অমলিন: ফিয়োদর দস্তয়ভস্কি। গেটি ইমেজেস
ফিওদর
ব্রাত্য বসু
৪০০.০০
চিন্তা প্রকাশনী
ডিনার পার্টিতে তুর্গেনেভ বললেন, তোমাকে কথায়-কথায় নাস্তানাবুদ করতে ভাল লাগে ভাই ফিয়োদর। বলতে পারো, তোমার এই সব মানসিক রোগ বা জটিলতা নিয়ে আমরা কী করব? আমরা তো ঠিক তোমার মা নই ভাই ফিয়োদর যে, তুমি কচি খোকা সেজে আমাদের সঙ্গে অসভ্যতা করতে আসবে আর আমরা তোমাকে ছাড় দেব। দুটো লিখতে পারো বলে তো আর গোটা পৃথিবীকে একটা খোলামকুচি ভাবতে পারো না হে তুমি। দস্তয়ভস্কির জবাব, আবার তুমি আমাকে ঈর্ষা করছ। ব্যর্থ লেখক একটা।
বহু দিন বাদে একটা নাটক পড়ে চমৎকার লাগল। চিন্তা নাটক সিরিজ় থেকে বেরোনো, দস্তয়ভস্কিকে নিয়ে ব্রাত্য বসুর ফিওদর। ব্রাত্য কলেজ জীবন থেকে দস্তয়ভস্কির ভক্ত, তাঁর মতো বহুপ্রজ গদ্যকার ও নাট্যকারেরও দেখছি এই নাটক লিখতে ২০১৫ থেকে ২০২০ প্রায় পাঁচ বছর লেগেছে। যত দূর জানি, সিনেমার মতো বা মীরজাফর নাটকে এই দীর্ঘ প্রসবযন্ত্রণা ছিল না। কী লিখব? মন্ত্রী ও নাট্যকার এত দিন বাদে তাঁর নিজস্ব প্যাশনের কাছে ফিরলেন, এ রকম একটা লাইন লিখলে বেশ খোলতাই হয়। কিন্তু লিখতে পারছি না। ভোটে জিতে প্রথম দফার মন্ত্রিত্বে আসার পর ব্রাত্যর প্রথম নাটক ছিল তপন থিয়েটারে, বালিগঞ্জ স্বপ্নসন্ধানীর ব্যানারে
বিজয় তেন্ডুলকরের কন্যাদান। নাটক শেষে আড্ডায় তিনি বলেছিলেন, “জানিস, মঞ্চে উঠতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছিলাম। এটাই তো আমার জায়গা।” ব্রাত্য এ রকমই। মৃগী রোগাক্রান্ত দস্তয়ভস্কির মতো প্যাশনেট। কাঁদবেন, হাসবেন, রেগে যাবেন, নখ-দাঁত বার করে আক্রমণে ফালাফালা করে দেবেন। আবার, দিন কেটে গেলে নিজেই ফোন করে বলবেন, কী রে, কী খবর?
আমি নাটকের লোক নই। সত্যের খাতিরে স্বীকার করা ভাল, ব্রাত্যর রাজনৈতিক মত ও পথের শরিকও নই। এতদ্সত্ত্বেও আমার বাড়িতে নিয়ম করে প্রতি বছর শারদীয় ব্রাত্যজন পত্রিকা থেকে শোভন গুপ্ত সম্পাদিত ব্রাত্য, এবং ব্রাত্য ইত্যাদি হরেক বই পৌঁছে গিয়েছে। বই নিয়ে আলোচনা করতে বসে মনে পড়ল, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় প্রায়শ চশমা হারিয়ে ফেলতেন। এক বার এক সভায় গল্প পড়তে গিয়ে দেখলেন, চশমা নেই। তার পরই ‘দেশলাই আছে’ জিজ্ঞাসা করার ভঙ্গিতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে উদ্দেশ করে হাঁক, সুনীল, চশমা আছে? পরে সন্দীপন লিখেছিলেন, সমবেত হাস্যরোলের মধ্যে প্রায় ঢেউয়ের মাথায় দুলতে দুলতে চশমাটা এগিয়ে আসে। “আমাদের ক্রাইসিসে ভরা বন্ধুত্বের মতো।” বন্ধুত্ব মানে তো শুধু নিয়মিত গুড মর্নিং, গুড নাইট মার্কা নিরামিষ মেসেজ চালাচালি নয়। একটু-আধটু ক্রাইসিসও লাগে! এই ক্রাইসিস জমাট বেঁধেছিল ব্রাত্যর মঞ্চসফল উইঙ্কল টুইঙ্কল নাটকের সময়। দেবেশের নির্দেশনা, দেবশঙ্করের অভিনয় সত্ত্বেও সে নাটকে আমার নাট্যকারের একটু খামতি লেগেছিল। এ তো অঞ্জন চৌধুরীর সিনেমা ধাঁচের ভাল সিপিএম বনাম খারাপ সিপিএম! তার পরেই কয়েক ঘণ্টা ঝগড়া, তুই সাহিত্যের কিছু বুঝিস না। এই নাটকে দস্তয়ভস্কি গাল দেন, “আমি যে কত বড় প্রতিভা, তা এক দিন গোটা পৃথিবী বুঝবে। তার জন্য ভিসারিওন বেলিনস্কির মতো মধ্যমেধার সার্টিফিকেট আমার দরকার নেই।” চমৎকার সংলাপ। কিন্তু দস্তয়ভস্কি-বেলিনস্কি ঝগড়ার কারণে এখানে বেলিনস্কি প্রায় খলনায়ক। দস্তয়ভস্কি তাঁকে বলেন, “আমার লেখার মানে বোঝেন? একদিন আসবে পৃথিবীতে আমি, আপনি থাকব না। কিন্তু আমার লিখিত শব্দগুলি থাকবে। মারী, মড়ক, যুদ্ধ, টর্নেডো, হাজার হাজার রাজা মন্ত্রী কিছু এসেও আমার লেখাকে হত্যা করতে পারবে না।” এই সংলাপে হাততালি পড়বেই। কিন্তু দস্তয়ভস্কির সঙ্গে পরবর্তী কালে পথ আলাদা বয়ে গেলেও রুশ সাহিত্যের পুরোধা সমালোচক ভিসারিয়োন বেলিনস্কি আদতে খলনায়ক ছিলেন না। তাঁর সমালোচনার পথ ধরেই জ়ার-আমলে রুশ সাহিত্যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতার উন্মোচন। ব্রিটিশ নাট্যকার টম স্টপার্ডের শিপরেক নাটকেও বেলিনস্কি এক চরিত্র। অতি-উৎসাহে প্রায়ই ভুল বলতেন। কখনও বলতেন, শেক্সপিয়রের ওথেলো অসভ্য যুগের প্রতিনিধি। কখনও বা, দান্তের থেকে ফার্মিয়োর কুপার ভাল কবি। ইতিহাসের সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই অবশ্য নাট্যকার দেখান, দস্তয়ভস্কির কারাদণ্ডের অন্যতম কারণ ছিল, এক জমায়েতে জ়ারতন্ত্রের বিরুদ্ধে গোগোলকে লেখা বেলিনস্কির চিঠি পড়া। বেলিনস্কি তত দিনে মৃত। কিন্তু শিল্পী, সাহিত্যিকরা কি জনপ্রিয়তার রাজনীতিতে কম ধান্ধাবাজ? দস্তয়ভস্কি বলেন, “বেলিনস্কির সঙ্গে আমার ঘোর বিরোধ এইখানেই যে, তিনি ছিলেন ঘোর নাস্তিক আর আমি ঈশ্বরবিশ্বাসী। তবু যেহেতু জমায়েতের সকলে এই অংশ লুফে নেবে, তাই আমি পড়তে লাগলাম। রক্ষণশীল চার্চ বরং স্বেচ্ছাচারিতারই পৃষ্ঠপোষকতা করছে, বল ও ভরসা হয়ে উঠছে মালিকশ্রেণীর।” বেলিনস্কি এ সব মালিকশ্রেণি-শ্রমিকশ্রেণি জানতেন? সোভিয়েট আমলেও পুরো চিঠির ইংরেজি অনুবাদে রাশিয়ার মানুষের অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের কথা আছে, শ্রেণিবৈষম্যের কথা নেই। থাকার কথাও নয়। ব্রাত্য অবশ্য জানেন, সাহিত্যের সত্য, ইতিহাসের সত্য আর নাটকের সত্য আলাদা। নইলে কি মাওবাদীদের জন্মের ঢের আগে রুদ্ধসঙ্গীত নাটকের দেবব্রত বিশ্বাস জিজ্ঞাসা করতে পারেন, “মাওবাদী না কামাওবাদী?”
আলাদা রাজনৈতিক পথে থেকেও ব্রাত্য এখানে তাই ঐতিহ্যে থিতু, উৎপল দত্তের চোখা সংলাপ ও অনুষঙ্গের উত্তরসূরি। বিপ্লবী দস্তয়ভস্কি বলেন, “বিশ্বাস করেছিলাম, শৃঙ্খল ছাড়া আমাদের আর কিছু হারানোর নেই।” আর এক জায়গায়, “একই সঙ্গে অনুতাপে দগ্ধ মানুষ এবং বিবেকহীন অপরাধী এই দুইই যে একত্র সহাবস্থান করতে পারে, তা ওই কাতোরগা জেল আমাকে শিখিয়েছে।” নাট্যকার বরাবর ইন্টারটেক্সচুয়ালিটির ভক্ত, সংলাপে মার্ক্স থেকে ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট, সব কিছু মনে পড়িয়ে দেওয়াতেই তাঁর সিদ্ধি।
অশালীন থেকেই ব্রাত্যর নাটকে কিছু চেনা মোটিফ বারংবার ফিরে আসে। সমাজের সঙ্গে নিজেকে মানাতে না-পারা বেপরোয়া, দুর্দম অচ্যুত-চরিত্র। অচ্যুত মানে শ্রীকৃষ্ণ নন, আমাদের প্রয়াত বন্ধু অচ্যুত মণ্ডল। ব্রাত্যর দস্তয়ভস্কি কখনও বিশুদ্ধ হামবাগ। নিজের বন্ধু ও রুমমেট সম্পর্কে বলে যে, “দস্তয়ভস্কির সঙ্গে এক ঘরে থাকবে, আবার নিজেকে লেখকও ভাববে এ দুটো একসঙ্গে হতে পারে না। আরে, তোর কাজ হল আমার লেখার তল্পিবাহক হয়ে নেক্রাসভের কাছে যাওয়া।” আবার কখনও কাঁদতে কাঁদতে, “আমাকে মার্জনা করো নেক্রাসভ। আমি এক জঘন্য পাপী, আমার অহঙ্কারের শেষ নেই।” প্রবীর দাশগুপ্তও কখনও এ ভাবে কাঁদত। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে প্রবীরই প্রথম মারা যায়। আমাদের মাস্টারমশাই শঙ্খ ঘোষের ইন্ধনে পরে অভীক মজুমদার ও অচ্যুত প্রবীরের কবিতা নিয়ে বইও করেছিল। বললাম না, ব্রাত্য তার হিংসুটে খেপামি, ঔদার্য সব কিছু নিয়ে বন্ধুবৎসল। মৃত বন্ধুরা তার নাটকে বারংবার ফিরে আসে। অরুণকুমার সরকারের কবিতার ‘পুরনো বন্ধুরা যত স্মৃতির গম্বুজ হয়ে আছে’ মার্কা লাইন কখনওই তার জন্য নয়।
নাটকে এক জন ছোট দস্তয়ভস্কি, এক জন বড় দস্তয়ভস্কি আছেন। বইটা পড়তে পড়তে মনে হল, নাট্যকার পরিচালনায় থাকলে এই লার্জার দ্যান লাইফ চরিত্র অক্লেশে দেবশঙ্করকে দিতে পারেন। আর নারী চরিত্র? দস্তয়ভস্কির প্রথম স্ত্রী মারিয়া থেকে প্রেমিকা পলিন, দ্বিতীয় স্ত্রী আন্না সকলে ছোট ছোট আঁচড়ে আঁকা। কেউ অভিমানী, কেউ হিংসুটে, আন্না আবার স্বামীসেবায় উৎসর্গীকৃত। নাট্যকার ব্রাত্য বসুর নাটক বরাবরই পুরুষপ্রধান, সেখানে নায়কের উৎকেন্দ্রিকতা ফোটাতেই এ সব মেয়ের আগমন। কে না জানে, দস্তয়ভস্কি থেকে তলস্তয়, গোর্কি সকলেই আপন সময়ের সন্তান। রুশ প্রতিভা কখনওই নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিল না!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy