বিভ্রান্ত হয়ে আর এক বার তুলসীদাসের শ্রীরামচরিতমানস পড়লাম। এক দিকে দেশজোড়া লকডাউন, অন্য দিকে আগামী বুধবার অযোধ্যায় মহাসমারোহে মন্দিরের ভূমিপূজন। এই বিভ্রান্তি কাটাতে স্বয়ং রঘুপতি রাঘবের শরণাপন্ন হওয়াই শ্রেষ্ঠ পন্থা।
আমার বইটি গোরক্ষপুরের গীতা প্রেস থেকে প্রকাশিত। গত শতাব্দীর তিরিশের দশক থেকে এঁরা মানসের বিশ্বস্ত প্রচারক। দ্বিভাষিক বই, বাঁ দিকে বাংলা হরফে মানসের দোঁহা ও চৌপদী, ডান দিকে সুললিত বঙ্গানুবাদ। এই অনুবাদের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য, এখানে নবাহ্ন-পারায়ণ ও মাস-পারায়ণ দুটিই দেওয়া আছে।
মানস তো অন্য সব বইযের মতো শুয়ে-বসে পড়া যায় না। ব্যাসাসনে বসে কথক পড়বেন ও ব্যাখ্যা করে দেবেন। তিনি নয় দিনে গোটা পাঠ সাঙ্গ করতে পারেন, অথবা সারা মাস ধরে। কখনও ৪২ চরণের শেষে বিশ্রাম নিতে হবে, কখনও বা ৫৬০ চরণের শেষে।
তুলসীদাসের রামায়ণে ন’টি কাণ্ড, বালকাণ্ডটি সবচেয়ে বড়। এই দস্যি শিশুর বৃত্তান্তই তুলসীদাসের অন্যতম আকর্ষণ। মা কৌশল্যা খেতে ডাকছেন, শিশু রাম ছুটে পালাচ্ছে। ধুলো মেখে ফিরে এলে রাজা দশরথ তাকে কোলে তুলে নিচ্ছেন। খেতে বসেও শিশুর চাঞ্চল্য কমে না— “ভাজি চলে কিলকত মুখ দধি ওদন ওল্টাই।” মানে, মুখে দইভাত লেগে-থাকা অবস্থাতেও সে খিলখিলিয়ে হাসে। ইনিই রামলালা! এঁর জন্যই মন্দির!
শ্রীরামচরিতমানস
তুলসীদাস
গীতা প্রেস, গোরক্ষপুর, ২০০৮
কিন্তু বইটা শেষ করে চমকে যেতে হয়। রামচন্দ্রের ভক্ত ‘কাকভূশণ্ডি’ নামে কৈলাসবাসী এক অমর কাক। বিষ্ণুবাহন গরুড়কে তিনি রামকথা শোনান। উত্তরকাণ্ডে এসে তিনি জানান, ছোট্ট রামচন্দ্রের সঙ্গে তিনি খেলতেন। শিশু রামচন্দ্র আধো আধো ভাষায় কলকল করতে করতে তাঁকে ধরতে যেতেন, আর তিনি উড়ে পালাতেন। ভক্ত কাকভূশণ্ডী ভাবতেন, এই ছেলেমানুষি আবার কী ধরনের লীলা! তার পর এক দিন শিশু ধরতে যাওয়ার সময় কাক উড়ে পালাল। দূর আকাশে, ব্রহ্মলোকে যেখানেই যায় না কেন, দেখা যায় তার দুই আঙুল পিছনেই শ্রীহরি। ভয়ে কাক উড়তে উড়তে ফের অযোধ্যার রাজপ্রাসাদ। এই বার শিশু হাসল। হাসতেই কাক তার মুখে ঢুকে গেল। সেই মুখগহ্বরে অনেক পাহাড়, অনেক নদী, অনেক ব্রহ্মা, অনেক বিষ্ণু। কিন্তু সব ভুবনেই ভিন্ন রূপে অযোধ্যা, দশরথ, কৌশল্যা ও রাম-লক্ষ্মণ। বহু ব্রহ্মাণ্ডে এই ভাবে শতকল্প কাটিয়ে কাকভূশণ্ডী আবার চলে এলেন শিশু রামের কাছে। যেন মাত্র দুই পলকে ঘটে গেল এ সব মায়ার খেলা। দশরথ, কৌশল্যা এবং অন্যরা কিছু জানতেও পারলেন না। তাঁর বাল্যক্রীড়াতেও ভক্ত আসলে বিশ্বরূপ খুঁজে পায়। হামা দেওয়া এবং দুষ্টুমি করা তাঁর সচেতন লীলাখেলা।
এই বিশ্বরূপ দর্শানো রামলালার মন্দির গড়া যায়? তিনি তো শুধু ভক্তের হৃদয়ে থাকেন। কাকভূশণ্ডী আরও জানিয়েছেন, রামরাজ্যে কেউ শত্রু নয়, তাই সেখানে ‘জয় করো’ শব্দবন্ধটি কেবল মনকে জয় করার জন্যই ব্যবহৃত হয়। সকলেই অনুকূল, তাই ভেদনীতি প্রয়োজন হয় না।
এর পর কলিযুগে সাধুসন্তদের লক্ষণও জানিয়েছেন তুলসীদাস। “যে গলাবাজি করে, তাকেই কলিযুগে পণ্ডিত বলা হয়। মিথ্যাচারী ও দাম্ভিক সন্ত বলে পরিচিতি পায়। যে অসৎ পথে ধনসম্পদ আহরণ করে, কলিযুগে তাকেই বুদ্ধিমান বলা হয়।” শ্রীরামচরিতমানস আসলে মধ্যযুগে এক সন্ত ও কবির মানবচরিত্রের নিপুণ পর্যবেক্ষণ। ব্রহ্মা দক্ষকে যোগ্য ভেবে প্রজাপতিদের মধ্যে অগ্রগণ্য করে দিয়েছেন। পদ পেয়ে দক্ষের মাথা ঘুরে গেল, সে শিবনিন্দা শুরু করল। তুলসী লিখছেন, “নহি কোউ অস জনমা জগ মাঁহী।” মানে, পদমর্যাদা লাভ করে অহঙ্কারযুক্ত হয় না, এমন লোক জগতে বিরল। মারীচ রাবণকে বোঝায়, সে সোনার হরিণ সাজলে বিপদ। রামচন্দ্রের সঙ্গে শত্রুতার ফল ভাল হবে না। রাবণ তাকে অপমান করে। মারীচের হৃদয়ঙ্গম হয়, সামর্থ্যযুক্ত প্রভু, মূর্খ, ধনী, কবি ও পাচক এদের সঙ্গে শত্রুতার ফল ভাল হয় না। কবিরা তখন থেকেই বিপজ্জনক!
একুশ শতকে শ্রীরামচরিতমানস-কে তা হলে কী ভাবে দেখলাম? মধ্যযুগের কাব্যে যে দোষ থাকে, মানে নারীবাদী ও সাব-অল্টার্ন তাত্ত্বিকেরা কয়েক জায়গায় বিরক্ত বোধ করতে পারেন। “জো বরণাধম তেলি কুমহারা স্বপচ কিরাত কোলবারা।” মানে তেলি, কুমোর, কোল, ভিল, শুঁড়ি, চণ্ডাল প্রভৃতি বর্ণের লোকেরাও কলিযুগে সন্ন্যাসী সেজে বসে থাকে। কিন্তু এ-ও বাহ্য! অযোধ্যার বিখ্যাত কথাবাচক, অঞ্জানিনন্দন শরণ বলতেন, “ওই ভাবে মানস বোঝা যায় না। কাক তো সবচেয়ে অপবিত্র, উচ্ছিষ্টভোজী। কিন্তু সেই কাকভূশণ্ডি এখানে বিষ্ণুবাহন গরুড়কে রামকথা শোনায়।” মধ্যযুগে টেক্সটের নিরুচ্চার ভাঁজগুলি চমকপ্রদ।
রাম, লক্ষ্মণরা ছাড়াও কত যে দরিদ্র, নিরন্ন চরিত্র! গ্রামের লোকেরা বনগামী রাজপুত্রদের চেনে না, ঘড়ায় জল এনে বলে, “আপনারা ক্লান্ত, একটু জিরিয়ে নিন। আমরা গ্রামে থাকি, তাই গুছিয়ে কথা বলতে পারি না। আপনারা কে?” গুপ্তযুগের নগরসভ্যতায় বাল্মীকি বা কালিদাসের মতো দেবভাষার কবিদের গ্রামের লোক জনের প্রতি এই দরদ ছিল না। কিন্তু তুলসী তাঁর কাব্য রচনা করছেন সাধারণ মানুষের অবধী ভাষায়। গ্রামজীবন থেকে উঠিয়ে এনেছেন উপমা। মন্দোদরী রাবণকে বোঝাচ্ছেন, “আপনি বরং সীতাকে ফিরত দিন।” রাবণ বলছেন, নারী সতত ভীরু আর নির্বোধ। তুলসী এর পরই বলেন, মেঘ জল ঢাললেও বেতগাছে তার প্রভাব পড়ে না। চার রাজপুত্র বিয়ে করে ফিরছেন, ডান দিকে শস্যক্ষেত্রে কাক, বাঁ দিকে নীলকণ্ঠ পাখি, খেঁকশিয়াল ছুটতে ছুটতে ঘাড় ফিরিয়ে দেখে। অযোধ্যায় ফেরার পর মায়েরা পুত্র ও পুত্রবধূদের বরণ করতে নিয়ে আসেন হলুদ, দুধ, দই, পান, ফুলপাতা, চাল, গোরোচনা ও খই। তুলসীদাস মানে এ দেশের জীবন্ত জনসংস্কৃতি।
রামচরিত বার বার বলে, এই সংস্কৃতিতে রামচন্দ্র শুধু দশরথতনয় এবং অযোধ্যার রাজপুত্র নন। তিনিই ব্রহ্ম। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর থেকে দেবরাজ ইন্দ্র সকলে তাঁর শরণাগত। মানুষ তাঁর প্রিয় বলেই তিনি লীলাখেলায় আবির্ভূত হন। কাশীতে মরলে মানুষ মুক্ত হয় কেন? শিব সেখানে মুমূর্ষুর কানে তাঁর নিজ গুরু রামচন্দ্রের নাম জপ করেন। রাক্ষসবধ? অরণ্যকাণ্ডে রামচন্দ্র সীতাকে বলেন, “প্রিয়ে, এ বার কিছু নরলীলা সম্পন্ন করব। তুমি কিছু দিন অগ্নির মধ্যে বাস কর।” সীতা অগ্নিতে গেলেন, রেখে গেলেন তাঁর ছায়ামূর্তি। রাবণ তাকেই অপহরণ করল, তা নিয়েই যুদ্ধ হল। লঙ্কাধ্বংসের শেষে অগ্নি তাঁকে রামের কাছে ফেরত দিয়ে গেলেন।
কিন্তু ধরিত্রী তখনও রাক্ষসশূন্য হল না। পরে উত্তরকাণ্ডে ভরতকে রাম বলবেন, যারা সর্বদা অন্যের শত্রুতা করে, পরস্ত্রী, পরসম্পদ আর পরনিন্দায় আসক্ত, তাদের রাক্ষস বলাই সমীচীন। এমন দুষ্ট ব্যক্তি সত্য ও ত্রেতাযুগে কম, কিন্তু কলিকালে তারা বহুসংখ্যক। রামচরিত পড়ে বুঝলাম, কলিকালে আজ রাক্ষসদেরই একাধিপত্য!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy