ভরকেন্দ্র: লালবাজার। ব্রিটিশ আমল থেকেই কলকাতা পুলিশের যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় এখান থেকে।
প্রথমে ঠিক নজর যায়নি। লালবাজারে কলকাতা পুলিশের ‘অ্যান্টি ডেকয়টি সেকশন’-এ ঢুকে পরিচিত অফিসারের টেবিলের কাছে যাওয়ার পরে চোখ পড়েছিল যুবকটির উপর। ওই অফিসারের চেয়ার ঘেঁষে মাটিতে উবু হয়ে বসে থাকা চেহারাটা বুঝিয়ে দিচ্ছে, ‘অতিথি আপ্যায়ন’-এর বন্দোবস্ত পাকা। অবিন্যস্ত চুল, চোখ দুটো লাল। ক্ষয়াটে চেহারা ঢেকে রেখেছে যে পোশাক, তার চেহারাটাই আরও ক্ষয়াটে যেন! খালি পা, মাথাটা ঝুঁকে পড়ছে বার বার... ঠান্ডা অথচ কাটা কাটা উচ্চারণে ওই অফিসার বলছেন, ‘‘বলে দে তাড়াতাড়ি, ডাকাতির মাল কোথায় রেখেছিস? দলে আর কে কে আছে? না বললে... (তারই মধ্যে হাতের ইশারায় উল্টো দিকের চেয়ারে পরিচিত সাংবাদিককে বসতে বলার ইঙ্গিত)।’’ ফ্যাসফেসে কণ্ঠস্বর বলে চলেছে, ‘‘আমি জানি না স্যার, সত্যি বলছি, কাল থেকেই তো বলছি স্যার।’’ ‘‘অ্যাই ...বাবু, ওকে ভিতরে নিয়ে যান, আমি আসছি।’’ ভিতরে বলতে লাগোয়া অ্যান্টি চেম্বারের মতো একটি ঘর, বাইরে সবুজ পর্দা ঝুলছে। স্বগতোক্তির মতো বলছিলেন ওই অফিসার, ‘‘সারা রাত রেড চলেছে। কয়েক জনকে ধরা হয়েছে। ও অনেক কিছু জানে, দেরি হলে বাকিদের ধরা কঠিন হয়ে পড়বে। এই গ্যাংটাকে ধরতেই হবে! ওদের মুখ না খোলানো পর্যন্ত বাড়ি যেতে পারব না।’’
বেশ ক’বছর আগের কথা। সময়টা মুঠোফোনের নয়— ইন্টারনেট, হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক তো মঙ্গলগ্রহের বাসিন্দা! প্রযুক্তি উন্নত হয়নি। কিন্তু, অপরাধের রহস্য উদ্ঘাটনে লালবাজারের গোয়েন্দাদের প্রয়াসকে কোন যুগেই বা কে আটকাতে পেরেছে! কিছু দিন ‘পুলিশ বিট’-এর সাংবাদিক হিসেবে লোকচক্ষুর আড়ালে তাঁদের কর্মকাণ্ড চাক্ষুষ করার খানিক সুযোগও হয়েছে। পুলিশি ব্যর্থতার সমালোচনার পাশাপাশি এ কথাটাও স্বীকার করে নেওয়া ভাল।
এই স্মৃতির ঝাঁপি খুলে যাওয়ার মূলে দু’খণ্ডের একটি বই। লেখক সুপ্রতিম সরকার অভিজ্ঞ ও দক্ষ আইপিএস অফিসার, বর্তমানে কলকাতা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার। প্রথম খণ্ডে তিনি বেছেছেন চাঞ্চল্যকর ও নানা দিক থেকে স্বতন্ত্র বারোটি মামলা। সময়কাল গত শতকের তিরিশের দশক থেকে হালফিলে বছর এগারো আগে পর্যন্ত।
গোয়েন্দাপীঠ লালবাজার/ এক ডজন খুনের রুদ্ধশ্বাস নেপথ্যকথা
গোয়েন্দাপীঠ লালবাজার ২/ স্টোনম্যানসহ এগারোটি রোমহর্ষক মামলার শেষকথা
সুপ্রতিম সরকার
২৫০.০০ প্রতি খণ্ড
আনন্দ পাবলিশার্স
প্রথম খণ্ডে ‘লেখকের কথা’য় যথার্থই বলেছেন সুপ্রতিম, ‘জটিল খুনের মামলার তদন্ত অনেকাংশে তুলনীয় টেস্ট ক্রিকেটের সঙ্গে। একদিনের ম্যাচ নয়, কুড়ি-বিশের বিনোদন তো নয়ই। ঘটে যাওয়া অপরাধের কিনারা করা সিঁড়ির প্রথম ধাপ মাত্র।... দীর্ঘ বিচারপর্বে অভিযুক্তের শাস্তিবিধান নিশ্চিত করতে পারলে তবেই বৃত্ত সম্পূর্ণ হয় তদন্তের। রোম্যান্স-রোমাঞ্চ বর্জিত এই পথ পাড়ি দিতে অশেষ ধৈর্যের প্রয়োজন হয়... প্রয়োজন হয় শত প্রতিকূলতাতেও ক্রিজে দাঁত কামড়ে পড়ে থাকার অধ্যবসায় এবং মনোসংযোগের।’
এই কথাই যেন মান্যতা পেয়েছে প্রথম খণ্ডে ঠাঁই পাওয়া মামলাগুলির তদন্তের ক্ষেত্রেও। যেমন, একদা বহুচর্চিত বণিকবাড়ির বধূ দেবযানী বণিক হত্যা মামলা। মিডলটন স্ট্রিটের অপহৃত কিশোর অনুরাগ আগরওয়ালের হত্যারহস্য, বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের অভিজাত বহুতলে রবিন্দর কউর লুথরার খুন, কিড স্ট্রিটে বিধায়ক রমজান আলির খুন— চাঞ্চল্যকর নানা হত্যারহস্য।
বঙ্গজীবনের নানা ওঠাপড়ার মধ্যেও বাঙালি কিন্তু যুগে যুগে নিজেদের ম্যাটিনি আইডল গোয়েন্দাদের খুঁজে নিয়েছে। ব্যোমকেশ বক্সী, কিরীটি রায়, কিংবা ফেলুদা! গায়ে কাঁটা দেওয়া অপরাধ, গাঢ় আঁধারের মতো জমাট রহস্য দিনের পর দিন উদ্ঘাটন করেছেন বাঙালির একেবারে নিজস্ব গোয়েন্দারা। যত কঠিন অপরাধই হোক, ব্যোমকেশ-ফেলুদাকে দুষ্টের দমন করতেই হবে। না হলে পাঠক ছাড়বে কেন?
কিন্তু বাস্তবের ব্যোমকেশ বা ফেলুদার ক্ষেত্রে কী হবে? এমনও নয় যে কলকাতা পুলিশ একেবারে আদর্শ পরিবেশে কাজ করে, গোয়েন্দারা একটি কেস নিয়েই পড়ে থাকেন, স্রেফ মগজাস্ত্রের ভেল্কি দেখিয়েই একটার পর একটা কেস সমাধান করে ফেলেন তাঁরা!
আর ঠিক এখানেই সুপ্রতিমের সাফল্য! অসামান্য লেখনী তাঁর। একেবারে শেষ লাইন পর্যন্ত রহস্য ধরে রাখার, তদন্তের গতিপথের নানা বাঁকে গোয়েন্দাদের সঙ্গে পাঠককেও নিয়ে চলার অনায়াস দক্ষতা একদা সাংবাদিকতা করা সুপ্রতিমের কলমে। এক অনুচ্ছেদ থেকে আর এক অনুচ্ছেদে এত মসৃণ ভাবে তিনি নিয়ে চলেন যে কোথাও ঝাঁকুনি লাগে না। চমৎকৃত করে ঘটনা ও চরিত্রের নিখুঁত বর্ণনা। এই সব লেখা প্রকাশিত হত কলকাতা পুলিশের ফেসবুক পেজে। প্রত্যেক সপ্তাহে ‘রহস্য রবিবার’ নামে পুরনো চাঞ্চল্যকর মামলাগুলি কলকাতা পুলিশ তাদের ফেসবুক পেজে পোস্ট করার সময় পাঠক মহলে বিপুল ভাবে সমাদৃত হয়েছিল।
দ্বিতীয় খণ্ডে সংগৃহীত মামলাগুলির সময়কাল ১৯৪৮ থেকে ২০১০ পর্যন্ত। এই খণ্ডের কাহিনি বিন্যাসও যুগের পরিবর্তনকে স্পষ্ট করে দেয়। সাবেক জীবনযাত্রায় অপরাধের প্রকৃতিও ছিল সাদাসিধে ও সাবেক। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দুষ্কর্মের প্রকৃতিও যে বদলাচ্ছে তার প্রমাণ দেয় এই কাহিনিগুলি। এর পর ধীরে ধীরে এসেছে ‘সাইবার ক্রাইম’, তাবৎ বিশ্বের পুলিশ বাহিনীর কাছে যার মোকাবিলা করা সব থেকে চ্যালেঞ্জের। এই খণ্ডে সুপ্রতিম বলেছেন, ‘‘...আজ এবং আগামীর তদন্তশিক্ষার্থীদের ভাবনার রসদ জোগানোর একটা দায়ও ছিল বাছাইপর্বে।’’
গোয়েন্দাপীঠ লালবাজার-এর দ্বিতীয় খণ্ডের একটা বড় বৈশিষ্ট্য হল, এখানে যে শুধু গোয়েন্দা বাহিনীর সাফল্যের খতিয়ান দেওয়া হয়েছে তা নয়, জায়গা দেওয়া হয়েছে ব্যর্থতাকেও। অর্থাৎ, বিস্তর চেষ্টার পরেও যে রহস্যের সমাধান করতে পারেনি কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ। যেমন, স্টোনম্যান মামলা। পাঠকদের অধিকাংশেরই স্মরণে থাকবে এই মামলার কথা। কলকাতার ফুটপাতে আশ্রয় নেওয়া বেশ কয়েক জন মানুষ মাথায় স্টোনম্যানের পাথরের আঘাতে প্রাণ হারান। এই হত্যা-পর্বের শুরুটা হয়েছিল ১৯৮৯-এর ৪ জুন ভোরে। এক এক করে বারো জন। না, কলকাতা পুলিশ আজও সে রহস্যের কিনারা করতে পারেনি। যে লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগের সঙ্গে বার বার স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের তুলনা টানা হয়, সেই গোয়েন্দারাও ব্যর্থ হয়েছিলেন এই রহস্যের সমাধানে।
ব্যর্থতা কোন ক্ষেত্রেই বা না হয়? কিন্তু, সেই ব্যর্থতার খতিয়ানকেও যে মোড়কে উপস্থাপন করেছেন সুপ্রতিম তা চমক জাগায়। দু’টি খণ্ডের সম্পদ প্রায় প্রতিটি কাহিনির সঙ্গে প্রাসঙ্গিক ছবি। অনেক ক্ষেত্রে দেওয়া হয়েছে নথিও।
পঞ্চানন ঘোষালের ‘পুলিশ কাহিনী’-তে প্রাচীন ভারতের পুলিশি ব্যবস্থার বিবরণ রয়েছে। সেখানে দু’ধরনের পুলিশ ছিল। গ্রামীণ পুলিশ ও নগর পুলিশ। কপিলবাস্তুর প্রাচীরবেষ্টিত নগরের চারটি সিংহদ্বার রাত্রিবেলা পাহারা দিত নগর পুলিশ। আর আজ? প্রহরা আজও আছে। শুধু পাল্টে গিয়েছে প্রেক্ষাপট। প্রহরার সঙ্গে অপরাধেরও। এই গ্রন্থ শুধু অপরাধের টানটান বর্ণনা দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, তুলে ধরেছে জটিল অপরাধপ্রবণ মনস্তত্ত্বের অন্দরমহলের কথাও। যে দিকে তাকালে সত্যিই শিউরে উঠতে হয়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy