)। সে সময়ে স্লোগানে ঘোষণা ছিল বন্ধন মুক্তির, তাই বন্দিত্বও ছিল নাগপাশের মতো সুদৃঢ়। বিনা বিচারে আটক রাখা সত্তর দশকে মান্য আইনি ব্যবস্থা। চিড়িয়াখানায় আসা পরিযায়ী পাখিরাও এড়িয়ে চলত জেলের আকাশ। মীনাক্ষীর জিজ্ঞাসা— ওরাও কী করে চিনে ফেলল ওই জেলখানাকে, যেখানে নিত্য চিত্কার, আর্তনাদ, অভিসম্পাত!
এই জগতে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা বড়সড় এক আত্মজীবনীর জন্ম দিতে পারত। আর সত্তর দশকের পড়ন্ত বেলায়, জেল-জীবনের অন্তিম পর্বে, মীনাক্ষীদের অশ্রুময় প্রশ্ন ছিল— ‘(স্পার্টাকাস) আমরা কেন ব্যর্থ হলাম?’ ব্যর্থতার এই জিজ্ঞাসা জন্ম দিতে পারত এক দলিলের, যা কমিউনিস্ট ঐতিহ্যের নানা উপ-দলিল সংযোজনে ঢেকে দিতে পারত মানুষজনের সুখ-দুঃখ সবই। কিন্তু সে-পথে হাঁটেননি মীনাক্ষী।
জেল থেকে বেরিয়ে শিক্ষা সমাপ্তি এবং জীবিকার সন্ধানে পাড়ি ত্রিপুরায়। সেখানে প্রায় দু’দশক ধরে লেখেন আসগরি বেগমদের মতো নিঃসহায় বন্দিনীদের জীবনকথা! লেখা, ছেঁড়া, কাঁদা, লেখা— এ ছিল ‘কর্তব্যবোধের তাড়নায়’ প্রায় নিত্যদিনের কর্ম। তারই ফল জেলের ভেতর জেল— পাগলবাড়ি পর্ব (১৯৯১) এবং জেলের ভেতর জেল— হাজতি-নম্বর, মেয়াদি নম্বর (১৯৯৮)। অর্ধ-সহস্র পৃষ্ঠা বিস্তৃত সে লেখন ভারতীয় সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের নির্মম আলেখ্য। মীনাক্ষী জানতেন, যজ্ঞ যজমানের কল্যাণে। তাই নিজের কথা সযত্নে সরিয়ে লেখেন আসগরি-শাহানাজ-মিতাদের কথা।
জেলের ভেতর জেলের পাশাপাশি জেলের বাইরের জেলের কথা লিখছিলেন নব্বইয়ের দশকে, ‘মামিমা’ ‘স্নেহলতা’ ‘অন্তর দ্বন্দ্ব’ ‘পারুল বিশ্বাসের মৃত্যু সম্পর্কে একটি রিপোর্ট’ ‘ফোলিও ব্যাগ’ ‘কুলসুম কথা’ ইত্যাদি গল্পে। ‘মামিমা’ গল্পের শেষ অনুচ্ছেদে লেখেন, ‘কখনও কখনও প্রবাসে ঝিঁঝিঁ আর শেয়ালের উল্লাসধ্বনিভরা একলা নির্জন রাতে ক্লান্তিতে চোখ জড়িয়ে এলে বাইশ বছরের ওপার থেকে এসে নন্দিনীর চল্লিশ ছুঁই-ছুঁই চুলে হাত রেখে স্নেহ ভরা চোখে চেয়ে থাকেন সেই মহিলা, কোন এক আলো নেবানো রাতে যাকে কালপুরুষ চিনিয়েছিল নন্দিনী’। এ যেন গল্পকে যাপিত জীবনের সত্যে জড়িয়ে নেওয়া, কল্পসৃজনকে লেখক জীবনের গাঁটছড়ায় বাঁধা। ‘স্নেহলতা’-য় ঘর-সংসারের নম্র শান্ত ছায়ার পিছনে অনিশ্চয়তা ও আশংকার ছবি আঁকেন মীনাক্ষী। ‘পুনর্জন্ম’ গল্পে লেখেন আগুনে পুড়তে থাকা একটি মেয়েকে বাঁচানোর তাগিদে এক প্রৌঢ়ের পরবর্তী কালে পুলিশের হাতে হয়রানি। ‘সীতাকাণ্ড’ একটি মধ্যবিত্ত মেয়ের অনিয়ন্ত্রিত উচ্চাকাঙ্ক্ষার কঠিন পরিণতি।
কিন্তু এ-সবই কলকাতা জীবনের গল্প। ধীরে ধীরে ত্রিপুরা জীবনের অন্দরে প্রবেশ মীনাক্ষীর। বঙ্গ সমতলের বিপরীতে কাচামরিচ, লচ্ছই আর বেগুনের খেত দেখা যায় টিলার ওপরের গ্রামে, লুঙ্গার গায়ে। রাতে হানা দেয় বন্দুকধারীরা ভূমিপুত্রের অধিকার অর্জনে। এর পাশাপাশি অন্য এক বাস্তবতা উগ্রপন্থী সন্দেহে আদিবাসী যুবকদের ওপর মিলিটারি ও পুলিশের অত্যাচার। লাশ জমতে থাকে মীনাক্ষীর গল্পে— অপহৃত মানুষের, উগ্রপন্থীর, পুলিশ ‘সোর্স’-দের। দিনে দিনে আরও নিবিড় পরিচয় ত্রিপুরার ভূগোল, ইতিহাস, রাজনীতির সঙ্গে। দূরে দেখেন চট্টগ্রাম পাহাড়শ্রেণি, অনুভব করেন বনজঙ্গলে ভরা তীরভূমি থেকে উঠে আসা হাওয়া, শোনেন পিছুটানা জলের নদীর কথা আর জলের নীচের মানুষের কান্না। জানেন কেমন করে সরকারি পরিকল্পনার ধাক্কায় সবচেয়ে উর্বর জমির জলসমাধি ঘটে আর আদিবাসীরা হারায় সবুজ জুমখেত। সে জীবনকে আরও নিবিড় ভাবে চেনা কর্মসূত্রে। এ সেই জগত্, যেখানে নির্যাতিতার স্বামীর সবিস্ময় প্রশ্ন— ‘ভাত-কাপড় দেব, দু-ঘা মারতে পারব না!’
সব প্রশ্নই যে এমন সরল তাও নয়। ‘পাতালকন্যা’ গল্পে দু’জন প্রৌঢ় নারী ও পুরুষ পরকীয়া প্রেমে পড়ে। তা মানতে না-পারা সংসার বিধান চায় সমাজের কাছে। সমাজ বলে, ওরা যে যার সংসারে ফিরুক জরিমানা দিয়ে— ‘বলিরানি চল্লিশ ত্যাকা দেওন লাগবো, রামজয়ের একশত।’ সঙ্গে ‘দুই জনে এক এক কলস চুয়াক দিবো।’ কিন্তু দোষমুক্তির এই সুযোগ না নিয়ে আত্মহত্যা করে দু’জনে। সে দৃশ্য দেখতে ধূলিধূসর গ্রামের মানুষজন চলেছে টংঘরের পথে। কারও গা উদোম, কেউ গেঞ্জি পরা, কেউ রিয়া-পাছড়া পরা। সে যাত্রার বিবরণ লেখার গুণে ক্যামেরাকেও হার মানায়। কিন্তু এর চেয়েও উল্লেখযোগ্য হল, গল্পকথকের ধীর পায়ে টংঘরের পথে হাঁটা রামজয়ের পত্নী পূর্ণগর্ভা পাতালকন্যার সঙ্গে। যৌবন উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই স্বামীহারা কথকের প্রশ্ন, বলিরানি ও রামজয়ের প্রেমকাহিনি যেখানে আঠেরো মাসের পুরনো, সেখানে ন’মাস আগে কোন প্রেমে পাতালকন্যার গর্ভবতী হওয়া!
‘কুসমি লো’ গল্পে দরিদ্র মতিবিবি ও দুধু ন’বছরের মেয়ের গোপনে নিকা দেয় ক্যান্সার রোগী আটাশ বছরের মনিষ্যের সঙ্গে, তিন হাজার টাকার বিনিময়ে। অবস্থাপন্ন সে পরিবার, আর তাই আশা ভবিষ্যতে ইন্তেকাল অন্তে কুসমি ধন আনবে ঘরে। কুসমির জেঠি নিঃসন্তান কমিরুন বিবি সে সংবাদ পায় পরে এবং বোঝে কোন নরকে বাস কুসমির। কমিরুন একদিন বোরখার আড়ালে হাজির হয় কুসমির শ্বশুরবাড়ি আর গোপনে তাকে উদ্ধার করে ঘরে আনে। পরিণামে দুধুর হাতে মার খেয়ে শয্যাশায়ী কমিরুন, কিন্তু মনে তার আনন্দ। ওদিকে ‘তিন তালাক’ বলে জামাই মরে। সম্পত্তি হারানোর শোকে মতিবিবি ‘বাঁজ মাগি’ বলে যত গাল পাড়ে কমিরুনকে, মতিবিবির ছেলেমেয়ে কমিরুনের বুকের কাছে তত ঘেঁষে— ‘ওই বুকে কত না আশ্রয়!’
এই পর্বে ‘মাল্টিন্যাশনালার ছেলে’, ‘যোগিয়া’, ‘রেল কাম ঝমাঝম’ ‘সম্পর্ক’ ‘দুই বন্ধু’ ইত্যাদি গল্পে বার-বার ফুটে ওঠে নারীর অসহায় অবস্থান— স্ত্রী, মা, প্রেমিকা, সতীন এমন নানা সম্পর্কে। এ-সব গল্প মীনাক্ষী নিছক বানান না, নিজের চোখে দেখেন। সে দেখা যেমন বাইরের, তেমনই ভেতরেরও। ‘কথক’ মহিলা কমিশনের উচ্চপদস্থ সরকারি আধিকারিক। এ-জন্মে পুলিশও তাঁকে স্যালুট করে। কেউ ভাবতেও পারে না ‘গতজন্মে পুলিশের মারে থ্যঁাতলানো এক লাশের মতো হয়ে সে কত দিন পড়েছিল, পুলিশ লকআপে।’ আর পরিবার ও সমাজের সঙ্গে পুলিশ যে কত জায়গায় কত রকম সম্পর্কে জড়িয়ে, তার তো হিসেব নেই।
মীনাক্ষীর শেষ সংকলন একটি কালো টুপি ও ন্যায় বিচার বারোটি গল্প নিয়ে। তত দিনে তাঁর কর্মসীমা অন্য বিস্তৃতি পেয়েছে উত্তর-পূর্ব ভারতের জনজাতির লোকসাহিত্য সংকলনের প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্বে। যোগ তৈরি হচ্ছে বংচের, মগ, কাবুই, তেনেদেই, মিজো ইত্যাদি ভাষা-সংস্কৃতির সঙ্গে। ফলে নিজস্ব সৃষ্টিতে খুঁজছেন এমন এক পাখি, যার গানে সন্ধান মিলবে ‘সব কথা আর কথকতার।’ বংচের কথনকথার অনুপ্রেরণায় লিখছেন ‘সুন্দর মরণ ও কুত্সিত্ মরণের গল্প’। সুন্দর মৃত্যু দিয়ে সুন্দর নতুন জীবন শুরু হয় আর অসুন্দর মৃত্যু দিয়ে অসুন্দর এক জীবন। লোককথার সন্ধানে গিয়ে আদিবাসী জীবনের অনিশ্চয়তাকে আরও কাছ থেকে দেখছেন মীনাক্ষী। লিখছেন কয়েদি মুক্তিরাম দেববর্মার গল্প, যে খুনি কিংবা উগ্রপন্থী না হয়েও সাড়ে-পাঁচ বছর জেল খাটে। এথনিক টেনশন হয়েছে, ফলে পুলিশ হাতের কাছে যাকে পেয়েছে জেলে ঢুকিয়ে দিয়েছে। লিখছেন সিন্ধুমণি জমাতিয়ার সংসার-বৃত্তান্ত, যেখানে মদ্যপ স্বামীর অত্যাচার সইতে না পেরে সিন্ধুমণি ঘা মারে যদুরামের মাথায় আর তারপর ভারতীয় দণ্ডবিধির বিধানে দু’বছরের ছেলে নিয়ে দীর্ঘ হাজতবাস। সেখানে তার কোনও কথা নেই, কারণ ওয়ার্ডাররা তার কথা বোঝে না, বলেও না। শেষ পর্যন্ত এক সহৃদয় আধিকারিকের করুণায় সে ছাড়া পায়। তখনও তার মুখে কথা নেই, সে শুধু কাঁদে— ‘কত যে জল থাকে মেয়েদের চোখে— আর সিন্ধু মানে তো সাগর।’
আদিবাসী গ্রাম, টিলা, ঝোরার পাশাপাশি মীনাক্ষী শোনান দু’দেশের কাঁটাতারের মাঝের এক গৃহস্থের কথাও, যারা সীমান্ত-ফটকে তালা পড়লে নিত্যরাতে দেশহীন হয়। ফিরে দেখেন সত্তর দশকের এক মৃত নকশাল কর্মীর মা’কে, যিনি ছেলের জন্যে তিন দশক পরেও ভাত সাজিয়ে বসে থাকেন নিত্য দুপুরে।
মীনাক্ষীর গল্প তার উত্সকেন্দ্র দক্ষিণ ত্রিপুরার বিলোনিয়া থেকে বড়মুড়া পাহাড়, আগরতলা, বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ ছুঁয়ে স্পর্শ করছিল এক বৃহত্তর জগত্। মীনাক্ষীর কলমে আর এসব গল্প পড়া যাবে না।
বাংলায় এতখানি বিস্তারে আবার কবে লেখা এবং বাঁচা, কে জানে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy