Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
পুস্তক পরিচয় ১

রোমাঞ্চ অটুট, তবু যেন আগের স্বাদ নেই

হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য কার্সড চাইল্ড’ নাটকের একটি জায়গায় হ্যারি মেজাজ হারিয়ে নিজের মধ্যম সন্তান অ্যালবাস সেভেরাস পটারকে বলে বসে, ‘... দেয়ার আর টাইমস আই উইশ ইউ ওয়্যারন্‌ট মাই সন’।

হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য কার্সড চাইল্ড। জে কে রোওলিং, জন টিফনি, জ্যাক থর্ন। লিট্ল ব্রাউন, ৮৯৯.০০

হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য কার্সড চাইল্ড। জে কে রোওলিং, জন টিফনি, জ্যাক থর্ন। লিট্ল ব্রাউন, ৮৯৯.০০

পৌলোমী সেনগুপ্ত
শেষ আপডেট: ১৩ অগস্ট ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য কার্সড চাইল্ড’ নাটকের একটি জায়গায় হ্যারি মেজাজ হারিয়ে নিজের মধ্যম সন্তান অ্যালবাস সেভেরাস পটারকে বলে বসে, ‘... দেয়ার আর টাইমস আই উইশ ইউ ওয়্যারন্‌ট মাই সন’। জানতে ইচ্ছে করে হ্যারি পটার সিরিজের এই অষ্টম বইটিকে জে কে রোওলিং ওই একই ভাষায় তিরস্কার করবেন কি না! এই বইটির মূল গল্প যে রোওলিংয়ের মস্তিষ্কপ্রসূত, তা বুঝতে কষ্ট হয় না। প্লটের মারপ্যাঁচ, চরিত্রগুলির মানসিক টানাপড়েন, ছোট-ছোট অলক্ষিত সুতো থেকে এক মসৃণ বস্ত্রের মতো কাহিনির বুনন, সর্বোপরি কয়েকটি আপ্তবাক্য ছড়িয়ে দেওয়া— রোওলিংয়ের মুনসিয়ানা এই গল্পেও অবিচল। কিন্তু চিরকালীন পটার-ভক্তদের কি তিনি খুশি করতে পারলেন? এই বইটিতে জন টিফনি এবং জ্যাক থর্ন তাঁর সঙ্গে কাজ করেছেন। নাটকের আকার দিয়েছেন জ্যাক থর্ন। জন টিফনি নাটকের পরিচালক। নাটকটি মঞ্চস্থ হয়ে গিয়েছে। জ্যাক থর্ন মূলত নাটক, সিনেমা, টিভি ও রেডিয়োর জন্য লিখে থাকেন। একটি দীর্ঘ গল্পকে ছোটখাটো করে বলতে গেলে যে তাড়াহুড়োর ছাপ থাকে, তা পরিষ্কার ধরা যাচ্ছে এই নতুন কাহিনিতে। কিন্তু রোওলিংয়ের বৃহদাকৃতি যেসব বই পাঠকসমাজ মনোযোগ সহকারে পড়েছে, তারা উপন্যাস আকারে এই বইটিও কি পড়ত না? এই প্রশ্ন বারবার মনে আসে। এই বইটিতে হ্যারি, রন, হারমায়নি, এই তিন বন্ধু রয়েছে বটে, তারা একসঙ্গে আগের মতো অ্যাডভেঞ্চার করছে, কিন্তু আগের সেই স্বাদ যেন নেই। তার মূল কারণ, সম্ভবত উপন্যাসের আকারে না লিখে নাটকের আকারে গল্পটির প্রণয়ন। তবে পটার-রোমাঞ্চ এই বইতেও অটুট। ম্যাজিক, হগওয়ার্টস, জাদুশক্তিতে বলীয়ানদের ক্ষমতা দখলের চেষ্টা, শয়তানদের আটকানোর চেষ্টা, সব মিলিয়ে মূল পটার সিরিজের তুলনায় এই বইয়ের আকর্ষণ কম নয়।

হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য ডেথলি হ্যালোজ বইটির ঘটনাবলির পর টেমস দিয়ে বহু জল বয়ে গিয়েছে। আবার বছর উনিশ পর আমরা হ্যারিকে দেখতে পাই এই বইটিতে। সে এখন তিন সন্তানের পিতা। মিনিস্ট্রি অব ম্যাজিকের জাদু-পুলিশ দফতরের বড়কর্তা। হারমায়নি ম্যাজিক মন্ত্রীর পদে আসীন। রন তার যমজ ভাইদের প্রতিষ্ঠিত জোক শপটি চালায়। যেহেতু এটি নাটক, আমরা ভাবতেই পারি, এই তিন মূর্তির চেহারায় পরিবর্তন হয়েছে কিছুটা। কিন্তু গল্পের মূল স্রোত এখানে সরে গিয়েছে হ্যারির ছোট ছেলে অ্যালবাসের দিকে। যে কিনা হগওয়ার্টস স্কুলে হ্যারির শত্রু হাউজ স্লিদারিনের সদস্য। আর তার সবচেয়ে ভাল বন্ধু হল স্করপিয়াস ম্যালফয়। পুরনো হ্যারি ভক্তরা ঠিকই ধরেছেন... স্করপিয়াস ড্রেকো ম্যালফয়ের একমাত্র সন্তান। অ্যালবাস কিন্তু তার বাবার গুণমুগ্ধ নয়। সে বাবাকে নিয়ে অনেকগুলি দ্বন্দ্বে ভোগে। ঝগড়াও করে। কিশোরদের যেমন বাবা-মায়ের প্রতি নানা ক্ষোভ থাকে, তেমন তারও আছে। অ্যালবাসের সঙ্গে দৃশ্যগুলিতে হ্যারি এবং অ্যালবাসকে খুবই বাস্তব চরিত্র বলে মনে হয়েছে। এই অ্যালবাসই ভোলডেমর্টের হাতে খুন হওয়া সেডরিক ডিগরিকে আবার বাঁচিয়ে তোলার চেষ্টায় লিপ্ত হয়। গবলেট অব ফায়ার বইতে বিনা দোষে, শুধু হ্যারির সঙ্গে থাকার অপরাধে নানা গুণের অধিকারী, সুদর্শন কিশোর সেডরিককে প্রাণ দিতে হয়েছিল। একটি জলজ্যান্ত প্রাণকে অকারণে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তাই অ্যালবাস চায় সেডরিককে ফিরিয়ে আনতে। সে চায় অতীতকে পালটে দিতে। গল্পের মধ্যে আনা হয় টাইম টার্নার, যার সাহায্যে অতীত বা ভবিষ্যতে যাতায়াত করা যায়।

পটারের গল্পে সবসময় বন্ধুত্ব এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। এ ক্ষেত্রেও অ্যালবাস ও স্করপিয়াসের বন্ধুত্ব সমস্ত বিপদের মধ্যে দিয়ে খাঁটি হিরের মতো জ্বলজ্বল করে। এমনকী হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য কার্সড চাইল্ড নাটকে খলনায়িকার আবির্ভাব ঘটে বন্ধুত্বের মুখোশ পরেই! আর অ্যালবাস ও স্করপিয়াসকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করার জন্য সে একটি ‘ভাল’ কাজের আড়াল খোঁজে। সেডরিকের দুঃখী বৃদ্ধ পিতার কাছে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া যেন আসল লক্ষ্য। তারপর দেখা যায়, নানা রকম উথালপাথালের মধ্যে দিয়ে পটারপুত্রকে নানা ছলে ভুলিয়ে তার সাহসিকতাকে অন্য লক্ষ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে। যতক্ষণে তারা বুঝতে পারে আসলে কী ঘটছে, ততক্ষণে দেরি হয়ে গিয়েছে।

পুরনো সাতটি পটার বইয়ের বেশ কিছু উপাদান হয়তো পাঠক এই গল্পেও লক্ষ করতে পারবেন। হ্যারির স্বপ্নে তার ছোটবেলার বেশ কিছু ঘটনার দৃশ্য ঢোকানো হয়েছে। বাবার এবং মামা-মামির মতো (রনের বোন জিনি হ্যারির স্ত্রী) অ্যালবাসও পলিজুস পোশনের সাহায্যে লুকিয়ে মিনিস্ট্রি অব ম্যাজিকে ঢোকে। তারাও একটি ম্যাজিকাল ইনস্ট্রুমেন্ট চুরি করে। হ্যারির মতোই অ্যালবাস জেদি, পরোপকার করতে ইচ্ছুক এবং নিজের বিপদের কথা না ভেবে এদিকে-ওদিকে পা বাড়ায়। যদিও হ্যারির মুখ দিয়ে বলানো হয়েছে যে, অ্যালবাস অনেকটাই তার মায়ের মতো, ‘অ্যাকচুয়ালি ইউ আর মোর লাইক ইয়োর মম— বোল্ড, ফিয়ার্স, ফানি— হুইচ আই লাইক— হুইচ আই থিঙ্ক মেকস ইউ আ প্রিটি গ্রেট সন।’ এদিকে অ্যালবাসের অ্যাডভেঞ্চারের মধ্যে বিনা কারণে ঠিক সেডরিকের মতোই প্রাণ হারাতে হয় একটি নিষ্পাপ ছেলেকে, যে কিছুর মধ্যেই জড়িয়ে ছিল না। অর্থাৎ ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। রয়েছে কৈশোরের প্রেম, নিজেদের পুরোপুরি বুঝতে না পারার কষ্ট এবং কিছু করে দেখানোর ইচ্ছেও।

এখানে এসে পাঠকের মনে হতেই পারে, একটি মাত্র বইয়ে, তা-ও নাটকের আকারে লেখা, কী করে একটি পুরো সিরিজের নানা রকম বিষয় আঁটিয়ে দেওয়া হল? আসলে সেই প্রশ্নটা মনে থেকেই যায়, পরিধি অল্প, কিন্তু তাতে নানা ধরনের ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার উপর নাটকের আকারে লিখিত হওয়ায় প্রয়োজনে ব্যাখ্যা করার জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। পটারপ্রেমী মাত্রেই জানে, কিছু-কিছু জিনিস পরিষ্কার করে বুঝিয়ে না দিলে গল্পের মোচড় বোঝা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। আগের উপন্যাসগুলিতে পরিসরের কার্পণ্য না থাকায় চরিত্রদের মানসিক পটভূমি উন্মোচন করা গিয়েছিল অনেকটা ব্যাখ্যা সহকারে, কাহিনিটি বোঝার জন্য যা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সব কিছুর মধ্যে বেশ তাড়াহুড়োর ভাব। যেমন অ্যালবাসের স্লিদারিন হাউজে স্থান পাওয়া এবং সেখানে মানিয়ে নেওয়ার পুরো গল্পটা এত ছোট করে বলা হয়েছে যে, খুবই অতৃপ্তি থেকে যায়। আবার অ্যাক্ট ফোর সিন ওয়ান-এ যখন হ্যারি-রন-হারমায়নির সঙ্গে ড্রেকো ম্যালফয় হাত মেলাচ্ছে, তখনও এই তাড়াহুড়ো! তা সত্ত্বেও গল্পটি ভালই লাগে।

আর ভাল লাগে ডাম্বলডোরকে পোর্ট্রেটের মাধ্যমে আবার ফিরে পেয়ে। তিনি বেশ কিছু উদ্ধৃতিযোগ্য উক্তি করেছেন: ‘টু সাফার ইজ অ্যাজ হিউম্যান অ্যাজ টু ব্রিদ’। হ্যারিকে পিতার দায়িত্ব বোঝাতে গিয়ে তিনি বলেন: ‘ইউ আর সাপোজড টু টিচ হিম হাউ টু মিট লাইফ’। তবে অ্যাক্ট ফোর সিন ফোর-এ অত চোখের জল ঠিক মানা যায় না। অতীতকে বদলাতে গেলে কী ভাবে ভবিষ্যতের ক্ষতি হতে পারে, তা হাতেকলমে দেখানো হয়েছে গল্পের প্লটে, পটারভক্তদের তা ভাল লাগবে। সবচেয়ে চমকদার হল, ড্রেকো ম্যালফয়ের ‘পিতা’ হয়ে ওঠা। তার পিতৃস্নেহ পাঠককে স্পর্শ করবে। নাটকের সেরা চরিত্র হয়তো স্করপিয়াস ম্যালফয়। হৃদয়বান, বাস্তব, বন্ধুত্বপ্রবণ, স্থিতধী এই ছেলেটিকে ভোলা যাবে না।

দু’টি খটকা থেকে যায়। প্রথমত, ডেলফি ছাত্র না হয়েও, কী করে হগওয়ার্টসে ঢোকে আর বেরোয়। অ্যাক্ট টু সিন ফোরটিন-এ ব্যাখ্যার চেষ্টা করা হয়েছে বটে, কিন্তু সে ব্যাখ্যা মেনে নিলে রোওলিংয়ের আগের সাতটি বইয়ের প্লট মোটেই দাঁড়াবে না। দ্বিতীয়ত, ডেলফির জন্মবৃত্তান্ত ড্রেকো ম্যালফয় কেন জানত না? জন্ম যখন ম্যালফয় ম্যানরে, হগওয়ার্টস যুদ্ধের আগে, তা হলে ড্রেকোর জানাটাই স্বাভাবিক! বইতে বহু ছাপার ভুল রয়েছে। আর যে প্রশ্নটি অনেকে করছেন, তা আবার করতেই হচ্ছে। কার্সড চাইল্ডটি আসলে কে? সব মিলিয়ে প্রশ্ন করা যেতেই পারে, রোওলিং কি কখনও এই বইটি নিয়ে ভাববেন, কেন তিনি এটিকে এ ভাবে প্রকাশিত হতে দিলেন! সরাসরি উপন্যাস লিখলেন না...

অন্য বিষয়গুলি:

Harry Potter and The Cursed Child
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy