গুরুভ্রাতা: শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী শিষ্যরা। ১৮৯৬ সালে আলমবাজার মঠে তোলা মূল আলোকচিত্র থেকে ডি মার্শালের আঁকা ছবি
দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের পাঁচ টাকা মাইনের পূজারি তাঁর অবসর সময়ে ভক্তজনদের কিছু বলতেন, এক জন স্কুল মাস্টার শ্রদ্ধার সঙ্গে সব শুনে বাড়ি ফিরে এসে তা নোট বইতে লিপিবদ্ধ করলেন। তার কয়েক দশক পরে খণ্ডে খণ্ডে নিজের খরচে যে বই বার করলেন, তা শ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত রূপে প্রথমে বাংলায়, পরে ইংরেজিতে বিশ্ববিজয় করল।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পূজারি বাউনের ভাগ্য ভাল, তাঁর সময়ে ফোটোগ্রাফির জয়যাত্রা সবে শুরু হয়েছে এবং তাঁর কয়েকটি আলোকচিত্র আমাদের কাছে এসেছে, যা বুদ্ধ, খ্রিস্ট, শঙ্করাচার্য, শ্রীচৈতন্য কারও ক্ষেত্রে ঘটেনি। তবে শ্রীরামকৃষ্ণ ফটোচিত্রের সংখ্যা আর ক’টি! ক্যামেরা যন্ত্রে তোলা সব ক’টি ছবিও হাতে নেই, তাঁর ডাক্তার ভক্ত রাম দত্ত যে-সব ছবি তুলেছিলেন, অজ্ঞাত কারণে তার নেগেটিভ গঙ্গার জলে ফেলে দিয়েছিলেন।
বাকি ছবির কোনটা কী ভাবে কোন কোম্পানির কোন আলোকচিত্রী কোথায় তুলেছিলেন, ছবির নায়ক কী ভাবে প্রফেশনাল ফোটোগ্রাফারের স্টুডিয়োতে এলেন, সে নিয়ে দেশি-বিদেশি বিশেজ্ঞদের যথেষ্ট কৌতূহল আজও অব্যাহত।
শ্রী রামকৃষ্ণ: আ ডিভাইন লাইফ ইন পিকচার্স
স্বামী চেতনানন্দ
৩৯.৯৫ (আমেরিকান ডলার)
বেদান্ত সোসাইটি অব সেন্ট লুইস
তাঁর প্রথম আলোকচিত্র কবে এবং কোথায় কী ভাবে তোলা হল, সে সম্বন্ধে খুঁটিনাটি খবর স্বামী চেতনানন্দ সযত্নে সংগ্রহ করে রেখেছেন। তারিখ ২১ সেপ্টেম্বর ১৮৭৯, ছবি তোলার উদ্যোক্তা কেশবচন্দ্র সেন, স্থান সার্কুলার রোডের বাড়ি ‘কমল কুটীর’-এ। কে এই ছবি তুলল তার সন্ধান দিলেন দক্ষিণ ক্যালিফর্নিয়ার আমেরিকান ভক্তরা, একটা ছবির পিছনে রয়েছে উল্লেখ, ‘দ্য বেঙ্গল ফোটোগ্রাফার্স, প্রতিষ্ঠা ১৮৬২’। একশো বছর পরে (১৯৬৩) আমেরিকান গবেষক সন্ন্যাসী স্বামী বিদ্যাত্মানন্দ ওই ঠিকানায় গিয়ে স্টুডিয়োর খোঁজ পেলেন না; আমেরিকান সন্ন্যাসী খুঁজছিলেন ছবির প্লেট।
আরও খবর সংগৃহীত হয়েছে— শ্রীরামকৃষ্ণ চাইতেন না যে, কেউ তাঁর ফটো তুলুক, তিনি সমাধিস্থ না হলে তাঁর ছবি তোলা যেত না।
দ্বিতীয় ছবিটির তারিখ শনিবার ১০ ডিসেম্বর ১৮৮১, রামকৃষ্ণের পরিধানে একটি ধুতি, একটি লম্বা হাতা পাঞ্জাবি ও একটি কোট, পায়ে চটি জুতো, ছবির পিছনে তারিখ ১০ ডিসেম্বর ১৮৮১। “সুরেন্দ্রনাথ মিত্র তাঁকে গাড়ি করিয়া বেঙ্গল ফোটোগ্রাফার্স স্টুডিয়োতে লইয়া গেলেন, ফোটোগ্রাফার দেখাইলেন কী রূপে ছবি তোলা হয়।” কাচের পিছনে কালি মাখানো হয়, তার পর ছবি ওঠে। এই দ্বিতীয় ছবি নিয়ে আজও যথেষ্ট গবেষণা, শ্রীরামকৃষ্ণ কি জুতো পরেছেন? পরে গবেষকরা বলেছেন, ধুতির নীচে তাঁর পদযুগল ছায়ায় আচ্ছাদিত, তাই কালো দেখাচ্ছে। চটি জুতো স্পষ্ট দৃশ্যমান।
বিদেশি সন্ন্যাসীরা জানাচ্ছেন, এই আলোকচিত্র থেকে ঠাকুরের প্রথম তৈলচিত্র তৈরি হয়েছিল; তার তারিখও পাওয়া যাচ্ছে। এর খবরও যে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত-তে রয়েছে, তা-ও আমরা জানি। এই চিত্রের প্রিন্ট যে ঠাকুর দেখেছিলেন, তার ইঙ্গিতেও খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু কে এই তৈলচিত্র অঙ্কন করেছিলেন? অদ্বৈত আশ্রমের নেগেটিভে একটি অস্পষ্ট স্বাক্ষর দেখা যায়, কিন্তু তিনি যে কে, তা আজও আবিষ্কারের অপেক্ষায়।
এ বার সেই বিখ্যাত চিত্র, যেখানে একটি সাদা কাপড় পরে কটিদেশ ও উরু আবৃত করে ঠাকুর বসে আছেন দক্ষিণেশ্বরে রাধাকান্ত মন্দিরের পশ্চিম দিকে। বরাহনগরের ভক্ত ভবনাথ ঠাকুরের এই ছবি তুলতে চায়, বরাহনগর থেকে এক ফোটোগ্রাফার চলে আসেন, এই ছবি তোলার ডিরেকশন নরেন্দ্রনাথ অর্থাৎ স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দের, এই ছবি দেখেই ঠাকুর বলেছিলেন— “এই ছবি কালে ঘরে ঘরে পূজা হবে।” ফোটোগ্রাফার অবিনাশচন্দ্র দাঁ ১৮৮৩ অক্টোবর রবিবার সকাল সাড়ে ন’টায় এই ছবি তোলেন। এই তারিখ নিয়ে অবশ্য মতভেদ আছে; অন্যতর মত হল, তারিখটি ২ ফেব্রুয়ারি ১৮৮৪। স্বামী অভেদানন্দ লিখেছেন, এই ছবির কাচের নেগেটিভ দাঁয়ের হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল এবং মূল ছবিটি রক্ষা করে দাঁ উপরিভাগ গোলাকারে কেটে দিয়েছিলেন। মূল প্রতিচিত্রের সংখ্যা ছিল ছয়টি।
শ্রীরামকৃষ্ণের চতুর্থ ও পঞ্চম আলোকচিত্র তোলা হয়েছিল তাঁর মহাসমাধির পরে কাশীপুরে ১৬ অগস্ট ১৮৮৬, এ বারেও বেঙ্গল ফোটোগ্রাফারের উদ্যোক্তা ঠাকুরের চিকিৎসক ডা. মহেন্দ্রলাল সরকার, তিনি এই ছবি তোলার জন্য দশ টাকা দিয়েছিলেন।
দ্বিতীয় আলোকচিত্রে ফিরে আসা প্রয়োজন। যাঁর ছবি তিনি নেই, যে স্টুডিয়োতে ছবি তোলা তা-ও নেই, কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণের পাঞ্জাবি ও কোটটি রয়ে গিয়েছে, যা পরবর্তী কালের গবেষকদের খুব কাজে লেগে গিয়েছে। ভক্তরা শ্রীরামকৃষ্ণের দৈর্ঘ্য কখনও মাপ করেননি। স্বামী নির্বাণানন্দ কোটটি মেপে ও কোটটির সঙ্গে আকৃতির সম্বন্ধ হিসাব করে অঙ্ক কষে বার করলেন ঠাকুরের দেহের দৈর্ঘ্য— ৫ ফুট সাড়ে ৯ ইঞ্চি। এই স্থিরচিত্র পরবর্তী কালে, শ্রীরামকৃষ্ণের প্রথম মর্মরমূর্তি তৈরির সময় খুব কাজে লেগে গিয়েছিল। কলকাতায় তৈরি এই মূর্তি এখন বারাণসী অদ্বৈত আশ্রমে।
এই আলোকচিত্র থেকেই শ্রীমা সারদামণির উক্তি— “এখানকার লোক সব সেয়ানা— ছবিটা তুলে নিয়েছে। কোন অবতারের কি ছবি আছে?” জননী সারদা আরও বলেছেন, “ছবি তো তাঁরই ছায়া। তাঁর ফটো দেখলেই হবে। ফটোতে তিনি স্বয়ং রয়েছেন।”
এখন প্রশ্ন, জীবিতকালের তিনটি আলোকচিত্র ও একটি তৈলচিত্র থেকে কী ভাবে আমেরিকায় অর্ধ শতাব্দী সময় ব্যয় করা সেন্ট লুইস বেদান্ত সোসাইটির সভাপতি, একদা খুলনার রিফিউজি স্বামী চেতনানন্দ এই ৬৩৯ চিত্রের রামকৃষ্ণ গ্রন্থ প্রস্তুত করলেন?
সম্পাদক স্বামী চেতনানন্দ বললেন, এই চিত্রমালার সংগ্রহ ও পরিকল্পনা সেই ১৯৬০ সাল থেকে।
“আমেরিকা থেকে কয়েক বছর অন্তর আমি ভারতবর্ষে যাই এবং দু’তিনটি ক্যামেরা ও যথেষ্ট কোডাক ফিল্ম নিয়ে ঠাকুর সংক্রান্ত দশ হাজার ছবি তুলি।”
এই বইতে রামকৃষ্ণের সমকালীন ব্যক্তিত্বের ছবিগুলির পুনরুদ্ধার ছিল মস্ত কাজ।
বিভিন্ন উৎস থেকে সমসাময়িক কালের ভক্ত ও ভক্তিমতীদের ছবি স্বামী চেতনানন্দ সংগ্রহ করেছেন। যেমন গদাধরের সহপাঠী গয়াবিষ্ণু লাহা ও হারাধন দত্ত।
খ্যাত-অখ্যাত সমকালের মানুষদের অনেক ছবি উদ্ধার করেছেন স্বামী চেতনানন্দ। সমকালের কোনও চরিত্র, জায়গা বাদ যায়নি। কঠিন এই কাজে যাঁরা তাঁকে বিশেষ সহায়তা করেছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন কিম কেন্ট, শুদ্ধপ্রাণা ও লিন্ডা প্রু।
একই বইতে এমন রামকৃষ্ণকেন্দ্রিক চিত্রসংগ্রহ এর আগে কস্মিনকালেও প্রকাশিত হয়নি, যার সঙ্কলন ও মুদ্রণ ব্যয় বহন করেছেন আমেরিকান ভক্ত ও প্রবাসী ভারতীয়েরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy