ছিন্নমূল: শিয়ালদহ স্টেশনে পূর্ববঙ্গ থেকে আসা শরণার্থীদের ভিড়।
উপন্যাস সমগ্র
সত্যপ্রিয় ঘোষ, সম্পাঃ প্রণব বিশ্বাস
১২০০.০০
দে’জ়
গল্প সংগ্রহ ১
সত্যপ্রিয় ঘোষ, সঙ্কলন ও সম্পাঃ
রুশতী সেন
৬৫০.০০
ধানসিড়ি
সত্যপ্রিয় ঘোষ ক্রমশ দূরে সরে গিয়েছিলেন, কারণ দুষ্প্রাপ্য হয়ে গিয়েছিল একদা প্রকাশিত তাঁর বইগুলি। এক বড় লেখকের শতবর্ষ উদ্যাপন শুরু হল খণ্ডে খণ্ডে তাঁর গল্প এবং উপন্যাস প্রকাশের মাধ্যমে। এই সূত্রেই নতুন প্রজন্ম তাঁকে চিনবে। ‘পেট’, ‘মায়াপথ’, ‘তাস’, ‘আমোদ’ কিংবা ‘চাকরির প্রথম দিন’ না-পড়ে বাংলা সাহিত্য পাঠ অনেকটাই অসম্পূর্ণ থেকে যায় না? সত্যপ্রিয় ঘোষের গল্প সংগ্রহ প্রথম খণ্ড এবং উপন্যাস সমগ্র হাতে এল। এল দেশভাগে উচ্ছিন্ন মানুষের জীবনচরিত। স্বাধীনতা এসেছিল কত হৃদয়বিদারক হয়ে তা সত্যপ্রিয় ঘোষের উপন্যাস, গল্প পড়লে ধরা যায়। সত্যি বলতে, দেশভাগ নিয়ে আমাদের বাংলা সাহিত্যে লেখা হয়েছে অনেক পরে, অন্তত পঁচিশ বছর বাদে, বাংলাদেশের জন্মের সামান্য কিছু আগে-পরে। দেশ দু’খণ্ড হল, আমাদের গ্রাম নদী সব ফেলে রেখে একবস্ত্রে স্টিমারে চেপে খুলনা, খুলনা থেকে ট্রেনে শিয়ালদহ। স্টেশন ভরে গেল উদ্বাস্তুতে। দেশভাগের জন্য শিকড় থেকে উচ্ছিন্ন মানুষের যে হাহাকার দেখেছিলাম ঋত্বিক ঘটকের ছবিতে, সত্যপ্রিয় ঘোষের গল্প-উপন্যাসে সেই হাহাকার উপলব্ধ হল। এমন হাহাকার, লুকোনো অশ্রু বাংলা সাহিত্যে যে আছে, তা এই প্রায় হারিয়ে যেতে বসা এই লেখকের উপন্যাস না পাঠ করলে জানা অসম্পূর্ণ থেকে যেত।
বরিশাল থেকে তাঁরা সপরিবার চলে এসেছিলেন এ পারে। পার্টিশনের সময় তিনি তেইশ বছরের যুবক। তিনি যা দেখেছেন, তা যেন আগে বা পরে দেখা হয়নি। সত্যপ্রিয় ফেলে আসা বরিশালকে নির্মাণ করছেন এই কলকাতা শহরে। স্বপ্নের ফেরিওয়ালা উপন্যাসের রমানাথ থিয়েটার-পাগল মানুষ। বরিশাল শহরে নাটক নামাতেন— চাঁদ সওদাগর পালা, বেহুলা-লখিন্দর পালা। তার কুশীলব কতকগুলি বালক-বালিকা। রমানাথ কলকাতায় আবার তা নামাতে চান। বরিশাল থেকে আসা পরিবারের খোঁজ করেন, বরিশাল বাদেও অন্য জেলার বালক-বালিকাদেরও নেন তাঁর নাট্যরঙ্গে। রমানাথ থাকেন এক পরিবারের অংশ হয়ে। সে আর এক গল্প। না, একই গল্প। আসলে নাটকের ভিতর দিয়ে হারানো জন্মভূমিকে ফিরে পাওয়ার আকুল প্রচেষ্টা। তিনি যখন উচ্চারণ করেন, পুণ্যে বিশাল, তার নাম বরিশাল, টের পাই এই হাহাকার নিয়ে আমাদের মা-বাবারা চলে গেছেন। এই মুহূর্তে এসে বরিশালের সঙ্গে মিলে যায় খুলনা, যশোর, ফরিদপুর, নোয়াখালি, কুমিল্লা সবই। একান্নে ছিলাম আমরা, ভেঙে গেলাম। আবার এক হব ওই থিয়েটার দিয়ে। নাটক দিয়ে সকলকে এক সূত্রে বেঁধে ফেলার স্বপ্নের ভিতরে রয়েছে এই কথা।
আর এক উপন্যাস গান্ধর্ব তিন বন্ধুর কাহিনি। তিন জনই এসেছিল রাজশাহী থেকে। এই শহরে এসে এই উপন্যাসের সব চরিত্রই বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করে যাচ্ছে। কোনও রকমে মাথা গুঁজে থেকে জীবিকা খুঁজে নিয়ে বাঁচার মতো বাঁচতে চাওয়া। তিন বন্ধুর তিন রকম সমস্যা, কিন্তু সব সমস্যার ভিতরে দেশ হারানোর অশ্রু থাকে গোপনে লুকিয়ে। ‘তাস’ গল্পের ভিতরে পর পর বিছানা জনা দশের। গান্ধর্ব উপন্যাসে সন্ধ্যায় হ্যারিকেনও জ্বলে না, মাটির প্রদীপের নিভু-নিভু আলোয় চারটি প্রায় হেরে-যাওয়া মানুষ চুপ করে বসে থাকে। হতশ্রী, নিম্নমধ্যবিত্ত, দেশ ছেড়ে-আসা মানুষের যে চেহারা তাঁর উপন্যাস গল্পে আছে, তা আমাদের স্বাধীনতারও ইতিহাস নিশ্চয়ই। মানুষের বেঁচে থাকার দুর্দম প্রয়াসের ইতিহাস। অনেক ভাইবোন, ঘর একটি, বিবাহ হবে কী ভাবে? থাকার জায়গা কই। বাক্স-প্যাঁটরা সাজিয়ে ঘরের ভিতরে ঘর হয়েছে, স্টিমারের ডেক আর কেবিন যাকে বলে।
এই ধারার লেখা বাংলা সাহিত্যে আছে, কিন্তু তারা শিকড় থেকে উচ্ছেদ হওয়া পরিবার বলে চিহ্নিত নয়। তাদের উদ্বাস্তু পরিচয় যেন সাবধানেই অনুচ্চারিত। দেশভাগ সত্যপ্রিয়কে যে ভাবে আক্রান্ত করেছে, তাঁর লেখায় তার ব্যাপ্ত ছায়া। সেই ভয়ানক সময়কে তিনি লিখে রেখে গেছেন তাঁর গল্প-উপন্যাসে। তাঁকে পড়তে পড়তে গত শতকের পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে আমাদের বাল্যকালের কলকাতা শহরের অনুজ্জ্বল আশ্রয়গুলির কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে এমন পরিবারেই তো বড় হয়েছি। এমন ধারালো তাঁর গদ্য, যা না হলে বনিতা জনম, গান্ধর্ব, মানপত্র, চার দেয়াল লেখা যেত না। বনিতা জনম উপন্যাসে দেশভাগের প্রত্যক্ষতা নেই। আছে একটি মেয়ের আত্মকথা, প্রতারিত হতে হতে নিজে নিজে বাঁচা। পিতৃকুল থাকল না যার সন্তানের, মাতৃপরিচয়ে তার পরিচয়। শেষ উপন্যাস, বয়নে দর্শনে অসামান্য।
উপন্যাস সমগ্র-তে আছে তাঁর সাতটি উপন্যাসই। সম্পাদনা করেছেন প্রণব বিশ্বাস। সুসম্পাদিত এই গ্রন্থে অমিয় দেব লিখেছেন ভূমিকা। শচীন দাশের একটি সুলিখিত নিবন্ধ আছে সাতটি উপন্যাস নিয়ে। গ্রন্থপঞ্জিও নিষ্ঠার সঙ্গে লিপিবদ্ধ হয়েছে এখানে।
গল্প সংগ্রহ সম্পাদনা করেছেন রুশতী সেন। তাঁর ভূমিকা এই গ্রন্থে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি লেখককে খুঁজতে শিয়ালদহের পূর্ব রেল অফিসে হানা দিয়েছেন। গল্পগুলি প্রকাশের, পুনঃপ্রকাশের খুঁটিনাটি সমেত লেখকের জীবনকথা লিখেছেন। তা ছাড়া লেখক-কন্যা তপস্যা ঘোষের কাছ থেকে পাওয়া গেছে অনেক তথ্য, লেখকের নিজের হাতে লিখে যাওয়া তালিকা, সেই তালিকায় রয়েছে কোন লেখায় কত সম্মানদক্ষিণা পেয়েছেন, তার হিসাবও। ‘ঘুমাও’ গল্পে লেখক লিখছেন, কখনও সম্মানদক্ষিণা আসছে, কখনও তা অমিল। এ-হেন সময়ে এক পত্রিকা-সম্পাদক এসে গল্প চাইলেন, দরাদরিতে তা পঁচিশ টাকা অবধি উঠল। কেন? না, সম্পাদক বিনিময়ে আর এক লেখকবৃত্তি নেওয়া যুবক, তাঁর পরমাত্মীয়কে সেখান থেকে সরাতে চাইছেন। এই বৃত্তি তো অনিশ্চিতযাত্রাই। গভীর শ্লেষে সত্যপ্রিয় শেষ অবধি গল্প যেখানে নিয়ে যান, তা এই সময়েরই গল্প যেন।
পার্টিশনের অব্যবহিত পরে পূর্ববঙ্গের মানুষ কী ভাবে ঠাঁইনাড়া, উচ্ছিন্ন জীবন যাপন করেছেন, তা সত্যপ্রিয় ঘোষের গল্পে যে ভাবে আছে তার চিহ্ন বাংলা সাহিত্যে নেই। বলতে গেলে, ১৯৪৭ থেকে অনেকটা সময় পর্যন্ত হয়তো কী ভাবে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ভিতর, দোলাচলের ভিতর অতিবাহিত হয়েছিল জীবন, তার কোনও তথ্য কি আছে? কেউ কি লিখেছেন সেই কথা তখন? ‘পেট’ গল্প প্রকাশিত হয় ১৩৫৫ সনে ‘বাস্তুহারা’ নামে। এই জীবন আর কেউ লেখেননি তখন। ইস্কুলমাস্টার তাঁর মা, ভাই, বোনকে পাঠিয়ে দিয়েছে কলকাতায়, মেছুয়াবাজার বস্তিতে তারা আছে বেঁচেবর্তে, মাস্টার ও পারে রয়েছে, জীবিকা ছেড়ে যায় কী করে? আজন্মকালের চেনা গ্রাম, নদী ভিনদেশ হয়ে গেছে, সেখান থেকে টাকা পাঠালে তবে না ভাইবোন নিয়ে মা বাঁচবে।
কী আশ্চর্য গল্প ‘মায়াপথ’— মা ভাই বোনের টানে পাকশী থেকে দার্জিলিং মেলে পাকাপাকি কলকাতা চলে আসার কথা বললে, তাদের সকলের মুখ অন্ধকার হয়ে যায়। পেট চলবে কী ভাবে? উদ্বাস্তু সহকর্মীকে নিয়ে ভয়ানক আমোদের ফল কী হতে পারে, তা ১৩৫৮ বঙ্গাব্দে লেখা ‘আমোদ’ গল্পে আছে। ১৯৪৩-এর মন্বন্তর বুঝি ফিরেই এসেছিল ১৯৪৭-এর পরে, উদ্বাস্তু জীবনে। ‘পেট’ গল্পটি পড়লে সেই ছায়াই যেন দেখা যায়। ‘তাস’ গল্পেই রয়েছে এমন বিমর্ষতা, তখন টের পাই জীবন কত গ্লানি নিয়ে বয়ে চলেছিল সেই কঠিন সময়ে। গল্প সংগ্রহ প্রথম খণ্ডে আছে ৩৫টি হীরকদ্যুতিসম্পন্ন গল্প।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy