ছিন্নমূল: দেশভাগের পর পূর্ব থেকে পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তু-স্রোত, ১৯৪৭
জন মেনার্ড কেন্স বলেছিলেন অর্থনীতিবিদদের হতে হবে দন্ত চিকিৎসকের মতো— বিনয়ী কিন্তু কার্যকর। আজ থেকে প্রায় শতবর্ষ আগেই তাঁর পেশাতুতো বয়স্যদের সাধারণ রোগটি বিলক্ষণ চিনে ফেলেছিলেন কেন্স। উচ্চভাষী অর্থনীতিবিদ কোনও কালেই তেমন কম পড়ে নাই, যাঁরা সতত দাবি করেন যে সত্য তাঁদের হাতের মুঠোয়। অভিজিৎ বিনায়ক ও এস্থার সে দিক থেকে অন্য রকম। তাঁদের এই সদ্য-প্রকাশিত বইটিতে প্রায় যেন কেন্সের সুরেই বলছেন, অর্থনীতিবিদের ভূমিকাটি হওয়া উচিত কলের মিস্ত্রির মতো। জলের জোগান গঙ্গা থেকে আসছে না গভীর নলকূপ থেকে— এ সব ‘বড়’ প্রশ্নের কচকচিতে না গিয়ে কলের মিস্ত্রি যেমন ‘লিক’টি খুঁজে তা বন্ধ করার কিছু একটা উপায় বার করে ফেলেন, অর্থনীতিবিদরা তেমনটি করতে পারলেই মানুষের মঙ্গল। বইটির প্রচ্ছদের অনেকটা জুড়ে রয়েছে একটি বড়সড় রেঞ্চের ছবি। সদ্য-নোবেলজয়ী এই দুই অর্থনীতিবিদের কাজের প্রকৃতি এবং তার পিছনের দর্শন বুঝতে এবং বোঝাতে গেলে এই রূপকটি দারুণ জুতসই।
জগৎসংসারে নিরানব্বই শতাংশ মানুষই বোধ হয় ভাল নেই। বিদ্বেষবিষে নীল এমন অসূয়াপূর্ণ মানবসমাজ যেন আগে দেখিনি। আমেরিকার মতো দেশেও ডেমোক্র্যাট পার্টি সমর্থকদের ৬১ শতাংশ বলছেন রিপাবলিকানরা জাতিবিদ্বেষী, নারীবিদ্বেষী, গোঁড়া। ৫৪ শতাংশ রিপাবলিকান বলছেন ডেমোক্র্যাটরা আক্রোশী, বিদ্বেষপূর্ণ। ভেবে দেখুন, অভিমতগুলি পার্টি সমর্থকদের নিয়ে, পার্টির নীতি নিয়ে নয়। আমরাও আশপাশে দেখছি কেমন অসূয়ার বাড়বাড়ন্ত— পাশের লোকটাকে দু’ঘা দিতে হাত নিশপিশ করছে, কেবলমাত্র মানুষটি ‘আমাদের মতো’ নয় বলে।
এমতাবস্থায় এক জন সমাজবিজ্ঞানী কী করতে পারেন? অভিজিৎ ও এস্থার আস্থা রাখেন যুক্তি ও তথ্যপ্রমাণে। আশা করেন ঠিক যুক্তি ও তথ্য দিয়ে এই উত্তরোত্তর বিভাজনের সংস্কৃতিকে ঠেকানো যেতে পারে। সহমতে যে আসতেই হবে তা নয়; মতভেদটা যেন যৌক্তিক ভিত্তিতে থাকে। অথচ তাঁরাই জানাচ্ছেন, আমেরিকা এবং ফ্রান্সে সমীক্ষায় দেখা গেছে, মানুষজন তাঁদের বিশেষ রাজনৈতিক পছন্দের পক্ষে যুক্তি হিসেবে যে তথ্যের উল্লেখ করছেন সেগুলি ডাহা ভুল; তার পর যখন ঠিক তথ্যটি সেই মানুষদেরই দেওয়া হচ্ছে, তাঁদের রাজনৈতিক পছন্দ বা ভুল নীতির সমর্থন (যেমন অভিবাসন-বিরোধী নীতি) তেমন বদলাচ্ছে না। তবু আশায় বাঁচে চাষা।
গুড ইকনমিকস ফর হার্ড টাইমস
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও এস্থার দুফলো
৬৯৯.০০
জাগরনট
সরাসরি চলে আসি সমস্যাগুলোয়, লেখকরা যাদের ‘বিপুলতম সমস্যা’ বলে চিহ্নিত করেছেন, এবং ‘শ্রেয়তর’ উত্তরের সন্ধান দিতে উদ্যোগী হয়েছেন। সমকালীন বিশ্বে যে কয়েকটি বিষয় অর্থনীতি-সমাজ-রাজনীতিকে তোলপাড় করছে, অভিবাসন তাদের মধ্যে অন্যতম। অথচ আশ্চর্য হয়ে যেতে হয় দেখে, অভিবাসন নিয়ে সাধারণ ধারণাগুলো কতটা ভুল, এবং কী ভাবে রাজনৈতিক স্বার্থ সেই ভুল ধারণাগুলোকে বৈধতা দিয়ে চলে। মজার ব্যাপার, অর্থনীতির তত্ত্ব অনুসরণ করে এগোলে যেখানে পৌঁছতে হয় তার সঙ্গে সাধারণ মানুষের ধারণা খুব আলাদা নয় এ ক্ষেত্রে। তত্ত্ব বলে, মানুষ যদি আপন স্বার্থমতো চলে, তা হলে যেখানে তার প্রাপ্তির দিকটা বেশি, ক্ষতিটা কম, সে দিকেই সে যাবে। তা হলে সুযোগ পেলেই গরিব দেশগুলো থেকে মানুষজন সচ্ছল দেশগুলোয় হাজির হবে, আর যেখানে যাচ্ছে সেখানকার মানুষের সচ্ছলতায় ভাগ বসাবে, এতে আর আশ্চর্যের কী আছে?
কিন্তু প্রচুর তথ্য ও গবেষণার ফলাফল ঘেঁটে অভিজিৎ এবং এস্থার দেখাচ্ছেন, এই দুটির কোনওটিই সত্যি নয়। অধিকাংশ মানুষই অবস্থার উন্নতি হবে জেনেও ঠাঁইনাড়া হতে চান না। ২০১০ থেকে ২০১৫, গ্রিসের অর্থনীতি যখন টালমাটাল, বেকারত্বের হার ২৭ শতাংশ, তখনও মাত্র সাড়ে তিন লক্ষ মানুষ দেশ ছেড়েছেন, গ্রিসের জনসংখ্যার যা তিন শতাংশ মাত্র। মনে রাখতে হবে, গ্রিস যেহেতু ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য, গ্রিকরা অন্য যে কোনও সদস্য-দেশে বিনা বাধায় কাজ পেতে পারেন। অন্য দিকে, অভিবাসনের ফলে অভিবাসী ও স্থানীয় মানুষ— উভয়েরই আর্থিক অবস্থা আগের তুলনায় ভাল হয়েছে, এই সত্যটাই সর্বত্র জোরালো ভাবে উঠে আসে। এর একটা কারণ হল অভিবাসীরা তাঁদের রোজগারের একটা অংশ সেখানেই খরচ করেন, ফলে জিনিসপত্রের চাহিদা বাড়ে, সেগুলির উৎপাদন বাড়ে, ফলে কাজের সুযোগ বাড়ে। এ ছাড়া, অধিকাংশ অভিবাসী— যাঁদের বিশেষ দক্ষতা নেই— তাঁরা সেই কাজগুলিতেই ভিড় করেন, যেখানে স্থানীয়রা আগ্রহী নন, কারণ মজুরি কম, যদিও সে মজুরি তাঁরা যেখান থেকে এসেছেন সেখানকার তুলনায় কিছুটা বেশি। ফলে অভিবাসী ও স্থানীয়দের মধ্যে সরাসরি প্রতিযোগিতার সম্ভাবনা কম। অতএব বর্ডারে দেওয়াল তোলা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে, দেশের মধ্যে অভিবাসী ও স্থানীয়দের মধ্যে বিভেদ কতটা কমানো যায়, সে দিকে নজর দিলেই সার্বিক কল্যাণ হতে পারে। এ যে কোনও ফাঁকা আদর্শবাদী অবস্থান নয় সেটি বোঝাতে লেখকরা যেরকম রাশি রাশি তথ্যপ্রমাণ হাজির করেছেন তাতে বিস্মিত হতে হয়।
বাইরে থেকে সস্তা শ্রম ঢুকে পড়ে সব্বোনাশ করছে এ যেমন অতিকথা, বাইরে থেকে সস্তা পণ্য ঢুকে পড়ে সব্বোনাশ হচ্ছে এও কি তেমনই অতিকথা? অবাধ বৈদেশিক বাণিজ্যের সার্বিক কল্যাণ-সম্ভাবনা বিষয়ে অধিকাংশ অর্থনীতিবিদই নিশ্চিত। এ এক আজন্মলালিত বিশ্বাস যার উৎস দুশো বছর আগের ডেভিড রিকার্ডোর তুলনামূলক সুবিধাতত্ত্ব। তত্ত্বটি অর্থনীতির আর পাঁচটি তত্ত্বের মতোই অনেকগুলি ‘যদি’র উপর দাঁড়িয়ে আছে। তবু প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই তত্ত্বের জোরালো আবেদন এড়াতে পারেন না। অথচ সাধারণ মানুষের, বিশেষত শ্রমিকশ্রেণির, উপলব্ধিটা অন্য রকম। তাঁরা মনে করেন বিদেশি পণ্যের আগমন ঠেকিয়ে দেশের শিল্প ও দেশীয়দের কাজ বাঁচানো যাবে। তাই অভিজিৎ ও এস্থারের পরের প্রশ্ন, দু’পক্ষের মধ্যে ধারণার এমন ফারাকের কারণটা কী?
জনগণ রিকার্ডোর তত্ত্ব বোঝে না বললে মামলা শেষ হয়ে যাচ্ছে না, কারণ ডোনাল্ড ট্রাম্প কিন্তু ওই জনগণের বিশ্বাসকেই মান্যতা দিয়ে ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের আমদানির ওপর শুল্ক চড়িয়েছেন গত বছর। আমেরিকার একশো জন শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতির অধ্যাপককে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তাঁরা এই নীতির সঙ্গে সহমত কি না। তাঁদের সব্বাই বলেছেন, তাঁরা সহমত নন। একই প্রশ্ন যখন অন্যদের করা হল (যাঁরা অর্থনীতিবিদ নন), মাত্র ৩৭ শতাংশ বললেন তাঁরা সহমত নন। ৫৪ শতাংশ জানিয়েছেন আমদানির উপর বেশি হারে শুল্ক চাপিয়ে স্বদেশে উৎপাদনে উৎসাহ দেওয়ার নীতিটি ‘ভাল’। আসলে বাস্তবে যা ঘটছে আর তত্ত্ব অনুসারে যা হওয়ার কথা তাদের মধ্যে বিস্তর ফারাক থেকে যাচ্ছে। এমআইটির গবেষক টোপোলোভা দেখিয়েছেন সংস্কারোত্তর ভারতে (গত শতকের নব্বই দশক থেকে) আমদানি শুল্ক কমানোর ফলে যে জেলাগুলির অর্থনীতিতে বেশি প্রভাব পড়ার কথা, সেই জেলাগুলিতে দারিদ্র হ্রাসের হার তুলনায় কম অন্য জেলাগুলি থেকে। অতএব মুক্ত বাণিজ্যে সবারই লাভ, এই বিশ্বাসটির সঙ্গে বাস্তব অভিজ্ঞতা নাও মিলতে পারে। আর তাই যাঁদের তেমন লাভ হয় না তাঁদের দিক থেকে বিরোধিতা আসবেই। অতএব উপায়? সরকারকে ভাবতে হবে ক্ষতিগ্রস্তদের কী ভাবে সরাসরি সুরক্ষা দেওয়া যায়। আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে এর সমাধান হতে পারে না, লেখকদের মত।
এ ভাবে প্রশ্ন থেকে প্রশ্নে যাওয়া আর উত্তর খোঁজার চেষ্টা চলতে থাকে চারশো পৃষ্ঠা জুড়ে। প্রশ্নগুলি একটিই সাধারণ সূত্রে গাঁথা। সেটি হল, সমকালীন বিশ্বে জননীতির প্রশ্নে রাজনৈতিক ভাবে প্রভাবশালী অধিকাংশ জনমতের সঙ্গে অর্থনীতিচর্চালব্ধ জ্ঞানের মিল পাওয়া যায় না; তবু এত মানুষ যখন মতটি আঁকড়ে ধরে আছেন, যুক্তি দিয়ে একে বিশ্লেষণ না করলে ঠিক নীতির পক্ষে জনমত টানা যাবে না। বেড়ে ওঠা আয় বৈষম্য থেকে উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন, গরিবদের হাতে নগদ অর্থ দেওয়া থেকে সর্বোচ্চ করদাতাদের ওপর বেশি কর চাপানোর ভালমন্দ— সর্বত্রই যেন ভ্রান্ত ধারণার মহামিছিল। অভিজিৎ ও এস্থার তাঁদের এই বইয়ে এমন সব গুরুতর প্রশ্নেরই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন গবেষণালব্ধ জ্ঞানসাগরে ডুব দিয়ে।
এই গণবিভ্রান্তির বিপরীতে তত্ত্বকে লড়তে নামিয়ে দেওয়ার চল ছিল অতীতে। কিন্তু আর্থনীতিক তত্ত্বের মর্মবস্তু যে ঘর্ষণহীনতা— ফ্রিকশনলেস অ্যাডজাস্টমেন্ট। তাই তত্ত্ব ও বাস্তবের মধ্যে ফাঁকটি বিশাল। যে কোনও পরিবর্তনের পর অর্থনীতির পুনর্বিন্যাস তৎক্ষণাৎ হয় না, সময় লাগে। কিন্তু রাজনীতি থেমে থাকে না। সমাধানসূত্রগুলি এঁরা তাই খুঁজে নিয়েছেন মাটির কাছ থেকে, যেখানে রাজনীতি আর কুসংস্কার হাত ধরাধরি করে চলে। খেয়াল করতে হবে, অভিজিৎ ও এস্থার যে উত্তর জোগাচ্ছেন তা ওঁদের কথায় ‘শ্রেয়তর’, শ্রেষ্ঠ নয়। কলের মিস্ত্রি হোন বা দুঁদে অর্থনীতিবিদ বা জননেতা, শ্রেষ্ঠ সমাধানের দাবিদারকে কিন্তু শেষমেশ হাসির খোরাক হতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy