অগ্রন্থিত কবিতা
বীতশোক ভট্টাচার্য
সঙ্কলন ও সম্পা: অপু দাস
৪০০.০০
আদম
এই সংগ্রহে গৃহীত বীতশোক ভট্টাচার্যের কবিতাগুচ্ছ থেকে বোঝা যায়, তিনি দূরগামী সঙ্কেতধর্ম ও রহস্যময় বাক্শৈলীর অধিকারী এক কবি। যে কারণে তাঁর কোনও কবিতা এক বার পড়লেই ফুরিয়ে যায় না। বারংবার পড়ার জন্য পাঠককে আকর্ষণ করে। সমকালেই এ কবিতার জন্ম ও বিলয় নয়। ভবিষ্যতের
জন্যও সে কাব্য মূল্যবান ঐশ্বর্যরাশি সঞ্চিত রাখে।
১৯৬৯-এ বীতশোকের কবিতা প্রথম ছাপা হয়। আর প্রথম পূর্ণাঙ্গ একক কাব্যগ্রন্থ শিল্প বেরোয় ১৯৮৬ সালে, কালবেলা নামক এক লিটল ম্যাগাজিনের উদ্যোগে। অর্থাৎ, সতেরো বছর ধরে সাধনা করে তবে এল প্রথম বই। এই সাধনা দুর্লভ ও শিক্ষণীয়। সত্তর দশকের প্রথম দিকে দেশ পত্রিকায় ‘সনাতন পাঠক’ ছদ্মনামে একটি কলাম লিখতেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। বীতশোকের কবিতা বিষয়ে সেখানে সুনীল লেখেন, “এ-সময়ে বীতশোক ভট্টাচার্য তো অনন্য।”
মাত্র আঠারো বছর বয়সে কাব্যজগতে আবির্ভূত হয়ে, তেতাল্লিশ বছর ধরে অবিরল কবিতা ও প্রবন্ধ লিখে বীতশোক প্রয়াত হন ২০১২ সালে। কখনও কোনও কবিসভায় দেখা যেত না তাঁকে। বীতশোকের পাঠপরিধির ছিল বিরাট এক বিস্তার। পশ্চিমের সাহিত্যকে যেমন গভীর ভাবে জানতেন তিনি, তেমনই জানতেন প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতি ও পুরাণ, সংস্কৃত কাব্য, বৌদ্ধ দর্শন, লোকগাথা। পাশাপাশি জ়েন কবিতা, জ়েন গল্প এবং চর্যাপদের অনুবাদকর্ম, এই সমস্তই সমীকৃত হয়েছিল তাঁর জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রে। পাঠ-অভিজ্ঞতার সঙ্গে ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতা অক্লেশে মিশে যেত তাঁর কবিতায়। বাংলা ছন্দরীতির প্রত্যেকটি বিভাগকে অসম্ভব দক্ষতায় আত্মসাৎ করেছিলেন তিনি। অথচ, ছন্দের শৃঙ্খলকে ছাড়িয়েও গেছেন অপার স্বাধীনতায়।
স্বাধীনতা— এই শব্দটি একেবারে অব্যর্থ বীতশোকের ক্ষেত্রে। গ্রিক কবি কনস্তানতিন কাবাফি বলেছিলেন, “যে কবি জানেন যে তাঁর পাঠকসংখ্যা সীমিত, লেখার ক্ষেত্রে তিনি বিপুল স্বাধীনতা নিতে পারেন।” বীতশোকের কবিতা এই ‘বিপুল স্বাধীনতা’কেই প্রকাশ করেছে। তিনি কোথাও বাঁধা পড়েননি। নিঃশব্দের তর্জনী-তে শঙ্খ ঘোষ লেখেন: “একই শব্দে হয়তো কাজ চলে যায় যেমন এক লোহাতেই তৈরি হতে পারে শিকল আর হাতিয়ার, কিন্তু শিকলের গাঁটগুলিকে আঘাত করে ভেঙে দেওয়ার কথা ভাবতে হয় কবিকে। একটি বাক্য বা বাক্যখণ্ডের মধ্যে শব্দ সাজাবার যে পদ্ধতি তারই মধ্যে থেকে যায় এই গাঁটগুলি। ঠিক শব্দের উপরেই আঘাত তত জরুরি নয়, যতটা জরুরি মধ্যবর্তী ওই অংশগুলির উপরে আঘাত, দুই শব্দের সংযোগবিন্দুর উপরে।”
এ কাজ সারা জীবন করে গেছেন বীতশোক, এক অতুলনীয় তীক্ষ্ণতার সঙ্গে। একটি দৃষ্টান্ত দিই: “মানুষ, তুমি পেটে ধরেছিলে ন’ মাসের পাথর;… পাথর তো ফেটে যাবেই তুমি ভারী মাসে পড়লে।” ‘মানুষ’ এবং ‘পাথর’, এই শব্দ দু’টির এমন ব্যবহার বীতশোকের আগে আর বাংলা কবিতায় ঘটেনি। নারীর গর্ভাবস্থার কথা নানা জনের কবিতায় এসেছে। কিন্তু এ ভাবে নয়। আবার, ‘মানুষ’ এবং ‘পাথর’ শব্দ দু’টিতে যেন নব সঙ্কেত জন্মাল। ‘মানুষ’ কথাটি দিয়ে নারীও যে মানুষ, সে যে পুরুষের চেয়ে দুর্বল ও হীন নয়, বরং শক্তিশালী— কারণ নারীকে গর্ভধারণ ও প্রসবযন্ত্রণা সহ্য করতেই হয়, যে যন্ত্রণার হদিস পুরুষ কখনওই পায় না— সেই বার্তা দেওয়া হল এখানে, পুরুষজাতির প্রতি কোনও প্রকট যুদ্ধ ঘোষণা ছাড়াই। তা ছাড়া, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের পর ‘পাথর’ শব্দটিতে নতুন অর্থস্তর ভরে দেওয়াও খুব কঠিন কাজ ছিল।
সত্তর দশকে রচিত বীতশোকের অগ্রন্থিত কবিতা নিয়ে এ সঙ্কলন তৈরি করেছেন অপু দাস। অত্যন্ত জরুরি একটি গদ্য এই সঙ্কলক লিখেছেন বইয়ের শেষে। অপু দাস ১৯৯৭ সালে জলার্ক পত্রিকায় বীতশোকের কবিতা নিয়ে আরও একটি প্রবন্ধ লেখেন, যা বীতশোকের অগ্রন্থিত কবিতার পরবর্তী সঙ্কলনে যুক্ত হওয়া অপরিহার্য বলে মনে করি। হ্যাঁ, দ্বিতীয় একটি খণ্ডও নিশ্চয়ই বেরোনো দরকার। কারণ আনন্দ পাবলিশার্স প্রকাশিত বীতশোকের জলের তিলক নামক কবিতাগ্রন্থ এখনও তাঁর দু’টি কাব্য সংগ্রহের কোনওটিতেই স্থান পায়নি। ২০০৩ সালের জুলাইয়ে দেশ পত্রিকায় একটি সুদীর্ঘ কবিতা লিখেছিলেন এই কবি— সে লেখারও গ্রন্থভুক্তি হয়নি এখনও।
তবে আশা আছে। কারণ, অপু দাস আছেন। একনিষ্ঠ পরিশ্রমে বীতশোকের প্রতিটি কবিতা রচনা তারিখ-সহ উদ্ধার করে চলেছেন অপু দাস। সে সব কবিতার প্রবেশপথ খুলে ধরছেন গদ্য লেখায়। এই সঙ্কলক-সম্পাদক আমাদের কৃতজ্ঞতাভাজন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy