নিমগ্ন: নিজের স্টুডিয়োয় যোগেন চৌধুরী। শান্তিনিকেতন, ২০০২। ছবিটি বই থেকে নেওয়া।
দি আফটারলাইফ অব সাইলেন্স/ স্টিল লাইফস অব যোগেন চৌধুরী
অনুরাধা ঘোষ
১৫০০.০০
নিয়োগী বুকস
আজকের শিল্প প্রেক্ষাপটে চিত্রী যোগেন চৌধুরীর অবস্থানটি কোথায়, সে প্রসঙ্গে আমাদের মনে কোনও দ্বিমত নেই। কলাশিল্পের বিভিন্ন বিভাগে অনায়াস যাতায়াত ঘটলেও চিত্রকলার আসরেই তাঁর সর্বাধিক প্রসিদ্ধি, তিনি এ দেশের এক জন প্রথম সারির চিত্রকর। পিছনে তাকিয়ে প্রথিতযশা এই শিল্পীর যাত্রাপথের দিকে লক্ষ করলে বোঝা যায়, কী ভাবে সময়ের সঙ্গে তা বাঁক নিয়ে এগিয়েছে।
বিগত পঞ্চাশ বছরে শিল্পীর কাজের প্রবহমান ধারাটি প্রকৃতই আমাদের নিয়ে যায় এক আশ্চর্য বিস্ময়ের প্রান্তে। তাঁর ছবি মনকে আন্দোলিত করে, চেতনার গভীরে গিয়ে তীব্র আঘাত করতে উদ্যত হয়। ইতিহাসের পটে আমরা দেখেছি, বিশ্ব জুড়ে সুন্দরের তথাকথিত সংজ্ঞা বদলেছে প্রথম মহাযুদ্ধের প্রেক্ষিতে, শিল্পী যোগেন চৌধুরীর ছবিতেও সেই অসুন্দরের আনাগোনা যেন। তাঁর ছবি চোখকে ভোলায় না, মনকে ভাবায়। দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্যময়তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে উন্মোচন করে এক অন্য জগৎ। যে জগৎ প্রধানত ছেয়ে আছে যন্ত্রণাকাতর আর্তের হাহাকারে, হিংসার উন্মত্ততায়, ক্ষমতাসীনের প্রতি বিদ্রুপের নিন্দিত ইশারায়, যৌনতার তীব্র ইঙ্গিতে।
তাঁর ক্যানভাসের দিকে তাকালে অজানতেই দর্শকের বুকের মধ্যে ঘৃণা-ভয়-সঙ্কোচ মেশানো এক হিমশীতল স্পর্শ অনুভূত হয়। ছবিতে কোথাও ভেসে ওঠে পাপের প্রতিমা, বাস্তব আর কল্পনার অলৌকিক দোলাচলে আবিষ্ট দর্শকের চোখ মুহূর্তে সরে যেতে চায়, কিন্তু সেখানেই শাণিত হয় শিল্পীর দুর্মর জেহাদ। একই সঙ্গে বুঝি বিপরীত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার রহস্যময় কারসাজি চলতে থাকে তাঁর চিত্রমালায়। প্রথমে যে ক্যানভাস আপাত ভাবে আমাদের ঠেলে সরিয়ে দিতে চায়, পর ক্ষণেই কী এক অমোঘ আকর্ষণে সে টেনে আনতে বাধ্য করে। ছবির বিষয় ও বিন্যাস ভাবনার পাশাপাশি শিল্পী তাঁর চিত্রপটে এক স্বতন্ত্র আঙ্গিকের নির্মাণ করেন; যে চিত্রভাষা শিল্পীর নিজস্ব, একান্ত ভাবেই তাঁর ব্যক্তিগত।
আবার এ-ও ঠিক যে, আর্তি ও প্রতিবাদের করুণ হাহা-ধ্বনি ছাপিয়ে তাঁর ক্যানভাস আলোকিত হতে চায় মানুষের শরীরী বিভঙ্গে, যার অন্যতম অংশ হল নারীদেহের অনুপম সৌন্দর্য। সেই ছন্দোময় চিত্রসুষমা কেবল নারীদেহের সীমানায় আবদ্ধ থাকে না, সমান ভাবে তা ছড়িয়ে পড়ে চিত্রপটের অন্যখানে, এমনকি দেহাবয়বের বাইরেও। ছড়িয়ে পড়ে ছবির ফুলদানির গায়ে, ফুলের পাপড়ি থেকে পল্লবিত লতার পত্রালিতে, কখনও বা প্রজাপতির পেলব পাখনায়। সেখানেই শেষ নয়, শয্যার অলঙ্কৃত চাদরে, বিছানায় অলস শয়ান কোলবালিশের গায়ে, ঝালর দেওয়া মাথার বালিশের মায়াবী অবস্থানে— সর্বত্র সঞ্চারিত সেই শিল্পিত বিস্তার।
অথচ রঙের উপস্থিতি তেমন জোরালো নয়, সচেতন ভাবেই শিল্পী তাঁর ছবির প্যালেটকে সীমিত রাখেন, উজ্জ্বল রঙের মায়ায় তিনি দর্শকের চোখ ভোলাতে রাজি নন, বরং রেখা ও টোনের উপরেই তাঁর প্রধান ভর। আবার সাম্প্রতিক সময়ে তাঁর বেশ কিছু ছবিতে রঙের ঝলকানি আমাদের নজর এড়ায় না। বলতে বাধা নেই, যোগেন চৌধুরীর ছবির নিজস্ব টিপছাপ তাঁর মনোক্রোম-ঘেঁষা টোনের ইন্দ্রজালে।
আর সব ছাপিয়ে তাঁর চিত্রের অন্যতম দিক ছবির স্পর্শগুণ, চিত্রপটের ত্বকে এমন স্পর্শময় অনুভূতি সহসা নজরে পড়ে না। খেয়াল করলে দেখি, তাঁর শিল্পীসত্তার গভীরে নিহিত আছে কঠোর পরিশ্রম এবং কাজের প্রতি নিষ্ঠার অমোঘ মন্ত্র। প্রতিভার পাশাপাশি এই সুদৃঢ় পরিশ্রম আর অবিচল নিষ্ঠা চিত্রী হিসেবে আজ তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে খ্যাতির শিখরে।
স্বাভাবিক ভাবেই, যোগেন চৌধুরীর চিত্রকলা বিষয়ে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় একাধিক উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ মুদ্রিত হয়েছে। তবে আলোচ্য বইটি আলাদা ভাবে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে— এর অন্যতম কারণ বইটির বিষয়ভাবনা। শিরোনামের পাশাপাশি বিশেষ সাবটাইটেল দ্বারা চিহ্নিত: স্টিল লাইফস অব যোগেন চৌধুরী। নামকরণের কাব্যময়তা পেরিয়ে এটিই বইয়ের মূলকথা। আমরা দেখেছি, যোগেন চৌধুরীর চিত্রপটে সাধারণত শরীরী আনাগোনার প্রাধান্য। তাঁর ক্যানভাসে অজস্র বার স্টিল লাইফের জোরালো উপস্থিতি ফুটে উঠলেও তাঁর ফিগারেটিভ ছবির আবেদন আমাদের কাছে অন্যতম প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। তথাপি, কেবলমাত্র স্টিল লাইফ অবলম্বনে তাঁর মতো শিল্পীর কাজের আলাদা গ্রন্থ উপহার দেওয়ার জন্য লেখিকাকে সাধুবাদ জানাতে হয়। বিষয়চিন্তার মধ্যেই তিনি স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত করেছেন।
বইয়ের অন্দরে প্রবেশ করে এর সূচির দিকে তাকানো যাক। দীর্ঘ ভূমিকা-সহ চারটি প্রধান অধ্যায় জুড়ে বইয়ের মূল বিন্যাস। প্রথমে ‘দি আফটারলাইফ অব সাইলেন্স’, যা একাধারে বইয়ের শিরোনামও বটে। পরের অধ্যায় দু’টি যথাক্রমে ‘ডেডনেস অ্যান্ড ডিজ়ায়ার’ এবং ‘স্টিল লাইফ অ্যান্ড বিয়ন্ড’। এর পরে শিল্পীর একটি সুদীর্ঘ সাক্ষাৎকার, যা বইটির অন্যতম সম্পদ। এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘লাইফ, স্টিল লাইফ অ্যান্ড দ্য ডিসিপ্লিন অব ইকুয়ালিটি’। আর সব শেষে গবেষণাধর্মী গ্রন্থের রীতি অনুসারে বিন্যস্ত হয়েছে সহায়ক গ্রন্থের সূচি, ধন্যবাদ জ্ঞাপন ও নির্দেশিকা। সব মিলিয়ে ২১২ পাতার চিত্রশোভিত বইটি বেশ আকর্ষক।
দীর্ঘ ভূমিকাটি গুরুত্বপূর্ণ, বিস্তৃত আলোচনায় শিল্পীর কাজের ধারা ও বিশ্লেষণের সুরটি সুস্পষ্ট বাঁধা পড়েছে, পাশাপাশি আভাষিত হয়েছে স্টিল লাইফের হাল-হকিকত। অর্থবহ শিরোনামের দ্বারা পর্বটি চিহ্নিত— ‘স্টিল লাইফ: রিজিয়োনাল নেগোসিয়েশনস’। পরের অধ্যায়ে মূলত এসেছে শিল্পীর আঁকা সত্তরের দশকের ছবিগুলি। এই অধ্যায়ের ‘রেমিনিসেন্সেজ় অব আ ড্রিম’ সিরিজ়ের কাজগুলি আলাদা ভাবে নজর কাড়ে, ছবির আলোচনায় লেখিকার দক্ষতা স্পষ্ট। এ যেন যথার্থই জীবনের প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা নৈঃশব্দ্যের প্রশান্ত প্রতিমা। এই সময়ের অধিকাংশ ছবি প্রায় বর্ণহীন সাদা-কালোর আবহে প্রতিভাত হতে দেখি। শিল্পীর প্রেম ও বিরহের পারস্পরিক টানাপড়েনে বোনা ছবির সিরিজ় যেন জীবনের প্রতীকায়িত চিত্রমালা, যেখানে ঘন অন্ধকার চিত্রপট অধিকার করে থাকে সূর্যমুখী ফুল, ভেসে থাকে মৃত মাছের সারি, পুষ্প-পল্লবিত লতার পাশে চায়ের পেয়ালা, দলাপাকানো কাপড়ের বান্ডিল, অবহেলায় পড়ে থাকা আপেল, ডানা ছেঁড়া প্রজাপতির সঙ্গে কোথাও বা একটু ছুঁতে চাওয়া করতলের করুণ হাতছানি। এরা যেন ছবি নয়, কালিকলমের অনুভূতিময় আঁচড়ে বুনে দেওয়া চিত্রকরের গহন অন্তরের কাব্যগাথা। পরবর্তী ধাপের ‘ডেডনেস অ্যান্ড ডিজ়ায়ার’ এবং ‘স্টিল লাইফ অ্যান্ড বিয়ন্ড’ অধ্যায় দু’টিও সু-আলোচিত, তবু কিছু বিতর্কের অবকাশ থেকে যায়, বিশ্লেষণের বিস্তারে কোথাও একটু পুনরাবৃত্ত ঠেকে। তা হলেও বলব, গ্রন্থ রচনা ও বিন্যাসে সামগ্রিক ভাবে একটি উষ্ণ অভিনন্দন লেখিকার প্রাপ্য। নিয়োগী বুকস-এর অন্যান্য বইয়ের মতো এরও ছাপা-বাঁধাই বেশ ঝকঝকে, স্মার্ট। কয়েকটি ছবি যদিও একটু অফ-ফোকাস লাগে, যা ছবির বইতে হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। আর একটা কথা, মলাটের অক্ষরলিপিতে শিল্পীর নামের হরফ-সহ রংটি কালো পশ্চাৎপটের সঙ্গে মিশে গিয়েছে— এই পরিকল্পনা কি সজ্ঞানকৃত? অবশ্য প্রচ্ছদের ছবিটি আলোচিত চিত্রীকে অনায়াসে চিনিয়ে দেয়। বইয়ের মলাট দেখে আমাদের মনে পড়তে পারে রবীন্দ্রকবিতার সেই টুকরো— “আর কিছু নয়, হাসিতে তোমার পরিচয়...।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy