Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪

আটাশ বছর আগের লেখা হলেও আজও সমকালীন

১৯৯১-এ, যখন শিল্পীর বয়স সত্তর, তখন তাঁর কলমে এই খাতালেখার শুরু। খাতাটি শক্ত বোর্ডে বাঁধানো, আকারে ছোট, মলাটে ছাপা ‘এক্সারসাইজ বুক’, আর ওই প্রচ্ছদেই সোমনাথ হোর লিখে রেখেছেন ‘ক্ষতচিন্তা, ভাঙন’।

নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০১৯ ০১:০৪
Share: Save:

তাঁর জীবনের প্রথম ক্ষতচিহ্ন তৈরি হয় তাঁর পিতার মৃত্যুতে, সোমনাথ হোরের বয়স তখন ১৪। মৃত্যুমুহূর্তে বাবা তাঁকে দেখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সোমনাথ যখন পৌঁছোলেন তখন সব শেষ। লিখেছেন ‘‘বাড়িতে সজ্ঞানে এই আমার মৃত্যু দর্শন।... আমি শব দেখে এতই বিমূঢ় হয়ে পড়েছিলাম যে, পাঁচবার চেতনা হারিয়ে ফেলেছিলাম। এই আমার জীবনের প্রথম ক্ষত, যার দাগ কোনোদিন মিলায়নি।’’ শিল্পীর (১৯২১-২০০৬) জন্ম চট্টগ্রামে, দেশভাগের পর চলে আসেন কলকাতায়। চিত্তপ্রসাদ ও জয়নুল আবেদিনের সান্নিধ্যে এসেছিলেন, নিজের শিল্পীজীবনের একটি পর্যায়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন শান্তিনিকেতনে, সেখানে আবার রামকিঙ্কর ও বিনোদবিহারীর সাহচর্যে আসেন। ১৯৯১-এ, যখন শিল্পীর বয়স সত্তর, তখন তাঁর কলমে এই খাতালেখার শুরু। খাতাটি শক্ত বোর্ডে বাঁধানো, আকারে ছোট, মলাটে ছাপা ‘এক্সারসাইজ বুক’, আর ওই প্রচ্ছদেই সোমনাথ হোর লিখে রেখেছেন ‘ক্ষতচিন্তা, ভাঙন’। খাতাটি শিল্পীকন্যা চন্দনা হোর তাঁদের হাতে তুলে দেন, দেবভাষা-র পক্ষে জানিয়েছেন সৌরভ দে ও দেবজ্যোতি মুখোপাধ্যায়। তাঁদের মনে হয়েছে এই খাতার লেখায় শিল্পীর ‘জীবন, শিল্প, আদর্শ, সময়— মিলেমিশে একাকার।’ আটাশ বছর আগের লেখা হলেও আজও সমকালীন, এমনই প্রাসঙ্গিক থাকবে ভবিষ্যতেও। দেবভাষা তো শিল্প আর বই-এর আবাস, শিল্পীর শতাধিক কাজ নিয়ে তাঁর প্রাক-শতবর্ষে প্রদর্শনী হচ্ছে যেমন সেখানে, তেমনই সেখান থেকে প্রকাশিত হয়েছে এই বইটিও। বইয়ের ভিতরের ছবিগুলি প্রদর্শনী থেকেই নেওয়া। শিল্পী হিসেবে জীবনভর কত রকমের ক্ষতের সামনে দাঁড়িয়েছেন সোমনাথ হোর, একটি ক্ষত কখনওই আর-একটির মতো নয়, তারই বয়ানে ভরে আছে গোটা খাতাখানি। তাঁর শিল্পচিন্তার আদি বীজ এই ক্ষত-র কথা লিখতে-লিখতে সোমনাথ হোর যেন এক ফেলে-আসা অথচ চলিষ্ণু ইতিহাসের সামনে দাঁড় করিয়ে দেন, যে-ইতিহাসে অবিরত ফুটে উঠতে থাকে ভাঙনের ধারাবাহিকতা: ‘‘আমরা মুহূর্তের মধ্যে ভুলে গেলাম যে— ধমনীতে আমাদের একই রক্ত। ‘ধর্ম আফিমের দ্যোতক’ এই বাণী প্রত্যক্ষ করলাম। প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে বহুকাল দূরে থেকেও আজও এ-কথা কত সত্য মনে লাগে। কজন মুসলমান বাইরে থেকে এসেছে? সবই তো হিন্দের (ভারতের) রক্ত। তবু কেন আজ বাবরি মসজিদ রামজন্মভূমির জমি তৈরি হানাহানির আয়োজন।’’ পাশাপাশি লিখেছেন কী ভাবে এই ইতিহাস তৈরি করেছে তাঁর শিল্পসৃষ্টির মুহূর্ত: ‘‘ছবি আঁকা কিংবা মূর্তি গড়ার সময় এসব মনে থাকে না এমনকী মানুষ করছি কি জন্তু জানোয়ার করছি তাও জানি না। মাধ্যম নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতেই আকারগুলি বেরিয়ে আসে। তাদের সর্বাঙ্গে ক্ষত; তাদের পূর্ণ অস্তিত্বই ক্ষত।’’

ক্ষতচিন্তা, ভাঙন
সোমনাথ হোর
২০০.০০
দেবভাষা

যাঁদের সাক্ষাৎকার এ-বইয়ে, তাঁরা তাঁদের অনন্য কীর্তির জন্য বাঙালির কাছে অতীব পরিচিত। ফলত প্রতিটি সাক্ষাৎকারই দৈর্ঘ্যে ও তাঁদের পাণ্ডিত্য এবং পর্যবেক্ষণের গভীরতায় রীতিমতো বিশিষ্ট করে তুলেছে বইটিকে। যেমন অমর্ত্য সেনের সাক্ষাৎকারটিতে একটি অধ্যায়ই হল ‘রুক্ষ বাস্তব ও অর্থনীতি’ নিয়ে, তাতে শুভরঞ্জনের প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের জবাবে অমর্ত্য জানাচ্ছেন: ‘‘দুর্ভাগ্যবশত ভারতবর্ষে সরকার এবং বিরোধী দলগুলো তাদের আর্থিক নীতির বিতর্কে জনসাধারণের অর্ধাহার বন্ধ করাকে অগ্রাধিকার দেয় না। আমরা সত্যি এক অদ্ভুত পরিস্থিতিতে বাস করছি যেখানে এক দিকে সরকার লাখ লাখ টন খাদ্যসম্ভার মজুত রেখেছে। অন্য দিকে দেশেরই এক বিরাট অংশ প্রতিদিন ক্ষুধার্ত থাকছে। এই অবস্থাকে দিনের পর দিন সহ্য করা বা মেনে নেওয়া একধরনের রাজনৈতিক ব্যর্থতার প্রতিফলন। এর সঙ্গে এও প্রমাণিত হয় যে প্রকৃত অর্থে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোকে আমরা যথোপযুক্ত মূল্য দিতে পারিনি। জনগণের বঞ্চিত অংশের ন্যূনতম অধিকারের প্রশ্নটিকে সর্বদা চোখের সামনে রাখা উচিত।’’ এ ভাবেই একে একে ঠাঁই পেয়েছে অমিয়কুমার বাগচী, বিমলকৃষ্ণ মতিলাল, অমলেশ ত্রিপাঠী, ভিলি ব্রান্ড, গুন্টার গ্রাস, উইলিয়াম গোল্ডিং ও শঙ্খ ঘোষের সাক্ষাৎকার। প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক হিসেবে শুভরঞ্জন জানিয়েছেন ‘‘শুধু পেশা নয়, আমার উৎসুক গবেষক-চিত্ত আমাকে ক্ষণে ক্ষণে অনুপ্রাণিত করেছিল প্রতিভাবান প্রথিতযশাদের সাক্ষাৎকার নিতে।’’ বইটির শেষ সাক্ষাৎকারে শঙ্খ ঘোষ তাঁর সম্পাদিত রবীন্দ্রকবিতার সংকলন সূর্যাবর্ত সম্পর্কে জানিয়েছেন ‘‘বিশেষভাবে কোনো ‘আধুনিক রুচি’ মনে রেখে যে এই সংকলন করেছি তা নয়, যদি না বলি যে আধুনিক সময়ে বেঁচে আছি বলে আমার রুচিটাও আধুনিক। কিন্তু তা তো হয় না ঠিক, আধুনিকতা নিয়ে তো অনেক বিতণ্ডা।... ‘আধুনিক’ নামের ওই অস্পষ্ট বিশেষণটাকে

নিয়ে বেশি দূর ভাবতে আর ইচ্ছে হয় না এখন।’’

সেরাদের সংলাপ
শুভরঞ্জন দাশগুপ্ত
৩৯০.০০
বিপিএল, ঢাকা

পাঁচটি ভাষার কবিতার অনুবাদ সম্পাদনা করেছেন অংশুমান কর। তিনি নিজে কবি, বেশ কিছু দিন সাহিত্য অকাদেমির পূর্বাঞ্চলীয় দফতরের দায়িত্বেও ছিলেন। ১৬৮ পাতার এই কাব্যানুবাদের নামই তিনি দিয়েছেন ‘সীমানা ছাড়িয়ে’। এ বই হাতে নিয়ে মনে পড়ে তরুণ কবিদের প্রতি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কথা। তিনি আড্ডায় বলতেন, ‘‘আসলে অনুবাদ কবিতা বলে কিছু হয় না। পুরোটাই একটা নতুন কবিতা। কেন না মূল ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদ খুব কমই হয় বা হয়েছে।’’ ১৯৬৩ সালে তিনি প্রথম ভারতীয় কবি-লেখক হিসেবে আয়ওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখক শিবিরে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে ‘দেশ’ পত্রিকায় ‘অন্য দেশের কবিতা’ নামে এক অনুবাদ-যজ্ঞও করেছিলেন। অংশুমান সেই পথেরই পথিক। অসমিয়া, মালয়ালম, মরাঠি, গুজরাতি, তেলুগু— মোট ৫টি ভাষার ১০ জন কবির কবিতার অনুবাদ তিনি সঙ্কলন করেছেন। কবিদের মধ্যে নীলিম কুমার, সৌরভ শইকিয়া, অনীতা তাম্পি, কুজুর উইলসন, অভয় দানি, অতনু ভট্টাচার্য, শ্রীকান্ত দেশমুখ প্রভৃতি, এবং অনুবাদকদের তালিকায় অভিজিৎ বেরা, সম্রাজ্ঞী বন্দ্যোপাধ্যায়, কৌষিকী দাশগুপ্ত, রাকা দাশগুপ্ত, অরিত্র সান্যাল, হিমালয় জানা-রা আছেন। অংশুমান স্পষ্টই লিখেছেন, মূল ভাষায় প্রবেশ সম্ভব ছিল না। বইয়ের এটি অত্যন্ত সততার জায়গা।

সীমানা ছাড়িয়ে/ বাংলা অনুবাদে সাম্প্রতিক ভারতীয় কবিতা
সম্পাদক: অংশুমান কর
২৫০.০০
বীরুৎজাতীয় সাহিত্য সম্মিলনী

অন্য বিষয়গুলি:

Book Review Somenath Hore Angsuman Kar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy