Advertisement
১৯ ডিসেম্বর ২০২৪
book review

উদারবাদী ভারতের সঙ্গে স্কুল পড়ুয়াদের পরিচয়

অন্বেষা সেনগুপ্ত তাঁর দেশভাগের আখ্যানকে বুনেছেন অনেক গল্পের সুতোয়। জয়মণি নামে এক সরকারি হাতির গল্প আছে, বাঁটোয়ারায় যে পড়েছিল পাকিস্তানের ভাগে।

সুহাসিনী ইসলাম
শেষ আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০২২ ০৯:০০
Share: Save:

ছোটদের ইতিহাসে হাতেখড়ি দেওয়ার জন্য আলাদা বইয়ের প্রয়োজন হল কেন? স্কুলের পাঠ্যক্রমেই তো রয়েছে ইতিহাস? আলোচ্য বই তিনটি হাতে নিলেই এই প্রশ্নের অকাট্য উত্তর পাওয়া যাবে। এই বইগুলিতে সেই ইতিহাসই আলোচিত হয়েছে, যার কথা স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে নেই, অথবা থাকলেও এমন ভাবে নেই। কিন্তু, নাগরিক হয়ে ওঠার জন্য যদি ছোটদের তৈরি করতে হয়, তবে এই ইতিহাস তাদের পড়াতেই হবে। বিশেষত এই সময়ে, যখন দেশের শাসকরা নিজেদের ইচ্ছামতো ইতিহাস তৈরি করে নিতে চাইছেন। অতএব, গোড়াতেই একটা কথা সম্বন্ধে নিঃসংশয় হওয়া যায়— এই বইগুলি রচনার পিছনে রয়েছে রাজনীতির বোধ। যে উদারবাদী রাজনীতি ভারত নামক ধারণাটির সঙ্গে একাত্ম ছিল, স্কুলপড়ুয়াদের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দেওয়ার অত্যাবশ্যক দায়িত্বটি পালন করেছেন তিন লেখক।

বইগুলির বিষয় যথাক্রমে দেশভাগ, দেশের ভাষা এবং নাগরিকত্ব। অর্থাৎ, বর্তমান ভারতীয় রাজনীতি মূলত যে অক্ষগুলি ধরে চলছে, লেখকরা সেখানেই ছোটদেরও নিয়ে আসতে চেয়েছেন। কাজটি কঠিন। ইতিহাসকে যে নৈর্ব্যক্তিক দূরত্বে দেখা যায়, বর্তমানকে সে ভাবে দেখা মুশকিল। বইগুলো যদিও ইতিহাসের, কিন্তু তার প্রতিটি প্রশ্নই এমন সমসাময়িক, প্রাসঙ্গিক যে, তাকে শুধু ‘ইতিহাস’-এর খাপে আটকে রাখা যায় না। এই সমসাময়িক রাজনীতির প্রশ্নের সঙ্গে ছোটদের একটা দূরত্ব থেকেই যায়— ‘বড়দের ব্যাপার’ বলে ছোটদের তার থেকে সরিয়ে রাখা হয়। এই বই লেখার সময় সচেতন ভাবেই সেই আগল ভাঙতে হয়েছে। কিন্তু, রাজনীতির জটিলতাকে ছোটদের অধিগম্য চেহারায় পেশ করা মুখের কথা নয়। কঠিন কাজটি তাঁরা করেছেন। বাস্তবের জটিলতাকে অস্বীকার না করেই কী ভাবে কিশোর-পাঠ্য আখ্যান লিখতে হয়, সেই অনুশীলনটি গুরুত্বপূর্ণ।

ইতিহাসে হাতেখড়ি

দেশভাগ

অন্বেষা সেনগুপ্ত

দেশের ভাষা

দেবারতি বাগচী

দেশের মানুষ

তিস্তা দাস

ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ় কলকাতা

অন্বেষা সেনগুপ্ত তাঁর দেশভাগের আখ্যানকে বুনেছেন অনেক গল্পের সুতোয়। জয়মণি নামে এক সরকারি হাতির গল্প আছে, বাঁটোয়ারায় যে পড়েছিল পাকিস্তানের ভাগে। কিন্তু, হাজার জটিলতায় সে দেশে যাওয়া হল না জয়মণির, বরং মাস দশেক পরে তাকে নিতে পূর্ব পাকিস্তান থেকে যে দুই সরকারি কর্মী এসেছিলেন, তাঁরাও আটকে পড়লেন ভারতীয় জেলে! দেশভাগের ফাঁসে জড়িয়ে পড়া শুধু হাতিরই ভবিতব্য ছিল না, বহু লক্ষ মানুষেরও ছিল। পশ্চিম পঞ্জাবের দেশরাজ নামে এক কিশোরের কথা আছে, অভ্যস্ত রুটির খোঁজে যার পরিবারকে ছুটে বেড়াতে হয়েছিল এক শহর থেকে অন্য শহরে। আছে উদ্বাস্তু হয়ে আসা বীথি দিদিমণির কথা। “দেশভাগ না হলে... শুধু বীথি কেন, আরও বহু মেয়ের জীবনই হত একদম আলাদা... নতুন দেশে এসে যখন টাকাপয়সার দারুণ অসুবিধা, নুন আনতে পান্তা ফুরায় বহু ঘরে, তখন সবাই বুঝলেন যে, বাড়ির মেয়েদেরও চাকরি করা দরকার। তাই খুব অভাবেও মেয়েদের লেখাপড়ায় জোর দিয়েছিলেন পূর্ব বাংলা থেকে আসা বাড়ির বড়রা। তারপর এই মেয়েরাই হাসপাতালের নার্স, ইস্কুলের দিদিমণি, টেলিফোন অফিসের কেরানি হয়ে হাল ধরেছিলেন বাড়ির।” দেশভাগ মানে যে শুধু নতুন সীমান্ত নয়, বহু মানুষের জীবন পাল্টে যাওয়া আমূল, ছোটদের মতো করে সে কথা বলেছেন অন্বেষা।

ভাষার আধিপত্যের প্রশ্নে অন্যান্য জাতীয় ভাষার উপর হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টার কথা বলে আরও একটি প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেন দেবারতি বাগচী, “অসমের মিসিং উপজাতির মানুষেরা অসমীয়া ভাষার সঙ্গে লড়াই করে চেষ্টা করছেন অসম রাজ্যে নিজেদের ভাষা টিকিয়ে রাখার। বাংলা-নেপালির ঝগড়ার খবরে চাপা পড়ে গিয়ে উত্তরবঙ্গের টোটো ভাষাও কোনও রকমে টিকে আছে... আচ্ছা, গোটা দেশের একটাই ভাষা হওয়া উচিত, না কি উচিত নয়, এই ঝগড়ায় কি এঁরাও গলা মেলাতে পারেন?” এবং, সেখান থেকেই পৌঁছে যাচ্ছেন গভীরতর প্রশ্নে— “তাহলে, ‘দেশের’— এই শব্দটার মানে কী? ‘জাতীয়’ কাকে বলে? যা সকলের, নাকি যা সকলকে মানতে হবে?” এই প্রশ্নগুলো বয়েছে বইয়ের একেবারে শেষে। তাতে পৌঁছনোর পথটি দেবারতি নির্মাণ করেছেন যুক্তির পিঠে যুক্তি সাজিয়ে, যাতে শেষ প্রান্তে পৌঁছে ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের মতো করে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে পারে।

বিষয়গত ভাবে ছোটদের পক্ষে সবচেয়ে জটিল ছিল সম্ভবত নাগরিকত্বের প্রশ্নটি। তিস্তা দাস যে ভঙ্গিতে বুঝিয়েছেন, তা ঈর্ষণীয়। তাঁর লেখায় গোড়া থেকেই অবস্থানটি স্পষ্ট— নাগরিকত্বের সংজ্ঞার দোহাই দিয়ে কোনও নির্দিষ্ট ধর্মের মানুষকে হয়রান করা অন্যায়। নয়া নাগরিকত্ব আইন যে ভাবে প্রতিবেশী দেশ থেকে আগত ইসলাম ব্যতীত অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষদের নাগরিকত্ব স্বীকার করার কথা বলে, তার অন্যায্যতার কথা স্পষ্ট বলেছেন তিস্তা— “দেশের নেতারা অনেক সময় এমন নিয়ম-নীতি তৈরি করেন, যাতে কারও বিশেষ সুবিধা হয়, আবার কারও বিশেষ অসুবিধা... কখনও আবার কেবলমাত্র নিয়মের দোহাই দিয়ে সরকার আর তার পুলিশ ভারী হেনস্থা করে সাধারণ মানুষকে। তাই নাগরিকের সমান অধিকার সবসময় বজায় থাকে না।” ১৯৫৫, ১৯৮৬, ২০০৩, ২০০৫, ২০১৫ এবং ২০১৯— এই বছরগুলি ধরে একটা তালিকা করে লেখক দেখিয়েছেন, কী ভাবে ক্রমে পাল্টে যেতে থাকল নাগরিকত্বের সংজ্ঞা। বইয়ের শেষ অনুচ্ছেদে লেখা হয়েছে, একটা মস্ত ছাঁকনি যেন সর্ব ক্ষণ তাড়া করছে নাগরিকদের— প্রমাণপত্র, আর নানা মাপের কাগজ জমা করার পালা যেন ফুরোতে চায় না। “এই ছাঁকনি যেন দেশের মানুষকে বিপদে না ফেলে, সেই চেষ্টা করে যাওয়া আমাদের সকলের কাজ, সকল নাগরিকের দায়িত্ব।” ছোটদের বোঝার মতো করে এই কথাটা বলার দায়িত্ব উদারপন্থীদের নিতে হবে, এ ভাবেই।

বইয়ের বাচনভঙ্গি নিয়ে একটা প্রশ্ন অবশ্য থেকে যাচ্ছে। ছোটদের জন্য লেখা মানেই একটু উপর থেকে কথা বলা, কিছু ক্ষেত্রে এই মুদ্রাদোষ প্রকট। দু’এক জায়গায় ভাষার চলনও আড়ষ্ট।

অন্য বিষয়গুলি:

book review Division of India
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy