প্রতীকী ছবি।
রাইটিং উইমেন ইন হিস্ট্রি: গ্লিম্পসেস ফ্রম ইন্ডিয়াজ় কলোনিয়াল পাস্ট
সম্পা: সুপর্ণা গুপ্তু
৫৯৫.০০
কে পি বাগচি অ্যান্ড কোম্পানি
কয়েক দশক আগেও ইতিহাস ছিল শুধুমাত্র পুরুষের আখ্যান। ইতিহাসবিদদের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল যুদ্ধ, কূটনীতি, প্রশাসন প্রভৃতি ক্ষেত্রে উচ্চবর্গীয় পুরুষের কীর্তিকলাপের উপর। এই সব ক্ষেত্রে দু’-একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে নারী ছিল অনুপস্থিত। পিতৃতন্ত্র মেয়েদের ঠেলে দিয়েছিল গৃহকোণে, তাঁদের জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল গার্হস্থ্যের পরিসর। ওই পরিসরে যেন সময় থমকে থাকে। যেটুকু ঘটে, তা তুচ্ছ, অকিঞ্চিৎকর। তাই ঘরের কথা, মেয়েদের কথা ইতিহাসে ঠাঁই পায় না। ইতিহাস হয়ে যায় ‘হিজ় স্টোরি’। মেয়েরা ছিল ইতিহাসের অন্তরালে, সিলা রোবথামের ভাষায় ‘হিড্ন ফ্রম হিস্ট্রি’। বিশ শতকের ষাটের দশকে নারীবাদের দ্বিতীয় তরঙ্গের অঙ্গ হিসেবে পাশ্চাত্যের বিদ্যায়তনিক পরিসরে মানবী-ইতিহাসচর্চার আত্মপ্রকাশ ঘটল। এই ইতিহাসচর্চার উদ্দেশ্য হল, বিস্মৃতির আড়াল থেকে মেয়েদের উদ্ধার করে ইতিহাসের পাতায় প্রতিষ্ঠিত করা, শুধুমাত্র জনপরিসরে নারীর অবহেলিত ভূমিকা নয়, নিভৃত-ঘরোয়া পরিসরে নারীর যাপিত জীবনের আপাত তুচ্ছ দিকগুলি উন্মোচিত করা, ব্যক্তি-পরিসর আর জনপরিসরের বিভাজনরেখা মুছে দেওয়া, ইতিহাসের অন্তর্লীন পুরুষ পক্ষপাতিত্ব এবং অসাম্যকে দূর করে সমতার ভিত্তিতে ইতিহাস জ্ঞানকে পুনর্নির্মাণ করা।
ভারতে এই চর্চা শুরু হয়েছে ১৯৭৫ সালে, ‘টুয়ার্ডস ইকুয়ালিটি’ রিপোর্ট প্রকাশের পর। এই রিপোর্ট প্রকট করল এক রূঢ় বাস্তব। স্বাধীনতা পরবর্তী দশকগুলিতে ভারতীয় মেয়েদের অবস্থার যে স্পষ্ট অবনমন ঘটেছে, সাম্যের সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি যে অপূর্ণ থেকে গিয়েছে, সেই সত্যটিকে উন্মোচন করে এই রিপোর্ট ভারতীয় সারস্বত সমাজের চোখ খুলে দিল। মোহভঙ্গের যন্ত্রণার পাশাপাশি পাশ্চাত্যের নারীবাদী ভাবনার সঙ্গে পরিচয়ও অনুঘটকের কাজ করল। জন্ম নিল নারী আন্দোলনের স্বয়ংক্রিয় এক ধারা। পাশাপাশি, এই রিপোর্ট মেয়েদের জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে মননশীল অনুসন্ধানকে উস্কে দিল। জ্ঞানজগতের মধ্যে লুকিয়ে থাকা পিতৃতন্ত্রকে চিনে নিয়ে তাকে মোকাবিলারও প্রয়াস শুরু হল। আন্তঃবিষয়ক জ্ঞানক্ষেত্র হিসেবে মানবীবিদ্যার আবির্ভাবের সঙ্গে সনাতন বিষয়গুলির অন্তর্লীন লিঙ্গ-অসাম্যকে দূর করে, ‘অ্যান্ড্রোসেন্ট্রিক’ চরিত্রের অবসান ঘটিয়ে এদের পুনর্নির্মাণের উদ্যোগ শুরু হল। ভারতে মানবী-ইতিহাসচর্চার সূচনা সেই উদ্যোগেরই অঙ্গ। তবে মানবী-ইতিহাস এখনও রক্ষণশীল ইতিহাসবিদ মহলে তাচ্ছিল্য, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের শিকার। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরের পাঠ্যক্রমে এখনও উপেক্ষিত। প্রচ্ছন্ন এক অস্বীকৃতি এখনও মানবী-ইতিহাসকে তাড়া করে বেড়ায়। ইদানীং কালে মানবী-ইতিহাসচর্চার পরিধি কিছুটা বিস্তৃত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। নারীবাদী তত্ত্বকে হাতিয়ার করে মানবী-ইতিহাসচর্চাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আত্মজীবনী, চিঠিপত্র, ডায়েরি, মুখের কথা প্রভৃতি অপ্রথাগত উপাদানের ভিত্তিতে নারীর মুছে যাওয়া ইতিহাসকে পুনরুদ্ধার করতে হবে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ়-এর উদ্যোগে প্রকাশিত ও সুপর্ণা গুপ্তু সম্পাদিত সঙ্কলনটি এই প্রয়াসেরই সার্থক ফসল।
সুপর্ণা গুপ্তু তাঁর ভূমিকায় মানবী-ইতিহাসচর্চার ইতিহাস, এই চর্চার তাত্ত্বিক ভিত্তি ও উদ্দেশ্য, সমস্যা ও চ্যালেঞ্জগুলিকে সাবলীল ভাষায় উপস্থাপিত করেছেন। সঙ্কলনের প্রথম বিভাগে অন্তর্ভুক্ত প্রবন্ধ দু’টি প্রচলিত ইতিহাসচর্চার সীমাবদ্ধতাকে পরিস্ফুট করেছে। মধুমিতা মজুমদার দেখিয়েছেন, কী ভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিচর্চার ক্ষেত্রে নারীবাদী হস্তক্ষেপ জাতীয়তাবাদী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি চর্চা ও গবেষণার পুরুষকেন্দ্রিক চরিত্রকে প্রকট করেছে। নারীর যৌনতা এবং সাহিত্যে, চলচ্চিত্র বা অন্যান্য শৈল্পিক মাধ্যমে তার প্রতিফলন ইতিহাসচর্চায় এখনও উপেক্ষিত। শর্মিষ্ঠা গুপ্তু চণ্ডীদাস ছবিতে নারীর যৌনতার উপস্থাপনাকে বিশ্লেষণ করেছেন।
পরবর্তী বিভাগের প্রবন্ধগুলি উনিশ ও বিশ শতকে স্ত্রীশিক্ষা ও সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার উপর আলো ফেলেছে। রচনা চক্রবর্তী ঔপনিবেশিক বাংলার প্রেক্ষাপটে মুসলিম নারীর শিক্ষা বিষয়ে আলোচনা করেছেন। স্ত্রীশিক্ষা প্রকল্পের সীমাবদ্ধতা মুসলিম মহিলাদের স্বনির্ভর ব্যক্তি হিসেবে আবির্ভাবের ক্ষেত্রে বাধা দিয়েছিল। সৃষ্টি করেছিল মনের ভিতরেও এক পর্দা, যা ভেঙে বেরোতে খুব কম সংখ্যক মুসলিম মেয়েই পেরেছিলেন। উনিশ শতকের বাঙালি সমাজ মেয়েদের সুগৃহিণী হিসেবে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে রন্ধনশিল্পে পটুত্বের উপর জোর দিয়েছিল। রান্নার খাতা প্রভৃতি অগতানুগতিক উপাদানের ভিত্তিতে উৎসা রায় দেখিয়েছেন, কী ভাবে ঔপনিবেশিক বাংলায় মেয়েদের একটি ছাঁচে ঢালার চেষ্টা হয়েছিল, এক সংশোধিত পিতৃতন্ত্রের দাবি মেটাতে।
তৃতীয় বিভাগের অন্তর্ভুক্ত প্রবন্ধগুলোয় নারীর অতীতকে পুনরুদ্ধার করার প্রয়াস ধরা পড়েছে। প্রথম দু’টি প্রবন্ধের বিষয় ঔপনিবেশিক কালপর্বে অসমিয়া নারীর লেখা উপন্যাস। দু’টি উপন্যাসের ভিত্তিতে শীলা বোরা তুলে ধরেছেন মেয়েদের লেখায় প্রতিবাদ ও অনুগমনের দোলাচল। মনোরমা শর্মা ঔপনিবেশিক অসমে মুদ্রণমাধ্যমে ধ্বনিত মেয়েদের বহুবাচনিক আত্মপ্রকাশের ভিত্তিতে মননের ইতিহাস লিখতে সচেষ্ট হয়েছেন।
আত্মজীবনী, চিঠিপত্র, ডায়েরি প্রভৃতি অপ্রথাগত উপাদানের ভিত্তিতে ব্যক্তি নারীর যাপিত জীবনের নানা দিককে কালের গহ্বর থেকে তুলে আনা মানবী-ইতিহাসচর্চার এক অত্যন্ত জরুরি পদক্ষেপ। ব্যক্তি জীবন আসলে বৃহত্তর সামাজিক কাঠামোর দ্বারা নির্ধারিত, এবং তা সমষ্টির জীবনকেই প্রতিফলিত করে। এই আবশ্যিক ব্যক্তিজীবনচর্চাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে এই বিভাগের পাঁচটি প্রবন্ধ। রেবা সোমের আলোচ্য ভগিনী নিবেদিতার জীবন ও কৃতিত্ব। মীরাবেনের জীবনের উপর আলোকপাত করেছেন হাসি বন্দ্যোপাধ্যায়। নিবেদিতা ও মীরাবেনকে যথাক্রমে বিবেকানন্দ ও গাঁধীজির শিষ্যা হিসেবেই ইতিহাস মনে রেখেছে। তবে নিছক গুরুর দেখানো পথেই যে তাঁরা চলেছেন, তা মনে করার কোনও কারণ নেই। কর্মের মধ্যে তাঁরা স্বকীয়তার ছাপ রেখে গিয়েছেন। রেবা সোম এবং হাসি বন্দ্যোপাধ্যায় পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের মধ্যেকার আদানপ্রদানের প্রেক্ষাপটে বুঝতে চেয়েছেন এই দুই শ্বেতাঙ্গিনীর জীবন ও মনন। নির্বাণ বসু অভিযান চালিয়েছেন মণিকুন্তলা সেনের দ্বন্দ্বজর্জর মনোজগতের গহনে। রাজনীতি মণিকুন্তলার কাছে ছিল আত্ম-অন্বেষণ, জীবনের এক গভীরতর অর্থ সন্ধানেরই এক পন্থা।
উনিশ শতকে স্ত্রী শিক্ষা প্রসারের ফলে মেয়েরা গৃহের চৌকাঠ পেরিয়ে কর্মজীবনের প্রবেশ করতে শুরু করেছিল। আর প্রথম দিকে শিক্ষকতাই ছিল মেয়েদের পছন্দের পেশা। এই ব্যাপারে চন্দ্রমুখী বসু ও তটিনী দাস ছিলেন ‘ফোরমাদার’। এই দুই মনস্বী নারী গৃহ এবং কর্মজগতের মধ্যে কী ভাবে সামঞ্জস্য বিধান করেছেন, কী ভাবে মোকাবিলা করেছেন বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের, সারদা ঘোষ দেখিয়েছেন তাঁর প্রবন্ধে। বিপ্লবী লীলা নাগ দীপালি সঙ্ঘ ও শ্রী সঙ্ঘ নামের দুই সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পলাশ মণ্ডল এই দুই সংগঠনের কর্মকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে লীলার বিপ্লবী জীবনের চালচিত্র এঁকেছেন।
সঙ্কলনের শেষ বিভাগের প্রবন্ধগুলি প্রচলিত ইতিহাসচর্চার দ্বিমূল ছক বা ‘বাইনারি’ সম্বন্ধে প্রশ্ন তুলেছে। অনিন্দিতা মুখোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ অমিয়া চৌধুরানি ও বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতের জীবনচর্যায় ব্যক্তিগত ও জনপরিসরের সংযোগ ও সঙ্ঘাতের জটিল সমীকরণকে পরিস্ফুট করেছে। রাজশেখর বসু দলিত নারী ভিরাম্মার আত্মজীবনীর নিবিড় পাঠ করে লিঙ্গ ও জাতির সম্পৃক্তি ও দ্বন্দ্বের প্রক্রিয়াটি উপস্থাপিত করেছেন। ঐশিকা চক্রবর্তী পাশ্চাত্য ও ভারতের প্রেক্ষাপটে নৃত্যের ইতিহাস লিখতে গিয়ে শ্রেণি, জাতি, লিঙ্গের অন্তর্বিভাগীয় বা ‘ইন্টারসেকশনাল’ ঘাত-প্রতিঘাতের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। পাশাপাশি দেখিয়েছেন, নৃত্য কী ভাবে ভেঙে দিয়েছে নারীত্ব ও পৌরুষের প্রতিষ্ঠিত ধারণার ছকগুলো।
সুপর্ণা গুপ্তু সম্পাদিত এই সঙ্কলনটি মানবী ইতিহাসচর্চার ক্ষীণ ধারাটিকে বলীয়ান করবে। তবে সঙ্কলনটির শিরোনামে ঔপনিবেশিক কালপর্বের ভারতের কথা বলা হলেও স্বাধীনতা-উত্তর কালপর্বের মেয়েরাও দু’-একটি প্রবন্ধে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। ভিরাম্মা বিষয়ে প্রবন্ধটি মনোজ্ঞ হলেও বর্তমান সময়ের এই দলিত নারীর অন্তর্ভুক্তি এই সঙ্কলনের কালিক পরিসরের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ঔপনিবেশিক কালপর্বে তারাবাই শিন্ডে, রমাবাই, রুখমাবাই প্রমুখ মরাঠি মহিলা তাঁদের লেখনী ও কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে অভূতপূর্ব প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। তাঁদের কেউ এই সঙ্কলনে উপস্থিত থাকলে ভাল লাগত। সঙ্কলনের বিভিন্ন বিভাগের নামকরণের যুক্তি যেন কিছু অস্পষ্ট। তবে এগুলি সামান্য অপ্রাপ্তি। মানবী-ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে সঙ্কলনটি একটি মূল্যবান সংযোজন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy