Advertisement
১৮ জানুয়ারি ২০২৫
যে আখরোট গাছের তলায় নাজ়িম হিকমত প্রেমিকার অপেক্ষা করেছিলেন
book review

খুশবুদার তুরস্ক কাহিনি

মেরহাবা তুর্কিয়ে শুরু হয়েছে সুবিখ্যাত এফেসাসের কথা দিয়ে, বিশেষত মেয়েদের গল্পই সেখানে প্রধান।

সেবন্তী ঘোষ
শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০২১ ০৪:২৮
Share: Save:

মেরহাবা তুর্কিয়ে
সুপর্ণা দেব
ঋত প্রকাশন, ২০১৯

মজলিশি আড্ডার ছলে লেখিকা আমাদের মন্ত্রমুগ্ধের মতো উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে এক উড়ন্ত গালিচার উপরে বসিয়ে দেন এবং তুরস্কের অতীত বর্তমান ইতিহাস ভূগোল অর্থনীতি সমাজনীতি বহু বিচিত্র ধর্মীয় ঐতিহ্যের একেবারে হদ্দমুদ্দ করে ছেড়ে দেন। আপাত ভাবে তুরস্কের কাপোদোকিয়া বা কাটপাটুকা (তেজি সুন্দর ঘোড়ার দেশ) কোনিয়া, আন্তিলিয়া, এফেসাস, ইস্তাম্বুল, উসকুদার ভ্রমণের গল্প, কিন্তু তার চলন গল্প বলিয়ের।

মেরহাবা তুর্কিয়ে শুরু হয়েছে সুবিখ্যাত এফেসাসের কথা দিয়ে, বিশেষত মেয়েদের গল্পই সেখানে প্রধান। প্রধান দেবী আরটেমিস ও মা মেরিকে ঘিরে আবর্তিত হলেও চমক লাগে অন্য একটি বর্ণনায়। এফেসাসে জড়ো হয়ে থাকা ভাঙাচোরা পাথরের মধ্যে পৃথিবীর আদিমতম বিজ্ঞাপনে চোখ যায় লেখিকার। “বড়ো পায়ের ছাপ, মানে প্রাপ্তবয়স্ক হলেই এসো, ওই যে গর্ত, তার মধ্যে যত পারো মুদ্রা ঢালো, তা হলে পাবে তোমার কাঙ্খিত মেয়েটিকে। যদি এ সব না থাকে উল্টো পথে হাঁটো, সোজা চলে যাও সেলসাস লাইব্রেরিতে। যদি বয়স কম হয়, যদি পয়সা না থাকে, সেলসাস লাইব্রেরির জ্ঞানভান্ডার তোমার উপযুক্ত জায়গা।”

লেখিকার ভ্রমণকাহিনিতে অটোমানদের প্রাসাদের বর্ণনা আছে। কিন্তু আদি খ্রিস্টান পর্বের অসহনীয় কঠোর জীবনযাত্রার বর্ণনা ও নিজেদের রক্ষা করার জন্য গোপন বাসস্থানের বর্ণনা যেন বেশি নিখুঁত ভাবে ফুটে উঠেছে। এর পরেই মোক্ষম কিছু উপলব্ধি! “এই আয়োজন বিপুল বিস্মিত ও বিজ্ঞানসম্মত হলেও কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে পড়লাম। ধর্ম মানুষকে কেমন তাড়া করে বেড়ায়!”

এই এফেসাসেই মেরিয়ামানা বা মারিয়ম আনায়, মা মেরির আবাসে নিয়ে যাচ্ছেন আমাদের, যেখানে ‘দুই ধর্মের মানুষরাই মেরির এই বাড়ির বাইরে মানত করে। বাইবেলের থেকে নাকি কোরানে মা মেরির বেশি উল্লেখ আছে।’ এই ঢিল বাঁধা সুতো বাঁধা ধরনের মানুষদের প্রসঙ্গে এসে যায় ‘শামান প্রথা’র উল্লেখ। তুর্কিরা মুসলমান হওয়ার আগে নাকি শামান ছিল। শামান অতি প্রাচীন উপজাতীয় তন্ত্র-মন্ত্রের ধর্ম, যেখানে আত্মা শয়তান মানুষ ও দেবতার মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনকারী বিশ্বাসের কথা বলে। শামান মতের খানিক রীতি নিয়ম নাকি প্রভাবিত করেছে সুফিদের। ওই যে তাদের ঘূর্ণায়মান ঘোর, তা নাকি সূর্যের পাশে গ্রহদের ঘোরার অনুকরণ, ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষার নিবৃত্তি ঘটিয়ে ঈশ্বরের দিকে যাত্রাও বটে।

গল্প-প্রতিগল্প। এফেসাসের নির্যাস যোদ্ধা মেয়ে আমাজনদের কথা বলেন লেখিকা। মাজোস বা স্তন (ডান দিকের) কেটে ফেলত তারা, যাতে ভাল ভাবে তির-ধনুক চালানো যায়।

গল্প গল্পের লেজ ধরে টেনে নিয়ে আসে। মিথ, দোর্দণ্ডপ্রতাপ দেবদেবী রাজারাজড়ার পাশে সগৌরবে আছে কবি ও কবিতার কথা। “তুরস্ক প্রেম আমার গতজন্মের উত্তরাধিকার...জালালুদ্দিন রুমি, নাজ়িম হিকমত, কামাল আতাতুর্ক আর ওরহান পামুকের দেশ।” কখনও বাজারের পাশেই একটা দোকানে বসে সাহিত্যিক নাইব মেহেফুজ মিন্ট চা খাওয়ার কথা, কখনও ‘ভালোবাসার শহর’ শিরোনামে আসে নাজ়িম হিকমতের কবিতা। ‘গুলহানে পার্কের আখরোট গাছ’। এই পার্কে একটি আখরোট গাছের নীচে দাঁড়িয়ে বান্ধবীর জন্য অপেক্ষা করতেন নাজ়িম। লেখিকা সেই কবিতাটি তুলে এনেছেন।

“দ্য ওয়ালনাট ট্রি/ আমার মাথার ভেতরে মেঘের বুদবুদ।/ আমার ভেতরে বাইরে সমুদ্র থৈথৈ /গুলশানে পার্কে আমি একটা আখরোট গাছ।/ একটা আখরোট গাছ, মোচড়ে মোচড়ে। স্তরে স্তরে/ তুমিও জানো না, পুলিশও না।”

নাজ়িম পুলিশ দেখে এই আখরোট গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়লেন। বান্ধবী হতাশ ভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চলে গেল। পুলিশও চলে গেল কিছু ক্ষণ পর। “সে আখরোট গাছ নাজিমকে জড়িয়ে লুকিয়ে রাখল। কবি একটা আস্ত গাছে একরাশ কষ্ট নিয়ে বেবাক দাঁড়িয়ে রইলেন।”

সেখানেই গাইড মেসুট এরজান আনাতোলিয়ার পপ সিঙ্গার জেম কারাচা-র কথা শোনায়। লেখিকা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অনুবাদের কথা, নাজ়িমের নামে রাস্তার কথা জানান মেসুট এরজানকে।

‘আসে বেইন্তেহা ইশক, সীমাহীন ভালবাসার আকাশে পাখির মত ডানা মেলা’ ইরানের শামস-এ-তাব্রিজি’র কথা। আরবি ভাষায় ‘শামস’ মানে সূর্য। সে লিখেছিল “ভালবাসা যেন জীবনদায়ী জল হৃদয় দিয়ে আত্মা দিয়ে একেবারে তলানিটুকু পান করে।” লেখিকা চলেছেন কোনিয়ায়। জলালুদ্দিন রুমি মেভলানার (মৌলানা) দেশ। লেখিকা জানান, ত্রয়োদশ শতকের এই মানুষটি আজও অন্যতম বেস্টসেলার!

ভারী খুশবুদার এই কাহিনি। পুরো ভ্রমণকাহিনি জুড়ে কয়েক শতক ধরে গল্প যেন কখনও রুটি জলপাই তেল নুন মরিচ অ্যাপ্রিকট আঙুর মজিয়ে মদে, কখনও মেনেমেনের ডিম-টমেটো-চিজের জমাটি আহ্লাদি খাবারে, পেয়ালার পর পেয়ালা তুর্কি চা, ঘরে তৈরি সুস্বাদু চকলেট, পুদিনা, দিল, রোজ়মারি, কখনও ইস্তিকলাল স্কোয়ারের মিষ্টান্ন ভান্ডার হাফেজ মুস্তাফার লোকেদের চিৎকার— ‘বাকলাভা কুনেফে!’ ধ্বনিতে, কখনও বা আইরন কাবাব, দোনদুরমা, মেইজে, হামাস, বাবা গানুশ অলিভ, পার্সলে রুটি দইয়ে ডুবে যাবে। কী নিয়ে যে লেখেননি লেখিকা! পুরো ভ্রমণকাহিনি জুড়ে ইজিয়নের সেই নীলচে হাওয়ায় বুনো ল্যাভেন্ডারের গন্ধের ভিতরে তার স্বপ্নের জোনাকিরা জ্বলে ওঠে। হাম্মাম থেকে সাবুন পেস্তামাল (তোয়ালে), চোখ ঝলসানো নীল ‘ইভ্‌ল আই’, অটোমান এলিটদের হাত ধরে ইউরোপে পাড়ি দেওয়া টিউলিপের ইতিহাস আর সমস্ত জীবনের রস চেটেপুটে খাওয়ার পর এসে দাঁড়ায় ‘স্ট্রিম অব ইটার্নিটি’, অনন্তের ধারা— মৃত্যু, একটা নাথিংনেসের দরজায়— “তুমি আমি সবাই সেই পথে হেঁটে চলেছি, অনন্ত টানেল, ‘এনজয় দিস নাথিংনেস ইফ ইউ ক্যান’।”

মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক-এর কথা স্বভাবতই আসে। খলিফা তন্ত্রের অবসান আধুনিক তুরস্কের জন্ম তাঁর হাতে। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও সে দেশ সেক্যুলার হল। পর্দা সরে গেল, মেয়েরা পেল গণতান্ত্রিক অধিকার। তবে, লেখিকার দেখে আসা আয়া সোফিয়া এই সে দিন আবার আদালতের রায়ে, উল্লসিত জনগণের ধর্ম উন্মাদনায় মিউজিয়ম থেকে বদলে গেল দৈনন্দিন ধর্মপালনের মসজিদে!

অন্য বিষয়গুলি:

book review
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy