কৃত্তিবাসী রামায়ণ-এ রয়েছে, ঋষ্যশৃঙ্গকে আনতে পাঠানো হয়েছিল ‘সুবর্ণের নৌকা... নৌকার উপরে করে স্বর্ণে দুই ঘর।’ যার ‘চারিদিকে শোভে গজ মুকুতার ঝারা।’ পঞ্চদশ শতকে এমন জলযানের বর্ণনায় অনেকটা কল্পনা নিশ্চয়ই রয়েছে, তবে কিছুটা কৃত্তিবাস সত্যিই কি দেখেননি? তাঁর অন্তত হাজার বছরেরও আগে থেকে বাংলায় রণতরী পর্যন্ত ছিল; কালিদাস কল্পনা করেছিলেন, তাঁর রঘুর সঙ্গে বঙ্গদেশের রাজাদের গঙ্গার উপরে নৌযুদ্ধ হয়েছিল। জিতেছিলেন রঘুই। কিন্তু রাম যেমন রাক্ষসদের রাজ্য ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, রঘুও বাংলার রাজাদের রাজত্ব ফিরিয়ে দিয়ে যান।
তরণীর সঙ্গে বাংলার রাজাদের এই নিবিড় যোগাযোগের কারণেই, সমুদ্রপারের দেশগুলোর প্রতি বাঙালিদের যথেষ্ট সম্ভ্রমও ছিল। কৃত্তিবাসের কাব্যে সিংহলের রাজনন্দিনী সুমিত্রার সঙ্গে বিবাহ হয় রাঘব দশরথের। বাল্মীকির সঙ্গে কৃত্তিবাসের কাহিনির নানা অমিলের মধ্যে এটিও একটি। তবে সেই সিংহল সমুদ্রপারে কি না, তা স্পষ্ট নয়। দশরথ মৃগয়ায় যাওয়ার ছল করে বিয়ে করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সিংহল কোথায়, তা কৃত্তিবাস জানতেন না, এমনটাও অস্বাভাবিক। সেই সপ্তম শতকেই হিউয়েন সাং তাম্রলিপ্ত থেকে সিংহল গিয়েছিলেন।
তবে এও ঠিক, তরণীতে সাগর পার হওয়া যায়, এমনটা কৃত্তিবাসের রামও ভাবেননি। অথচ তিনি গৌড়ে গিয়েছিলেন, যে গৌড়কে পশ্চিম ভারতে বন্দর বলেই ভাবা হত। এই কথাটা ওঠে আরও এক কারণে যে, সেতুবন্ধনের বিকল্পও কিন্তু রয়েছে। পদ্মপুরাণে শিবের ধনুকে সমুদ্র পেরোন সসৈন্য রাম। তবে গঙ্গা পারাপারের বৃত্তান্তে কৃত্তিবাস বাল্মীকিকে ছাপিয়ে গিয়েছেন। কৃত্তিবাসের ভরত সাত অক্ষৌহিণী সৈন্যসামন্ত নিয়ে নৌকায় গঙ্গা পেরিয়েছেন। বাল্মীকিতে নৌকার সংখ্যা মাত্র পাঁচশো। কৃত্তিবাসের এই ছাপিয়ে যাওয়ার মধ্যে, শুধু কল্পনার পরাক্রম নয়, বাংলার কবির অভিজ্ঞতাও কি প্রকাশিত হয়নি?
কৃত্তিবাসের সামান্য পর থেকেই বাংলার মঙ্গলকাব্যে একাধিক জলযান: সরাসরি সমুদ্র পেরোনোর কাহিনি মেলে। তবে কবিকঙ্কণের চণ্ডীমঙ্গল-এও সাধু জানতেন না, সিংহল ঠিক কোথায়। সাধুর জলযানের আকারটি অবশ্য তাঁর সওদার ধরনে বোঝা যায়। তিনি বলছেন, ‘কুরঙ্গ বদলে তুরঙ্গ দিবে’, আবার ‘শুক্তার বদলে মুক্তা দিবে ভেড়ার বদলে ঘোড়া।’ ক্ষেমানন্দের মনসামঙ্গল-এও ‘ঘোড়া জোড়া লেই সাধু মনের কৌতুকে।’ চাঁদ সদাগর অবশ্য পথ না ভুলে ‘শীঘ্রগতি চলে’ ‘সিংঘল’ পৌঁছেছিলেন। কবিকঙ্কণে সমুদ্রপোত তৈরির বিবরণও রয়েছে— “দিঘে ডিঙ্গা শত গজ আড়ে ডিঙ্গা বিংশতি প্রমাণ।” হনুমান তত দিনে মহাবীর— “নখে করে দুই চির কাঁঠাল প্যাশাল তাল শাল। গমারি তমাল তাহু নখে চির্যা দিল বহু।।” বিশ্বকর্মা “গঢ়ে ডিঙ্গা মধুকর মাঝে যার রৈঘর পাশে গুড়া বসতে গাবর।... গড়ে ডিঙ্গা সিংহমুখী নাম যার গুয়ারেখি আর ডিঙ্গা নাম রণজয়া। অপরূপ রূপ সীমা গঢ়ে ডিঙ্গা রণভীমা গঢ়নি পঞ্চম মহাকায়া।। গঢ়ে ডিঙ্গা সর্বধরা হিরণ্ময়ী চন্দ্রতারা আর ডিঙ্গা নামে নাটশালা।”
বেঙ্গল ওয়াটার ক্র্যাফ্ট: বোট-বিল্ডিং অ্যান্ড ফিশিং কমিউনিটিজ়
লতিকা বরদারাজন ও স্বরূপ ভট্টাচার্য
মনোহর বুকস, ২০১৬
লতিকা বরদারাজন এবং স্বরূপ ভট্টাচার্য বাংলার এই বিরাট বৈচিত্রময় জলযানগুলোর চমৎকার সচিত্র বিবরণী দিয়েছেন। তাঁরা নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বেঁচে থাকা নৌকার সন্ধান করেছেন। সবটাই দুই গবেষকের বিস্তৃত ক্ষেত্রসমীক্ষার ফল। বইয়ের পাতা উল্টাতেই ১৮১০ সালে হুগলি শহরের হুগলি নদীতে ভেসে থাকা নানা ধরনের নৌকার ছবিটিই প্রথমে মন ভরিয়ে দেয়। আর তার পরে একটি বৃহৎ মানচিত্র। তাতে পশ্চিমবঙ্গের কোথায় কী ধরনের নৌকা দেখেছেন, তা চিহ্ন দিয়ে পরিষ্কার বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেমন এক টিনের ডোঙা, বাছারি, ভঁড়, ছোট্, ছোট্ শালতি, ধোলাই, গলুইয়া, খড়োকিস্তি, কোশা, ‘এল বডি’ শালতি, মেড়লি, পাটিয়া, পাউকা, টালাই নৌকার সঙ্গে সুলতানি, ডিঙি, মাটি তোলার নৌকা এবং যন্ত্রচালিত কাকদ্বীপ ট্রলারও রয়েছে। কোনটির কী উচ্চারণ, তা বইয়ের প্রথমে দেওয়া রয়েছে। প্রতিটি ধরনের আলোচনা করা হয়েছে ধরে ধরে।
পশ্চিমবঙ্গের ছোট, বড় নানা নদীতে এই নৌকাগুলোর গঠন, নির্মাণের ধরন, পরিবর্তনশীল প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে রূপের ভেদও পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে দেখেছেন লেখকেরা। যেমন, গঙ্গার যে অঞ্চলে যে নৌকা চলে, তার সঙ্গে দামোদর, রূপনারায়ণ, কংসাবতী, জলঙ্গি বা উত্তরের তিস্তা, তোর্সা, জলঢাকার নৌকার কী পার্থক্য, তা এই বই থেকে জানা যাবে। আঞ্চলিক ভাষা ও প্রয়োজন কী ভাবে নৌকার গঠন ও হাল, খোল, দাঁড়, পাল প্রভাবিত করেছে, তার বর্ণনা রয়েছে।
মৎস্যজীবীদের জীবনের বৈচিত্রও আলোচনায় আছে। সঙ্গে নৌকা, নদীঘাট ও নাবিকদের নানা প্রথার অতি চমৎকার বিবরণ। নৌকা এবং ঘাটে কলস স্থাপন, কলসের গায়ের আলপনা এবং সুবাসের চরিত্রও তাঁদের নজর এড়ায়নি। সুন্দরবনের বিশালাক্ষী, শীতলা থেকে শুরু করে উত্তরবঙ্গের মাসান পর্যন্ত কোথায় কোন আঞ্চলিক দেবতা নৌ-ভুবনের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছেন, তারও ব্যাখ্যা রয়েছে। তাঁরা জানাচ্ছেন, ঝাড়খণ্ডে মাঘের প্রথম দিন ঘাটকে মাতৃগর্ভ বলে পুজো করা হয়। পশ্চিম ভারতের সঙ্গে নদীবহুল পূর্ব ভারতে নৌকা তৈরির রীতিও আলোচিত হয়েছে বিস্তারিত ভাবে। মন ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো বৈচিত্র রয়েছে সেখানে। আবার, ঐক্যও রয়েছে। লেখকেরা জানাচ্ছেন, এই রাজ্যের বেশির ভাগ নৌকার তলদেশ খানিকটা চওড়াই হয়, তবে স্থানভেদে, নদীগর্ভের গভীরতা ও জেলে বা নাবিকদের প্রয়োজন মতো তার পরিবর্তন করা হয়। সম্প্রতি প্রয়াত বরদারাজন রেখে গেলেন এই চমৎকার গবেষণাগ্রন্থটি।
আর এক বার মধ্যযুগে ফিরলে দেখা যায়, দামোদর, অজয়ের পাশের মঙ্গলকাব্যকারেরা যা লিখেছিলেন, ভাগীরথীর ধারের বৈষ্ণব কবিদের বর্ণনার লালিত্য তুলনায় মনোহর। বৃন্দাবনে বসে চরিতকাব্য লিখতে গিয়ে কৃষ্ণদাসও ভোলেননি, বাংলায় ফেরার পথে চৈতন্য নৌকায় নদী পার হয়েছিলেন এক জ্যোৎস্নারাতে। আর এক নবীন নৌকা তাঁকে দেওয়া হয়েছিল, যার মধ্যে ছিল একটি ঘর। দস্যুদের ভয়ে দশ নৌকা সৈন্য চৈতন্যের নৌকাটিকে ঘিরে রেখেছিল। লতিকা ও স্বরূপের বইটি থেকে, সেই নৌকাগুলো সত্যিই কেমন দেখতে ছিল, তা কল্পনার সূত্র পাওয়া যায়। এর চেয়ে বড় লাভ আর কী হতে পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy