শিল্পী: রথীন বর্মন
প্রাচীন থেকে আধুনিক, এমনকী আধুনিকতাবাদী ধারা পর্যন্ত বিশ্বের প্রায় সমস্ত শিল্প-প্রকল্পেরই অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল বাস্তবের, কখনও বা বাস্তবাতীত কোনও অধ্যাত্ম-অনুভবের বিভ্রম তৈরি করা। প্রাচীন গ্রিসের ‘ভেনাস-ডি-মোলো’ হোক বা ভারতের ‘দিদারগঞ্জের যক্ষী’ বা গুপ্ত-বুদ্ধ; রামকিঙ্করের ‘সাঁওতাল পরিবার’ হোক বা পিকাসো-র ‘গের্নিকা’ – সব ক্ষেত্রেই বিভ্রমের মধ্য দিয়ে বাস্তবের গহনে প্রবেশ করতে চেয়েছেন শিল্পী। জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন সত্যের অনির্বচনীয় আলো। বাস্তব-ভিত্তিক হোক, অভিব্যক্তি-ভিত্তিক হোক বা বিমূর্ত হোক – সব ক্ষেত্রেই প্রাধান্য পেয়ে এসেছে এই ‘বিভ্রম’।
বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে ১৯৬০-এর দশকের পর থেকে পাশ্চাত্যে পোস্ট-মডার্ন-এর দর্শনে ভর করে যখন ভাবনা-ভিত্তিক বা কনসেপচুয়াল আর্টের বিকাশ শুরু হল, তখন সেই ভাবধারার শিল্পপ্রকাশের প্রধান একটা উদ্দেশ্য ছিল এই ‘বিভ্রম’-এর বিহ্বলতাকে ভেঙে ফেলা। সংকেতের মধ্য দিয়ে সত্যের সন্ধানের প্রয়াস, যে সত্যের কোনও নির্ধারিত রূপ নেই। মানুষের বৌদ্ধিক বা দার্শনিক-অবস্থানের সঙ্গে যা কেবলই পাল্টায়। এই প্রকল্পের সূচনাবিন্দু অবশ্য আরও একটু আগে। ১৯১৭ সালে মার্সাল দ্যুসা একটি পরিত্যক্ত মূত্রাধারকে যখন ভাস্কর্য হিসেবে দেখাতে চেয়েছিলেন, তখন তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল এই বিভ্রমের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী-চেতনা গড়ে তোলা। কনসেপচুয়াল-আর্টের সেই প্রকল্প তার পর থেকে নানা ভাবে বিকশিত হয়েছে। আমাদের দেশেও এ বিষয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে ১৯৯০-এর দশকের পর থেকে।
এক্সপেরিমেন্টাল গ্যালারিতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল কলকাতারই তরুণ শিল্পী রথীন বর্মনের একক প্রদর্শনী। শিরোনাম : ‘নো ... আই রিমেম্বার ইট ওয়েল’। নির্দিষ্ট পরিসর-নির্ভর এই প্রকল্পে শিল্পী প্রধান ভর রেখেছেন সাংকেতিকতার উপর, যেখানে বাস্তবতার কোনও বিভ্রম নেই; অথচ সমস্ত প্রকল্পটিই গড়ে উঠেছে আজকের এক প্রবল বাস্তবতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ থেকে। আবাস মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গে নিবিড় ভাবে সম্পৃক্ত একটি সত্য। কিন্তু আজকের বিশ্বায়িত পরিস্থিতিতে স্থায়ী আবাসের সেই নিশ্চয়তা ক্রমশই ভাঙছে। যুদ্ধ, সন্ত্রাস এবং উন্নয়নের দিকভ্রান্ত গতি যেমন মানুষকে নানা ভাবে গৃহহীন করছে তেমনই অনেক ক্ষেত্রে মানুষ নিজেও আশ্রয়ের এই নিশ্চয়তাকে অস্বীকার করছে। আজকের এই পরিস্থিতিতে এডওয়ার্ড সঈদ বলেছিলেন : ‘এ জেনারালাইজড কন্ডিশন অব হোমলেসনেস’।
রথীনের এই প্রদর্শনী-প্রকল্প গড়ে উঠেছে এই ভাবনাকে ভিত্তি করে। আশ্রয়হীনতার ভিতরের করুণ শূন্যতাকে তিনি নানা ভাবে সম্বোধন করেছেন এই প্রদর্শনীর পাঁচটি সাংকেতিক রচনায়। প্রথম প্রদর্শটির শিরোনাম : ‘ইউ ক্যান সি দ্য স্কাই এগেন’। গ্যালারি পরিসরের অন্তর্গত একটি বর্গাকার পরিখাকে শিল্পী ব্যবহার করেছেন এই রচনায়। যেন সমস্ত আবাস অন্তর্হিত হয়েছে। কংক্রিট ভাঙা কিছু লোহার রড শুধু শরীর বাড়িয়ে আছে খাদের চারপাশ থেকে। দ্বিতীয় রচনাটির শিরোনাম : ‘নো ... আই রিমেম্বার ইট ওয়েল’। গ্যালারির একটি দেয়াল জুড়ে দাঁড় করানো রয়েছে ফাইবার গ্লাসের তৈরি আয়তাকার একটি অমসৃণ কাঠামো। তার ভিতর মাঝে মাঝে সাঁটা রয়েছে লোহার রডে তৈরি দোচালা। ঘর নেই, বিস্তীর্ণ শূন্য পরিসরে শুধু স্মৃতি আছে তার। তৃতীয় রচনাটি ‘উই প্লেড ইভন অ্যাট নাইট’। দেয়ালের গায়ে সাঁটা রয়েছে দশটি ছোট ছোট ঘরের কাঠামো। পঞ্চম রচনাটি ১২-টি ড্রয়িং-এর সমাহার। রেখায় আঁকা হয়েছে বাড়ির কাঠামোর অংশবিশেষ। সেই পরিমণ্ডলে খুব ছোট করে উপস্থাপিত বর্ণিল কিছু গৃহ-সরঞ্জাম যেমন টেবিল, বালতি, বোতল, চটি, ফুলের টব ইত্যাদি। যা গৃহের কোনও বিভ্রমের দিকে না গিয়েও গৃহহীনতার বিভ্রম জাগায় খুবই সাংকেতিক ভাবে।
শিল্পী এখানে গৃহের সমস্ত বিভ্রমকে ভেঙে বাস্তুহীনতার শূন্যের স্মৃতিকে জাগাতে চাইছেন সাংকেতিক উপস্থাপনায়। কিন্তু একটা সমস্যা থেকে যায়। এই শিল্প-প্রকল্প স্ব-নির্ভর নয়। দর্শকের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে গেলে শিল্পীকে তাঁর ভাবনার কথা আলাদা করে বলে দিতে হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy