উত্তরাধিকার: রক্তকরবী-র অভিনয়ে তৃপ্তি মিত্র ও শোভেন মজুমদার।
শাসকের মনবদল অথবা বিপ্লব
বিশ্বজিৎ রায়
১৩০.০০
দে’জ পাবলিশিং
স্বীকার করি আর নাই করি, আমাদের রবীন্দ্রপাঠ প্রায়ই হয় দ্বিখণ্ডিত। এক দিকে তাঁর সামাজিক-রাজনৈতিক প্রবন্ধ, অন্য দিকে কাব্য এবং কল্পাশ্রয়ী সঙ্কেতধর্মী নাটক— দুইয়ের মধ্যে আমরা একটা দেওয়াল তুলে দিই। ফলে কাব্য আর নাটকগুলো আমাদের বাস্তব জীবনে তেমন অঙ্গীভূত হয় না, ভাবাদর্শের স্তরে আবদ্ধ থাকে; এবং ইতিহাস-সমাজ রাজনীতি-অর্থনীতি নিয়ে প্রবন্ধাবলি হয় পড়ি না, কিংবা পড়ি কেবল অতীতের প্রেক্ষিতে। চিন্তা করি না, কালান্তর, কর্তার ইচ্ছায় কর্ম, বা আরও আগেকার রাজা প্রজা, সমূহ বা সমাজ-এর প্রবন্ধগুলি আজও কী প্রবল ভাবে প্রাসঙ্গিক। ভাবি না তাদের পাশাপাশি পড়া যায় অচলয়াতন, মুক্তধারা বা রক্তকরবী-র মতো নাটক, বা আগে-পরের অজস্র নিদর্শনের মধ্যে বিশেষ ভাবে নবজাতক-এর অনেকগুলি কবিতা। অগোচর থাকে প্রান্তিক-এর কবিতায় সভ্যতার সংকট-এর স্পষ্ট পূর্বাভাস।
রবীন্দ্ররচনার অপপ্রয়োগে আমাদের জনজীবন কণ্টকিত হয়ে উঠছে। সৎ ফলপ্রসূ প্রয়োগের তাই বিশেষ দরকার। বিশ্বজিৎ রায়ের এই ক্ষুদ্র বইটি সেই চাহিদা কিছুটা মেটাচ্ছে, সঙ্গে অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়ের মূল্যবান উত্তরভাষ।
বইটি মূলত দু’টি নাটক নিয়ে, রক্তকরবী আর মুক্তধারা। আমার বিচারে প্রথমটির আলোচনা বেশি মূল্যবান, কারণ সেখানে বিশ্বজিৎ আঙ্গিকের একটা মৌলিক প্রসঙ্গ তুলেছেন। রক্তকরবী-র আর্থনীতিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্য অবশ্যই স্বীকৃত; কিন্তু সেটা যেন খানিক ফিকে হয়ে যায় নাটকটি প্রতীকী বা সাঙ্কেতিক বলে অভিহিত হলে।
এমন ব্যাখ্যা অবশ্যই ভুল নয়। নাটকটির যে দার্শনিক বা আধ্যাত্মিক মর্ম, তার প্রকাশ প্রতীক ছাড়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু রাজা-র পাশাপাশি দেখলে যা বিশেষ করে ধরা পড়ে, রক্তকরবী-র আর্থসামাজিক তথা রাজনৈতিক মাত্রা কত পরিপুষ্ট, তার ভিত বাস্তবের মাটির কত গভীরে গাঁথা। স্ট্রিন্ডবার্গ বা চাপেক ভ্রাতৃদ্বয়ের সঙ্গে তুলনা ছাপিয়ে তাই যক্ষপুরীর শ্রমিকদের সংলাপের জুড়ি খুঁজতে হবে ব্রেশ্টের নাটকে (যার বেশির ভাগ তখনও অলিখিত); বা কিঞ্চিৎ অশিষ্ট রূপে মিলবে আমাদেরই অসংগঠিত শ্রমিকদের ডেরায়।
বিশ্বজিতের ব্যাখ্যার এটাই মূল সূত্র: রবীন্দ্রনাথ নাটকটিকে ‘নিতান্ত রূপক-প্রতীক’ ভাবেননি, তাঁর কাছে তা ‘সত্যমূলক’। রূপক-প্রতীকেও সত্য প্রকাশ পায়, কিন্তু রক্তকরবী-র সত্য একটা স্তরে সরাসরি আক্ষরিক, আধুনিক মানবসভ্যতার ক্লিষ্ট অপরিশুদ্ধ রূপ তুলে ধরে। তার মুখ্য প্রকাশ অবশ্যই ধনতান্ত্রিক সভ্যতার অর্থলিপ্সা, ক্ষমতার আস্ফালন এবং যান্ত্রিক উৎপীড়নে। রক্তকরবী-র রচনাকালে অবধারিত ভাবে এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে উপনিবেশবাদ। বিশ্বজিৎ শনাক্ত করেছেন আরও এক লক্ষণ: ‘নারীকে ঘিরে পুরুষের ঈর্ষা’। আর্থসামাজিক বিবাদ-বিচ্ছেদে ধ্বংস হচ্ছে ব্যক্তিসম্পর্ক ও মানবিক সত্তা।
বইটিতে মার্ক্স নিয়ে বিশেষ আলোচনা নেই (উত্তরভাষে খানিক আছে); তবে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার এই চিত্র অবশ্যই বৃহত্তর অর্থে মার্ক্সীয়। রবীন্দ্রনাথই এ ভাবে উপস্থাপন করেছেন— নিছক সাযুজ্যে, না সজ্ঞানে? আমাদের দেশজ মার্ক্সবাদীরা যে দীর্ঘ দিন রবীন্দ্রনাথকে অচ্ছুত করে রেখেছিলেন, সেটা তাঁদের বুদ্ধিভ্রম।
মার্ক্সের ক্লাসিক অনুগামীদের বিশ্বজিৎ আলোচনা করেছেন, এবং রেহাই দেননি— সোভিয়েট শাসন ও অর্থব্যবস্থার অমানবিকতা তুলে ধরেছেন, ফ্যাসিবাদী জার্মানি ও ইটালির পাশাপাশি। এই রাজত্বগুলির সঙ্গে কবির মোলাকাতের উল্লেখ আছে, যদিও (বিশেষত মুসোলিনির ক্ষেত্রে) রবীন্দ্রনাথের দ্বিধাবিহ্বল প্রতিক্রিয়া হয়তো বিশ্বজিৎ যথেষ্ট ফুটিয়ে তোলেননি। মার্ক্সপন্থী ভগৎ সিংহ সম্বন্ধে খানিক ইতিবাচক আলোচনা আছে, আর অবশ্যই অনেক বেশি আছে গাঁধীকে নিয়ে। অর্থব্যবস্থার যে সুস্থ সমাজভিত্তিক মানবিক রূপ গাঁধীর চিন্তায় ছিল, লেখক সেটা যুক্ত করছেন রবীন্দ্রনাথের অবস্থানের সঙ্গে।
ফলে রবীন্দ্রচিন্তার স্বকীয়তা অক্ষুণ্ণ রেখেও বিশ্বজিৎ রক্তকরবী-কে দেখছেন বৃহত্তর ঐতিহাসিক দৃষ্টিপটে। দেখাতে সক্ষম হয়েছেন, নাটকটি কবির সমকালীন সভ্যতার কেবল কল্পাশ্রয়ী প্রতীক নয়, আদত বাস্তবের মানবিক দলিল। নন্দিনীর ভূমিকা, এবং নন্দিনী ও রঞ্জনের সম্পর্ককে তাই নতুন বয়ানে ব্যক্ত করা হচ্ছে। আধুনিক নারীশক্তি বা লিঙ্গতত্ত্বের যে স্পষ্ট প্রয়োগ হচ্ছে তা মোটেই নয়, কিন্তু তার ছাপ পড়েছে লেখকের বিশ্লেষণে। বিশ্বজিৎ বলেননি, কিন্তু এই নন্দিনীকে আমরা শাহিন বাগে দেখেছি।
মুক্তধারা-র আলোচনাও নিটোল, কিন্তু তাতে অতটা মন ভরল না। তার একটা কারণ, অনেক জরুরি কথা রক্তকরবী ঘিরে আগেই বলা হয়ে গেছে। আর একটা কারণ নিহিত বইটির শিরোনামে, যেখানে বিপ্লবের পাশাপাশি আছে ‘শাসকের মনবদল’। সেটা কি বিপ্লবের বিকল্প, না প্রতিশব্দ? ‘অথবা’ শব্দটা কী ভাবে নেব? এই আলোচনাটাও রক্তকরবী-র প্রসঙ্গে আরও মনোগ্রাহী। হিংসাত্মক বিপ্লবের প্রবক্তা রবীন্দ্রনাথ ছিলেন না, বিশ্বজিৎও নন, আমাদেরও হয়ে কাজ নেই। তার বদলে কবি উভয় নাটকেই দেখাচ্ছেন যে, স্বৈরাচারী শাসকের মনে যথার্থ পরিবর্তন আসছে, ফলে সে নিজেকে এবং রাজ্যকে বদ্ধ আত্মধ্বংসী ভোগের কারাগার ভেঙে মুক্ত পথে এনে ফেলছে। চেতনার এই রূপান্তর এ বার চলতেই থাকবে: রক্তকরবী ‘বিপ্লবের পথে শেষ হয়েছে, বিপ্লবের ঘরে শেষ হয়নি।’ চিত্তশুদ্ধির এই বিপ্লব অস্থাবর, নিরালম্ব— বিশ্বজিতের একটা প্রিয় শব্দে, ‘অনাগারিক’।
মার্ক্সীয় চিরস্থায়ী বিপ্লবের এটা এক অভিনব অহিংস অবতার বটে। এ যোগটাও বিশ্বজিৎ উহ্য রেখেছেন, কিন্তু বার বার ফিরে এসেছেন এই মনবদলের বিপ্লবে। তাঁর আলোচনার পটভূমিকা যথেষ্ট সমকালীন। একটা বেয়াড়া প্রশ্ন তাই উঠতে বাধ্য: বিশ্ব জুড়ে আজ যে স্বৈরাচারী শাসকের সমারোহ, তাঁদের এমন আত্মশুদ্ধি কি স্বপ্নেও সম্ভব? নাটকে যা-ই ঘটুক, বাস্তব দৃষ্টিতে কি বিশ্বজিৎ ব্যাপারটাকে একটু সরল মনে দেখছেন?
অনির্বাণ এর যে উত্তর দিয়েছেন, আমিও তাই দেব— একটু ভিন্ন ভাবে। আমরা বলি যে, আমরা গণতন্ত্রে বাস করি। অতএব রাজার চিত্তশুদ্ধি যেমন অনিশ্চিত, তেমন অপ্রাসঙ্গিক। শাসনের সংস্কারের মূলে চাই সমাজের সংস্কার, ব্যক্তি মানুষের মানসিক পুনর্জন্ম। আজকের সমাজ বেজায় অ-সামাজিক, সবাই বড় একলা। একলাই আমাদের চলতে হবে, একলাই বদলাতে হবে। সহায় বলতে পাব রবীন্দ্রনাথের গানের বাণী, তার অনুপ্রেরণায় গাঁধীর পথ চলার দৃষ্টান্ত। তাতে মন ভরলেও বাস্তব সুরক্ষা বা সাফল্য খুব একটা হবে না। কিন্তু যেতে যেতে দেখব, আমাদের মতো অনেক ‘অনাগারিক’ বেরিয়ে পড়েছেন— প্রত্যেকেই একা, কিন্তু সকলে মিলে এক মস্ত সমষ্টি, মস্ত শক্তি।
এমন নানা চিন্তার খোরাক আছে বলে ঠিক এই মুহূর্তে বইটার একটা বিশেষ গুরুত্ব আছে। এর পরিসর বড়ই ছোট— আশা করব, কেবল বিশ্বজিৎ নন, রবীন্দ্রানুরাগী সমাজ এ সব নিয়ে আরও আলোচনা করবেন। আর আশা করব, এমন সদ্গ্রন্থের মুদ্রণ ও অঙ্গসৌষ্ঠব আর একটু আকর্ষণীয় হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy