মোমেনশাহী উপাখ্যান
অমর মিত্র
৩৯৯.০০
দে’জ
“এই উপন্যাস ময়মনসিংহ গীতিকার কাহিনী নয়, গীতিকার আখ্যান সামান্য সূত্র মাত্র”— ‘গোড়ার কথা’য় বলেছেন অমর মিত্র। আর তার পর ‘পাতাল আন্ধার বৃত্তান্ত’, ‘লীলাবতী, খবরিয়া ও আয়না বিবির বৃত্তান্ত’ এবং ‘বুনো হাঁসের উড়াল’ নামে তিনটি পর্বে দেখিয়েছেন গীতিকা-র বাইরের জীবন কোন মহিমায় সৃজন করল গারো পাহাড়ের দেশের চিত্ররূপ। আবার এমনও বলা যায় যে, গারো পাহাড়ের দেশ কোন গভীরতায় নিজের সর্বাঙ্গে মেখে নিল গীতিকা-র বাইরের জীবনকথা। চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি গারো পাহাড়ের দেশের রাজা জানকীনাথের রানি হলেন পরমাসুন্দরী কমলা, যে রানির ইচ্ছায় কমলাসায়র খনন। কমলাসায়রের পালা মর্মস্পর্শী হয়ে উঠেছিল কবি অধরচন্দ্রের ময়মনসিংহ গীতিকা-য়। একুশ শতকে সে আখ্যানের নবরূপ গাঁথা হচ্ছে সোমেশ্বরী উপনিবেশের সুধীন্দ্র-কুমুদিনীর কল্পনায়। রানি কমলাকে প্রাণ দিতে হয়েছিল অধরচন্দ্রের কমলাসায়রে জল আনতে। আর কলকাতার সোমেশ্বরী উপনিবেশে যে দিঘিকে কমলাসায়রে চিহ্নিত করেছেন সুধীন্দ্র-কুমুদিনী, সেখানে আবর্জনা ফেলে ফেলে জলাভূমি বুজিয়ে স্থল জেগে উঠবে উন্নয়নের প্রয়োজনে, অগ্রগমনের চাপে, আন্তর্জাতিক নাগরিকত্ব আর আবিশ্ব আধুনিক আবাহন-যজ্ঞের তাগিদে।
পৃথিবীর প্রাকৃত সম্পদের উপরে মানুষের অবিমৃশ্যকারী অত্যাচারের আখ্যান, মনুষ্যেতর প্রাণিজগতের উপরে আধুনিক মানুষের জোরজুলুমের গল্প অমর মিত্র ফিরে ফিরেই লিখেছেন। বর্তমান উপাখ্যানে এসে পড়েছে দেশভাগের ব্যথা-বেদনা, নিজদেশ হঠাৎ করে পরদেশ হয়ে যাওয়ার শূন্যতা, বাংলার এ পারে-ও পারে ময়মনসিংহ গীতিকা-র নতুনতর সংযোজন। সেই সংযোজনে মহাকালের অর্গলকে নস্যাৎ করে ১৭৭০-৮৪’র হাতিখেদা আন্দোলনের ১৭৭৫-এর পাগলপন্থী আন্দোলনের প্রবক্তরা, তারও কত শত বছর আগে কমলারানিকে যারা সায়রে জলের আবাহনকল্পে আত্মবিসর্জন দিতে দেখেছিল, তারা ভিড় করেছে একুশ শতকের মোমেনশাহী উপাখ্যান-এ।
“হাতি খেদানো মহা পাপ... হাতি খেদাইলে গারো পাহাড়ের বুকে ব্যথা লাগে... হাজং মানে মাটির পোকা... মাকড়, ফসল ফলাইতে মুদের জন্ম” (পৃ ১৪৮)— এই উচ্চারণে শামিল হয়েছিল যারা, তাদেরই এক জন অথৈচন্দ্র হাজং, পাহাড়িয়া মায়ের মেয়ে লীলাবতীর প্রেমিক অথৈ আজ অস্থির মিঞা; একুশ শতকে অবিরত গ্রন্থনে বর্ধমান ময়মনসিংহ গীতিকা-র সন্ধানে এ পার থেকে ও পার বাংলায় ফেরা বিপুল সোমের সামনে দাঁড়িয়ে অস্থির বেল-চা বানায়। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ যেন অনায়াসে হয়ে যায় একুশ শতকের নতুন গীতিকা-নয়’এর অংশ। অস্থির বলে, “...মুদের ইদেশে তো কবি আর পালাকারের অভাব নাই... যত কিসসা, তার চেয়ে বেশি কিসসাদার কবি, একই কিসসা কতরকমে লিখা হইসে...” (পৃ ১৮৭)। যেন বুঝিয়ে দেয় অস্থির, ইতিহাসের দায় দেহে-মনে বইতে বইতে, দুই শতক অতিক্রান্ত অথৈ মিশে আছে তার অস্থিরতায়। আবার সুধীন্দ্র-কুমুদিনীর কমলাসায়র আখ্যানে কল্পিত এক বাণেশ্বর খবরিয়ার বংশের ইমতিয়াজ আলি চন্দ্রকুমার অর্থাৎ চাঁদু খবরিয়া একুশ শতকের নতুন গীতিকার খবর করতে ভারত-বাংলাদেশ উড়ানে যায় আসে, আসে যায়। মহাকালের অর্গল ভেঙে অথৈ হাজং-এর প্রেমিকা লীলাবতী (লীলাময়ী-লীলাবতীর টানাপড়েন কী প্রবল অসম্মানের!) বুড়ো ত্রিলোচন গনতকারের তিন নম্বর বৌ হয়েছিল। আজ কি সেই লীলাবতী আয়নাবিবি হয়ে চন্দ্রকুমারের ঘরে যায়? আয়নাবিবির স্বামী আরব থেকে ফেরে না। সুধীন্দ্রর আমেরিকা-প্রবাসী সফল পুত্র প্লাবনেরও তো সময় নেই দেশে থেকে নিরুদ্দিষ্ট পিতাকে খোঁজার। সুধীন্দ্র থেকে অতীন, অতীন থেকে সুধীন্দ্র, গীতিকা-র নিত্যনতুন সংযোজকের শেষ নেই।
চাঁদু খবরিয়ার ‘চন্দ্রকুমার’ নামটিতেও কি মিশে আছে মহাকাব্যের রেশ? দীনেশচন্দ্র সেন সঙ্কলিত মৈমনসিংহ-গীতিকা প্রথম খণ্ড দ্বিতীয় সংখ্যার ‘ভূমিকা’ অংশটিতে প্রথম বিভাগের শিরোনাম ‘এই গাথাসমূহের সংগ্রাহক চন্দ্রকুমার দে’। প্রাচীন মহিলা কবি চন্দ্রাবতী প্রসঙ্গে চন্দ্রকুমারের লেখা নিবন্ধ দীনেশচন্দ্রের নজরে আসে ১৯১৩-র সৌরভ পত্রিকায়। ময়মনসিংহের বহুজনকে প্রশ্ন করেও সেখানকার পল্লিগাথা প্রসঙ্গে তাচ্ছিল্য ছাড়া আর কিছুর হদিশ পাননি দীনেশচন্দ্র। ভূমিকায় আছে, “কেহ কেহ ইংরাজী শিক্ষার দর্পে উপেক্ষা করিয়া বলিলেন, “ছোটলোকেরা, বিশেষতঃ মুসলমানেরা, ঐ সকল মাথামুণ্ডু গাইয়া যায়, আর শত শত চাষা লাঙ্গলের উপর বাহুভর করিয়া দাঁড়াইয়া শোনে। ঐ গানগুলির মধ্যে এমন কি থাকিতে পারে যে শিক্ষিত সমাজ ততপ্রতি আকৃষ্ট হইতে পারেন?”” যদি ফিরে আসি উপন্যাসটির ‘গোড়ার কথা’য়, দেখব ঔপন্যাসিকের স্বীকারোক্তি— “বাবা ঋণ সালিশী বোর্ডের শুনানি করে বেড়াতেন... ময়মনসিংহ জেলার গ্রামে গ্রামে। তখন আমি জন্মাইনি... বাবার কাছে শুনেছি ঋণগ্রস্ত চাষীদের কথা। ঋণ মকুবের কথা। ৪৩-এর মন্বন্তরের কথা বলতেন মা... ময়মনসিংহর কথা লিখব, না ময়মনসিংহর গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে থাকা গীতিকবিদের কথা...? যাঁদের ঋণের কথা শুনতেন বাবা তাঁদের কথা? বাবা যা পারেননি, সেই না পারা কথা লিখব? ঋণ আমাদের। আমি সেই ঋণ শোধ করি।”
দীনেশচন্দ্র শিক্ষিতজনের যে উপেক্ষা দেখেছেন, তা পেরিয়েই তো চন্দ্রকুমারের সঙ্গে তাঁর বিনিময়! অমরের উপন্যাসের চলনে বিপুল সোম আর চাঁদু খবরিয়ার যৌথ অভিজ্ঞতায় দেখি, পাহাড় আসলে হস্তী, অচল হস্তী, নাকি পাহাড়ের ডানাগুলো মেঘ, এক কালে পাহাড় উড়ে বেড়াত (পৃ ১৬৭); টঙ্ক প্রথার বিরুদ্ধে হাজং কৃষক বলে, সব ধান জমিদারের খামারে তুলে দিলে কী দিয়ে ভরবে ভুখা পেট (পৃ ২৫৭-৫৮); গীতিকার বাইরের এ সব আখ্যান কখনও বলেন ও পারের নতুন আখ্যানকার অতীন, কখনও বা এ পারের কোনও নিরুদ্দিষ্ট বা অনাগত। দেনা শোধ করার দায় নিয়ে জীবন থেকে উপাখ্যানের দিকে যাত্রা। কোনও ইচ্ছাপূরণের দ্বারস্থ না হয়ে গুরুভার ব্যর্থতা বহন করে ফিরে আসা উপাখ্যান থেকে জীবনে। তাই বুঝি উপাখ্যানের অন্তিমে কালক্রম যথাবিহিত সাজিয়ে দিয়েছেন লেখক। যে ক্রমকে উপাখ্যান জুড়ে ভেঙেচুরে, হাতির অচল পাহাড় হয়ে যাওয়াকে, পাহাড়ের ডানা অকেজো হয়ে যাওয়াকে, বা এমন আরও কতশত প্রাকৃত বেদনাকে যুগযুগব্যাপী পথচলতি মানুষের চেতনায় বিদ্ধ করা; শেষ যেন বলে দেওয়া, ও তো ছিল আখ্যানকারের সৃজন, কালানুক্রমিক এই ইতিহাসযাপন গেঁথে তার নির্মাণ। সে গ্রন্থনায় যা কিছু ভাঙন, সবই তো শিল্পের সত্যে জীবনের সত্যি-মিথ্যেকে মেলাতে, অথবা গরমিলকে চেনাতে।
এ আখ্যানের শেষ নেই। টঙ্কের পর তেভাগা, কৃষকের প্রতিরোধের বয়ান যেন তৈরি হল বুনোহাঁসের লিখনে, তবু না লেখা রয়ে গেল আরও কত চিত্ররূপ। এমন উপাখ্যান যে কলমে লেখা হবে, তাকে যে হতে হবে ছবি লেখার কলম, সে শর্ত অমর মিত্রের সাহিত্যিক অভিজ্ঞতায় স্পষ্ট হওয়াই স্বাভাবিক। অমর পাঠককে বুঝতে দেন না, তিনি আধুনিকের বর্বরতা বিছিয়ে ফিরে দেখছেন ইতিহাসের ওঠাপড়া; নাকি লোককথা আর ইতিহাসকে বিনিসুতোয় বেঁধে বেঁধে দেখাচ্ছেন যে, আধুনিকের অমানবিকতার উৎস প্রোথিত ছিল মানবসভ্যতার আদিতেই। যেন ময়মনসিংহ গীতিকা-র পেলব প্রেমকাহিনির সন্ধানে বেরিয়ে লেখক না চাইতেই পেয়ে যাচ্ছেন গীতিকায় অনুক্ত কত রাজনীতির কথা, কত নির্মমতা-বঞ্চনার কথা, কত শোষণ-অত্যাচার আর তার সার্থক-অসার্থক বিরুদ্ধাচরণের আলেখ্য। তাই অগুনতি পালাকার, আরও অগুনতি পালার বিষয় নিয়ে এগিয়ে চলেছে একুশ শতকের ঋণশোধের কাহিনি।
যাত্রা শুরুর শূন্যতা যে কত দূর মর্মান্তিক, তা বুঝতে বুঝতেই পাঠক মোমেনশাহী উপাখ্যান-এর তিন-তিনটি পর্ব পরিক্রমা করে ফেলেন। আর শেষে এসে বোঝেন, না, বিষয় এখানে ময়মনসিংহ গীতিকা নয়; দেশহীন সফল মানুষের অসার্থক ঋণশোধের প্রয়াস দেশজ প্রকৃতি আর প্রাকৃত জীবনপ্রবাহের কাছে— এই বুঝি বিষয়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy