“এম এন রায় কার্যত সেই বিরল ব্যক্তি হয়ে উঠলেন, পৃথিবীর দুই গোলার্ধের দুটি দেশের কমিউনিস্ট পার্টি গঠনে যাঁর প্রত্যক্ষ ভূমিকা আছে।” মেক্সিকো এবং ভারত। সান ফ্রান্সিসকোয় তাঁর আগমন সংবাদে সাড়া পড়েছিল রাজনীতি-মহলে: ‘বিখ্যাত ব্রাহ্মণ বিপ্লবী না বিপজ্জনক জার্মান গুপ্তচর?’ ঠিক এই ভাবে তাঁর কথা আমরা সচরাচর মনে রাখি না। কিন্তু ‘বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক’ লাইন থেকে ‘জাতীয় বিপ্লবী’ লাইনে কমিউনিস্ট পার্টির যে আন্তর্জাতিক বিবর্তন, তার একটা বড় গল্প ধরা থাকে এই মানুষটির রাজনৈতিক যাত্রাপথে।
এই ভাবেই ভিন্ন সময়ের, ভিন্ন প্রেক্ষিতের এক-এক ব্যক্তি ও ঘটনাকে ধরে এগোয় এই বই, আর দক্ষতায় বুনে দেয় অনেকগুলো বড় গল্প। সাধারণত নানা সময়ে লেখা ছড়ানো-ছিটানো প্রবন্ধের সঙ্কলনে এই ‘বড়’ ছবির স্বাদটা পাওয়া যায় না— যে স্বাদ থাকলে বইয়ের দুই মলাটের মধ্যে থামা হয় অতি দুষ্কর। সুলিখিত এই ইতিহাস-প্রবন্ধ সঙ্কলনটিই প্রমাণ, লেখার শৈলীর উপর কতটা ভর করে থাকে ইতিহাসের ব্যাখ্যা আর অর্থ।
নিশানের হাতছানি: বাংলার সমাজ ও রাজনীতির অনুচিন্তন
শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়
৩৫০.০০
তবুও প্রয়াস
দীনেশ মজুমদারের মতো বিপ্লবী, আবুল হাশিমের মতো বাঙালি মুসলমান নেতা, ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের মতো ভাষাজাতীয়তাবাদী, মেরি টাইলারের মতো বারুদ-বালিকা, মুরারি মুখোপাধ্যায়ের মতো জাতীয়তাবাদী থেকে নকশালপন্থী— এই সব বৃত্ত পরিক্রমণের সঙ্গে জুড়ে থাকে কমিউনিস্ট পার্টির চোখে দেশভাগের অর্থ, বা দেশভাগের পর বদলে যাওয়া বর্ডার, বা দেশভাগের আঁতের কথা। আছে বাঙালির বামপন্থা নিয়েও একটি জরুরি প্রবন্ধ। স্বল্প পরিসরের এই বই বহু ভাবনার আঁতুড় হতে পারে।
এই রকম বই হাতে নিলে বাঙালির ইতিহাসচর্চার ভবিষ্যৎ নিয়ে আশ্বাস জন্মাতে পারে। বহু রকম বিষয়কে ইতিহাস পাঠকের দরবারে হাজির করেছে এই বই, উদ্দেশ্য— সহজ ন্যারেটিভ-এর ব্যবহারে ইতিহাসযাত্রা সুগম ও সুলভ করা। তত্ত্বের ‘কচকচানি’ থেকে ইতিহাসকে উদ্ধারের এই ব্রতকে স্বাগত না জানিয়ে পারা যায় না, যদিও একই সঙ্গে থেকে যায় ঈষৎ সংশয়ের ভ্রুকুঞ্চনও, তত্ত্ব কি কেবলই তত্ত্ব, শুধু পটে লিখা? কী ভাবে তার সুষ্ঠু বিন্যাসে ন্যারেটিভও অর্থ পাল্টায়, রণজিৎ গুহ বা দীপেশ চক্রবর্তীদের পর কি তাকে আর জায়গা না দিয়ে পারি?
ইতিহাসচর্চা: সাম্প্রতিক গবেষণা
সম্পা: সমীরকুমার পাত্র, শেখর ভৌমিক, অরিন্দম চক্রবর্তী
৬০০.০০
আশাদীপ
তবে উদ্দিষ্ট গন্তব্য ধরলে, এই বই নিশ্চয়ই সফল। উনিশ শতকের বাংলা নবজাগরণ থেকে অসমের আঞ্চলিক চেতনা কিংবা ‘বাঙালির বাইরে যাওয়া’র মতো বিষয়— বিপুল এই বইয়ের পরিসর। বিন্যাসে অবশ্য আরও একটু যত্ন থাকতে পারত। প্রবন্ধের মানও কিছু অসম, তবে এই ধরনের সঙ্কলনে তা অপ্রত্যাশিত নয়। আলাদা করে কয়েকটি প্রবন্ধের কথা না বলে বরং একটা থিম্যাটিক প্রাপ্তির কথায় যাওয়া যেতে পারে। নানা কোণ থেকে স্থানীয়/আঞ্চলিক ইতিহাস ভাবনার বিষয়টি উঠে এসেছে এখানে— সেটা খুবই জরুরি। জাতীয় ইতিহাসে স্থানিকতার গুরুত্বের পাশে জায়গা নিয়েছে বাংলার নানা প্রান্তে মহামারি, বা ঔপনিবেশিক অরণ্য-নীতি, বা স্থানীয় বুদ্ধিজীবীর ইতিহাসসন্ধানের অভিঘাত। যেন হয়ে উঠেছে বিকল্প এক পরিসরের নির্মাণ।
বড়ো সময় থেকে ছোট সময়: ইতিহাসবিদ্যায় রূপান্তর
রাজকুমার চক্রবর্তী
৩৬০.০০
বুকপোস্ট
তত্ত্ব কী ভাবে ইতিহাস হয়ে ওঠে, কিংবা বিপরীতে, ইতিহাসই হয়ে ওঠে তত্ত্ব— এই বই তার দিশা দেখিয়ে বাংলা বইজগতে একটি বিশিষ্ট স্থান দাবি করতে পারে। কেবল বইটি লিখে নয়, লেখার ভাবনার জন্যই লেখককে বড় একটি ধন্যবাদ দেওয়া যেতে পারে।
মার্ক্স যদি অর্থনৈতিক নির্ধারণবাদী হন, তবে তাঁর তত্ত্বে মানুষের মানসজগতের জায়গাটা ঠিক কী? মার্ক্সীয় ‘শ্রেণি’র ধারণা দিয়ে কি আমরা প্রাক্-পুঁজিবাদী সমাজকে বুঝতে পারি? চেতনার সংস্কৃতির চলনটা বুঝতে পারি? না কি, তার জন্য উত্তরগঠনবাদে আশ্রয় নিতেই হয়, প্রথাগত মার্ক্সবাদ ধাঁচা থেকে বেরিয়ে এসে? ‘মানুষের ইতিহাস’কে কি পেরিয়ে যেতে চেয়েছিল ফরাসি ইতিহাসবিদ-প্রভাবিত ‘আনাল স্কুল’? আরও বড় পরিসরে ভূপরিবেশের সঙ্গে মানবজীবনকে গেঁথে দেখতে চেয়েছিল? তবে কি নতুন পরিবেশ-ইতিহাস চর্চার সঙ্গে তার কোনও যোগ আছে? কত প্রশ্ন উঠে আসে, উত্তর পায়— কিছু প্রশ্ন প্রচ্ছন্নও থেকে যায়। কিন্তু প্রচ্ছন্ন প্রশ্ন তৈরি করাও কি একটা বড় কাজ নয়?
ইতিহাসের পদ্ধতিগত আলোচনার মধ্যে এক দার্শনিক সৌন্দর্য আছে। লেখকের দক্ষতায় সেই সৌন্দর্য অনেকাংশে ফুটে উঠেছে এই বইয়ে। ছাত্রসমাজ নিশ্চয় লাভবান হবে এই বইয়ে, সঙ্গে বৃহত্তর পাঠকসমাজও শিক্ষিত হতে চাইতে পারেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy