আত্মারামের নতুন খাঁচা
তৃষ্ণা বসাক
৩০০.০০
ধানসিড়ি
আঠারো বছর ধরে লেখা হয়েছে সঙ্কলনটির নানা গল্প। মূলত কিশোরদের জন্য। শেষে, লেখাগুলি সাজাতে গিয়ে লেখক ও প্রকাশকের মনে হয়েছে, সব বয়সের পাঠকদের জন্য লেখাগুলি খুলে দেওয়া যাক। ঠিক সিদ্ধান্ত। বিজ্ঞানচেতনা, প্রখর সৃষ্টিশীলতা, স্বপ্ন দেখার সাধ আর দারুণ রসবোধ— এই সব মিলেমিশে আত্মারামের নতুন খাঁচা বইটিকে পরিণত করেছে এক দুর্নিবার মেধা সম্পদে। তার সঙ্গে কোথাও হয়তো মিশে গিয়েছে মন কেমনের, প্রিয়জনের থেকে আলাদা হওয়ার কয়েক ফোঁটা চোখের জল। বীণাবাদিনীর শতদলদলে তা টলমল করে উঠেছে। আলভিন টফলারের ফিউচার শক পড়ে তৃষ্ণার মনে জেগেছিল ‘টেকনোলজির ফিউচার ফোরকাস্ট’ জানার ইচ্ছে। কিন্তু তাঁর কল্পনাশক্তি বিজ্ঞানের যে ভবিষ্যৎ কল্পনা করেছে, তার উপাদানগুলি একেবারেই মৌলিক। নিজস্বতায় টইটম্বুর।
বিশ্ব কল্পবিজ্ঞান সাহিত্য বা বাংলায় লেখা কল্পবিজ্ঞানের সঙ্গে এ বইয়ের পরিকল্পনায় কোনও মিল নেই। একাধিক নতুন ভাবনা গল্পগুলির কেন্দ্রে। মানুষের অতি ব্যবহারে, স্বেচ্ছাচারী দূষণে বাসের অযোগ্য হয়ে উঠেছে পৃথিবী। এই সঙ্কটজনক অবস্থার কয়েকশো বছরের পর মানুষ নতুন ঠিকানা খুঁজে নিয়েছে মহাকাশে। সেখানে নতুন প্রযুক্তি চালায় তাদের জীবন। সৌরমণ্ডলের অন্য গ্রহে তাদের অনায়াস যাতায়াত।
বিজ্ঞান উদাসীন ঘনশ্যাম বাবু, তাঁর স্ত্রী সিলিকণ্ডিয়া, ছেলে-মেয়ে, বন্ধু বিজ্ঞানী নীলমণিকে নিয়ে গড়ে উঠেছে এক বিকল্প পৃথিবীর নকশা। এদের নিয়ে আছে বেশ কয়েকটি গল্প। নতুন পৃথিবীর সব বিকল্প নিয়ম। বড়লোকদের ঘরে বাচ্চা হলে ছুটে আসে বহুজাতিক সংস্থার লোকজন। যে হেতু আজীবনের স্পনসর তারা, নামকরণের অধিকারও তাদের। মানুষের নাম এখন পোলো-টু, ল্যাম্বডা, লেপসি কি ম্যাক্সো। ২১৭৫ সালেও ব্যতিক্রমী নাম নিয়ে বিরাজমান নীলমণি মল্লিক আর ঘনশ্যাম লাহিড়ী। নীলমণির সংসার নেই। তিনি নিজের যন্ত্রপাতি আর ঘরদোরের নামকরণ করেন। রোবটের নাম খোক্কট, ল্যাবরেটরি হল খুটখাটাগার, চিত্তারকা হল চিত হয়ে শুয়ে তারা দেখার ঘর। ন্যানো টেকনোলজি আর ফ্লেক্সোমোল্ডিং মিশিয়ে তৈরি বাড়িতে টেবিল ক্লথ হল সেন্ট্রাল প্রসেসর। অতিথিদের পছন্দ, চরিত্র সব এর মাধ্যমে জেনে যায় বাড়ি। আকাশপথে যাতায়াত করতে হয় উড়ুক্কু গাড়িতে। তারও সময় বাঁধা। এখানে আছে, পরা যায় এমন বাড়ি। এমন পোশাক, যাতে আছে চলমান রান্নাঘর, শৌচাগার, আবহাওয়া নিয়ন্ত্রক, নিরাপত্তা বর্ম। মহাকাশের ঠিকানাও তেমন। গণেশ থুড়ি গ্লিসে ৫৮১ সি। এক্সো প্লানেট ২০.৫। লিব্রা নক্ষত্র পুঞ্জ। তবু মহাকাশের নতুন ঠিকানাতেও মানুষের মন ছুটে যায় অতীতের পৃথিবীতে। টাইম মেশিন বানানো নিষেধ, তবু বিজ্ঞানী নীলমণি অতীতে যাওয়ার যন্ত্র বানাতে থাকেন। অতি ঠাকুমার ডায়েরি পড়ে ঘনশ্যাম চলে যান ১৯১২ সালের কলকাতায়। সবুজ গ্রহ পৃথিবী থেকে রোহিণী নক্ষত্রে চলে আসা রোহিনীশ সবুজ গ্রহের মানুষের আঁকা ছবি আর ভাষার কথা ভাবে। অনেক ভাষার মধ্যে লড়াইয়ে এক দিন পৃথিবীর শান্তি নষ্ট হয়েছিল। অন্য দিকে, পৃথিবীর পুরনো সামাজিকতার জায়গায় চলে আসে নতুন নিয়ম। অত্যধিক নেট আসক্তিতে পৃথিবীর মানুষ বিষাদে ভুগত, তাই নতুন সভ্যতা জোর দেয় প্রত্যক্ষ সংযোগের উপর। পৃথিবীতে বৃদ্ধাশ্রমের মতো নিষ্ঠুর প্রথা ছিল। এখন নতুন নাগরিকদের জায়গা দিতে বয়স্করা চলে যান পারাবারে। যাঁদের সামাজিক অবদান আছে, তাঁরাই পাবেন এক্সটেনশন।
বইটির স্বাদ নিছক কল্পবিজ্ঞান সঙ্কলনের চেয়ে অন্য রকম, কারণ এর চরিত্র রাজনৈতিক। ভূমিকায় তৃষ্ণা লিখেছেন, “আসলে কল্পবিজ্ঞান মানেই তো নক্ষত্র যুদ্ধ নয়, বরঞ্চ তা এক চমৎকার ঢাল, যার আড়ালে থেকে সমকালের সব অসংগতি নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায় নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে।” রাজনৈতিকতার ধার আরও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে রসবোধে। রস ও রাজনীতির সমন্বয়ে বইটি হয়ে উঠেছে এক ক্ষুরধার নতুন বিশ্ব অভিযান।
“পুরুষ অধিকার বিল পাশ হয়েছে প্রায় তিন দশক হতে চলল, পুরুষদের অবস্থা যে তিমিরে সে তিমিরে। খাওদাও, নিবিড় গ্রহজালে খোশগল্প কর— দুপুরে বাড়িতে বন্ধুদের ডেকে হুলো পার্টি দাও, কিন্তু সবেতেই ঘরেলু ইমেজ ধরে রাখতে হবে।” ঘনশ্যাম চাকরি করতে চান, বাড়ি তাঁর কাছে জেলখানা। দশ ঘণ্টার স্লটে চাকরি পেলেন, কোনও কাজ নেই অফিসে। তত্ত্বাবধায়ক জঙ্গিদা বলেন, “ট্রেনিং পিরিয়ডে আমরা চেষ্টা করি ইতিহাসের প্রেক্ষিতটা ঢুকিয়ে দিতে। তিন চারশো বছর আগে কেবল বসে থেকে মাইনে নিত সবাই। শেষে অফিসেও আসতে হত না। মাস গেলে চেক পৌঁছে যেত বাড়িতে। কর্মসংস্কৃতির বিবর্তনের ইতিহাসটা বুঝতে হবে না?”
অন্তরিক্ষে বাবল গ্রামের বাড়িতে বসে কিরণশশী দেখছেন মাথায় লাগানো এক যন্ত্রিকার জন্য মেঘ দেখলেও তাঁর মনখারাপ হয় না। প্রাচীন পুঁথিপত্রে মন খারাপের কথা আছে। “স্মৃতি মেদুর ডট কম বলে একটি ওয়েবসাইট খুলে দেখেছে, কতকগুলো লোক পুরোনো সময়, পুরোনো মানুষ নিয়ে কী পরিমাণ হা হুতাশ করছে।” মহাকাশে বাড়ছে জমির দাম। চাঁদ হয়ে উঠেছে সংস্কৃতির প্যারিস। বাবল গ্রামে আসার পরই কিরণশশী দেখলেন, দেওয়াল দেখলেই তাঁর হাত নিশপিশ করে। কিছু লিখতে ইচ্ছে করে। তাঁর এক জন পূর্বপুরুষ ছিলেন বঙ্গীয় ভঙ্গীয় রাজনৈতিক দলের সক্রিয় সদস্য। দেওয়াল দেখলে এক মনুষ্যেতর চতুষ্পদের যেমন বিশেষ ইচ্ছে হয়, তেমনই উক্ত বংশজদের লেখার বাসনা জেগে ওঠে। সাড়ে চারশো বছরের পুরনো এক বিজ্ঞানমনস্ক ভূত কিরণশশীর আঁকা ইলিশের ছবি দিয়ে ভার্চুয়াল ভোজ সারে। ফেরত দিয়ে যায় কাগজ। কাগজ কোথাও পাওয়া যায় না, কেবল কিরণশশীর মতো কয়েক জনের ব্যক্তিগত সংগ্রহ ছাড়া।
এ গল্পের শেষে এসে হাজির হয় এক জেনারেশন নেক্সট ভূত বা ঘোস্টয়েড। “জাস্ট তিন ন্যানোসেক আগে আমাকে তৈরী করা হয়েছে, এখনও রেজিস্ট্রেশন পাইনি, এত পুওর ওয়ার্ক কালচার তোমাদের, অথচ সব জায়গায় লেখা দেখলুম ‘করো, এক্ষুনি করো’, এমনকি টয়লেটেও।— আমাকে তোমরা ভূনেক্সট বলে ডাকতে পারো, শর্টে ভূনি বা ভূনো, অ্যাজ ইউ উইশ।” এমন সব সূক্ষ্ম রসিকতায় মুছে যায় মানুষ-ভূত, অতীত-বর্তমানের বিভেদ রেখা। হ্যাঁ! এমন সব মডার্ন ভূতেরা আছে ফেসবুকেও, ওখানে তো ‘লিভিং’, ‘নন লিভিং’ এমন কোনও স্টেটাস দিতে হয় না। শেষপর্যন্ত তৃষ্ণার গভীর বিশ্বাস ছোটদের উপর। রোহিনীশ, পাখি, ছাতিম, ঘনশ্যামের দুই সন্তান স্যাম আর জান— সবাই পৃথিবীর প্রায় অবলুপ্ত মূল্যবোধটুকু বড়দের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। তাদেরই জন্য লেখা বইটি। বইটি লেখা হতে হতে ছোটরা প্রাপ্তমনস্ক হয়ে উঠেছে। নবীন সংস্থা ‘ধানসিড়ি’ বইটি প্রকাশ করে গতানুগতিকতার বাইরে যাওয়ার সাহস দেখিয়েছে। প্রচ্ছদ ও নির্মাণ সুন্দর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy