উদ্বাস্তু: স্বদেশ অতীত, ট্রেনে পাড়ি পূর্ববঙ্গের শত শত মানুষের। ১৯৪৭
“এসো দেখে যাও কুটি কুটি সংসার/ স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ছড়ানো বে-আব্রু সংসারে/ স্বামী নেই, গেল কোথায় তলিয়ে/ ভেসে এসে আজ ঠেকেছে কোথায় ও-যে/ ছেঁড়া কানিটুকু কোমরজড়ানো আদুরি, ঘরের বউ/ আমার বাংলা।” লিখেছিলেন কবি মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়। ১৯৪৭-এর দিকে ফিরে তাকালে দেখি, রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের শেষে, দু’শো বছর শাসনের পরে ব্রিটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশ ছেড়ে চলে গেল। এই প্রস্থানের আগে উপনিবেশকারীরা বালিতে একটি রেখা এঁকেছিলেন। যা দু’টি ভাগে ভাগ হয়ে দু’টি নতুন দেশ তৈরি করেছিল: হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারত এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তান। প্রায় দেড় কোটি মানুষ এর ফলে রাতারাতি গৃহহীন ও বাস্তুচ্যুত হতে বাধ্য হন। নিজের দেশ নামে যাকে জেনে এসেছেন বংশপরম্পরায়, প্রাণের তাগিদে সেই দেশ ছেড়ে নতুন জন্ম নেওয়া অন্য দেশে চলে যেতে বাধ্য হন। ইতিহাসের বৃহত্তম মানব অভিবাসন ছিল এটাই। উদ্বাস্তু হয়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশে আশ্রয় নেওয়া মানুষের কাছে দেশভাগ ছিল ট্র্যাজিক অভিজ্ঞতা। নারী ও শিশুদের উপরে নেমে এসেছিল চূড়ান্ত দমনপীড়ন। নিজের জন্মভূমি, মাটি, প্রিয়জন ছেড়ে আসার যন্ত্রণা তো ছিলই, দেশভাগের শিকার বহু নারী হয়েছিলেন ধর্ষিতা, বর্জিতা, কিংবা নিপীড়কের বাধ্যবাধকতায় নতুন ঘর গড়ার কাজে নিযুক্তা। আজও সেই লুকোনো ক্ষত বহন করে চলেছেন অগণিত মানুষ।
জন্মভূমি ছেড়ে আসার আঘাতে এই রক্তক্ষরণ, নির্মম সময়ের দাগ যেমন দেশ, সমাজ, অর্থনীতিতে পড়েছে, তেমনই সাহিত্যেও গভীর প্রভাব ফেলেছে। গল্প, উপন্যাস এবং কবিতা— সব ক্ষেত্রেই। কৃষন চন্দর, সাদাত হোসেন মান্টো, খাজা আহমেদ আব্বাস, ভীষ্ম সাহনী, অমৃতা প্রীতম, খুশবন্ত সিংহরা যে ভাবে উর্দু ও হিন্দিতে এই বিপর্যয়ের চিত্র এঁকেছেন, তা বাংলা সাহিত্যেও বার বার ঘুরেফিরে এসেছে। লেখা হয়েছে কালজয়ী কিছু ছোটগল্প। এ-পার বাংলায় লেখার সংখ্যাটা বেশি। কারণ যে হিন্দুরা ও-পার থেকে এ-পারে এলেন তাঁদের যন্ত্রণা, দুর্গতি, অনাহার এবং সামাজিক অস্তিত্বের বিপন্নতা সেই মুহূর্তে প্রতিভাত হয়েছিল। কিন্তু যাঁরা পূর্ব পাকিস্তানে (অধুনা বাংলাদেশে) রয়ে গেলেন, তাঁরা সেই মুহূর্তে আলাদা রাষ্ট্রের অধিকারী হলেও আসলে যে বাংলা ভাষা ছেড়ে উর্দুভাষী পাকিস্তানের অধীন হলেন, এটা বুঝতে তাঁদের সময় লেগেছিল। ফলে তাঁদের লেখায় দেশভাগের কথা এল আরও কিছু কাল বাদে।
বাঙালি পাঠক ইতিমধ্যে পড়ে ফেলেছেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আচার্য কৃপালনি কলোনী’, সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘গণ নায়ক’, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনি’, অতীন বন্দোপাধ্যায়ের ‘বাতাসী’, সাধন চট্টোপাধ্যায়ের ‘লেডির হাতে লাল গোলাপ’ প্রভৃতি। কিন্তু সেখানে নিম্নবর্গের বিষয়ে লেখা চোখে পড়ে না তেমন। হয়তো ইচ্ছাকৃত ভাবেই তাঁদের আড়াল রাখার প্রচেষ্টা করেছিলেন দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা। তবু ফিনিক্স পাখির মতোই আগুন থেকে জন্মাল কিছু গল্প, যা সংখ্যায় কম, কিন্তু ভাবে ভাষায় ব্যাপ্ত। তেমনই কিছু লেখার কারিগর জীবন সরকার, যতীন বালা, কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর প্রমুখ। ১৯৪৭-এর পরিপ্রেক্ষিতে লেখা হলেও তা যে আজও দুই দেশের মানুষের মধ্যে বড় বেদনার মতো বেজে চলে, তারই ফসল দ্য ব্লিডিং বর্ডার: স্টোরিজ় অব বেঙ্গল পার্টিশন। এখানে ২৪টি গল্প ইংরেজি অনুবাদে স্থান পেয়েছে। প্রবীণদের পাশাপাশি রয়েছে নতুনদেরও লেখা— অহনা বিশ্বাস, সোহরাব হোসেনের গল্প অনূদিত হয়েছে।
ভারত জুড়ে ভারতের স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর উদ্যাপিত হচ্ছে। কিন্তু এই মহোৎসবের আড়ালে আমরা কি ভুলে যেতে বসেছি, এটা দেশভাগেরও পঁচাত্তর বছর? সেই হিসাবে এই গ্রন্থ ইতিহাসের দলিল। প্রশ্ন জাগতে পারে, যে গল্পগুলো বাংলায় বহুপঠিত, সেগুলোর ইংরেজি অনুবাদ কেন? এর একটাই উত্তর: অনুবাদ ছাড়া সাহিত্য বিশ্বজনীন হতে পারে না। তাই সে দিক দিয়ে বিচার করলে এই বইটির আবশ্যকতা অনস্বীকার্য। তবে অনুবাদ ও সম্পাদনা ভাল হওয়া সত্ত্বেও একটা প্রশ্ন থেকে গেল— মূল বাংলা গল্পগুলোর নাম দিলে পাঠক প্রয়োজনে উৎস গল্পটিও পড়ে ফেলতে পারতেন সহজেই। কারণ অনুবাদের ফলে অনেক সময় নাম বদলে যায়, চেনা গল্পও তখন অচেনা লাগে। তবু জয়জিৎ ঘোষ ও মীর আহমেদ আলির সম্পাদনায় এ গ্রন্থ বিশ্বপাঠকের দরবারে পৌঁছক, এটাই কামনা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy