মাইলফলক: শিল্পীর কল্পনায় ফরাসি বিপ্লব, সাম্যের পথে অভিযাত্রা
আপনার বইগুলো ইন্টারেস্টিং, কিন্তু আর একটু ছোট করা যায় না কি, যাতে আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবদেরও পড়াতে পারি?— টমাস পিকেটিকে এ প্রশ্ন অনেক বার শুনতে হয়েছে। স্বাভাবিক। তাঁর নিজেরই কথায়, “গত দু’দশকে অসাম্য নিয়ে আমি তিনটে বই লিখেছি, বইগুলো (এক-একটা!) হাজারখানেক পৃষ্ঠার।” পিকেটির নতুন বই, আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব ইকোয়ালিটি, সাকুল্যে পৌনে তিনশো পৃষ্ঠায় সমাপ্ত। লেখকের সকৌতুক মন্তব্য— খানিকটা যেন চেনাজানা লোকেদের ওই প্রশ্নের জবাব দিতেই এ বইটা লেখা হল!
শিরোনাম অনুসারে এই বইটি অসাম্যের নয়, সাম্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। শুরুতেই লেখক বলেছেন, দুনিয়া জুড়ে আধুনিক ইতিহাসের গতি সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সাম্যের দিকে। সম্পত্তি, আয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গণতান্ত্রিক শাসনে নাগরিকের অধিকার— বিভিন্ন ক্ষেত্রেই দু’শো-আড়াইশো বছর আগেকার তুলনায় দুনিয়ায় অসাম্যের বহর এখন কম। এই পরিবর্তনের গতি মসৃণ হয়নি, অসাম্যের ছবিগুলো অনেক পতন-উত্থানের সাক্ষী; দেশে দেশে পরিবর্তনের মাত্রায় ফারাকও বিস্তর। কিন্তু সব মিলিয়ে যে বড় ছবিটা উঠে আসে, তাকে ‘সাম্যের ইতিহাস’ বলার কিছু কারণ আছে।
আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব ইকোয়ালিটি
টমাস পিকেটি
৬৯৯.০০
হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস
কিন্তু সন্তুষ্টির কিছুমাত্র কারণ নেই। পিকেটি নিজেও সে কথা বারংবার খেয়াল করিয়ে দিয়েছেন। প্রথমত, অসাম্য এখনও বিপুল। যেমন, সপ্তম অধ্যায়ে তাঁর পরিবেশিত একটি রেখচিত্র জানাচ্ছে, গত শতকের গোড়ায় ইউরোপে সবচেয়ে ধনী ১০% লোকের হাতে ছিল মোট সম্পত্তির প্রায় ৯০%। ২০২০ সালে অনুপাতটা দাঁড়িয়েছে ৫০%-এর কিছু বেশি। দ্বিতীয়ত, গত চার দশকে অসাম্য আবার বেশ কিছুটা বেড়েছে, ইউরোপে তুলনায় কম, কিন্তু আমেরিকায় রীতিমতো দ্রুত— ১৯৮০-র দশকের মাঝামাঝি ১০% ধনীর হাতে ছিল প্রায় ৬০% সম্পত্তি, এখন সেটা দাঁড়িয়েছে ৭০%। তৃতীয়ত, সাম্যের অভিমুখে যেটুকু অগ্রগতি, তার সুফল পেয়েছেন প্রধানত মধ্যবিত্ত বর্গের মানুষ, নীচের তলার দুর্দশা প্রায় নিরবচ্ছিন্ন। সম্পত্তির মালিকানা দিয়ে যদি দেখি, ইউরোপে দরিদ্র ৫০% নাগরিকের হাতে আছে মোট সম্পত্তির ৫ থেকে ৬%, আমেরিকায় ২%। মানে, অর্ধেক লোক কার্যত নিঃস্ব। অন্য নানা মাপকাঠি ব্যবহার করলেও দেখা যাবে, নীচের মহলে ধারাবাহিক এবং সার্বিক সুযোগবঞ্চনার অন্ধকার আজও প্রগাঢ়।
তা হলে সাম্যের ইতিহাস কেন? পিকেটি বলতে চান, দুনিয়া সাম্যের দিকে যতটুকু এগিয়েছে, সেই অগ্রগতির কারণগুলোকে বোঝা জরুরি, কেননা তা হলে আমরা আরও অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করতে পারব। অর্থনীতিবিদরা সচরাচর এই অগ্রগতির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ইনক্লুসিভ গ্রোথ বা সর্বজনীন উন্নয়ন, গণতন্ত্র, বিকেন্দ্রীকরণ ইত্যাদির কথা পাড়বেন। পিকেটিও সে সব কথা বলেছেন, বিশেষত সাধারণ নাগরিকের সক্রিয় যোগদানের ভিত্তিতে সচল গণতন্ত্র তাঁর মতে অসাম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অপরিহার্য প্রকরণ। কিন্তু তিনি এখানে থামেননি। একেবারে ভূমিকার প্রথম পর্বেই তাঁর সুস্পষ্ট বক্তব্য: আঠারো শতকের শেষ থেকে সাম্যের পথে যে দীর্ঘমেয়াদি প্রবণতা আমরা দেখেছি, তার পিছনে আছে ‘অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংঘর্ষ এবং বিদ্রোহের বিভিন্ন ঘটনা’, যার ফলে ক্ষমতার বিন্যাসে পরিবর্তন ঘটেছে, ক্ষমতাবান শ্রেণি যে কায়েমি ব্যবস্থাকে ধরে রাখতে তৎপর, তাকে ভেঙে দিয়ে নতুন ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। আঠারো শতকের শেষে ফরাসি বিপ্লবকে এই পরিপ্রেক্ষিতেই ‘সাম্যের ইতিহাস’-এর প্রাথমিক মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ফরাসি লেখক। এবং সাফ সাফ বলেছেন যে, সেই বিপ্লব ও তার আগে কৃষকদের একের পর এক বিদ্রোহ না ঘটলে ফরাসি অভিজাততন্ত্রের দুর্গ ভাঙত না। পরবর্তী দুই শতাব্দীতে বারংবার নানা ভাবে নানান চেহারায় এই কার্যকারণসূত্র পুনরাবৃত্ত হয়েছে: উনিশ শতকে ফ্রান্স ও জার্মানিতে একের পর এক বিদ্রোহ কিংবা আমেরিকায় ‘গৃহযুদ্ধ’ থেকে শুরু করে গত শতকের ইউরোপে সংগঠিত শ্রমিকদের আন্দোলন, বামপন্থী রাজনীতির প্রবল অভিযান এবং স্বাধীন ও জনমুখী সংবাদমাধ্যমের নাছোড় প্রতিস্পর্ধা— বহু দিক থেকে চাপ না থাকলে শোষণ, বঞ্চনা ও অসাম্যের মাত্রা যেটুকু কমেছে সেটুকুও কমানো যেত না। উল্টো দিকে, গত তিন-চার দশকে আমেরিকা-সহ বহু দেশেই শ্রমিক সংগঠন, বামপন্থী দল ও সামাজিক ন্যায়ের পক্ষে সক্রিয় অন্য শক্তিগুলি যত কমজোরি হয়েছে, অসাম্যের মাত্রা ততই নতুন করে তীব্রতর হয়েছে। অর্থাৎ, ইতিহাসের গতিপথ নিজে নিজে সাম্যের অভিমুখে ঘোরে না, তাকে ঘোরাতে হয়। সেখানেই প্রতিস্পর্ধী সংগ্রামের গুরুত্ব।
এই সংগ্রামে সংগঠিত আন্দোলন এবং প্রয়োজনে বলপ্রয়োগের ভূমিকা কতখানি, সেই প্রশ্ন অবশ্য পিকেটি এড়িয়ে যান। তাঁর ইতিহাস-পাঠ যে ‘সংঘর্ষ ও বিদ্রোহ’কে স্বীকৃতি দেয়, তাঁর মধ্যপন্থী রাজনীতি তাকে মেনে নিতে পারে না। তা নিয়ে অনুযোগ করে লাভ নেই, বরং লক্ষ করা দরকার, মধ্যপন্থায় থেকেও তিনি একটি দরকারি কাজ করছেন। প্রচলিত সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার চালক আর পৃষ্ঠপোষকরা বিপুল এবং ক্রমবর্ধমান অসাম্যকে ‘এটাই স্বাভাবিক’ বা ‘এর কোনও বিকল্প নেই’ বলে যে দাবি জানিয়ে থাকেন, পিকেটি সেই দাবিকে নস্যাৎ করে এই ব্যবস্থার অন্যায়গুলোকে অন্যায় হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং তার বিকল্প ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষে জোরদার সওয়াল করেন। কায়েমি মতাদর্শের প্রতিস্পর্ধী ধারণা গড়ে তোলাটাই তাঁর কাছে প্রতিস্পর্ধী সংগ্রামের বড় কাজ।
যেমন, পিকেটি খেয়াল করিয়ে দেন, ধনতন্ত্র মানেই আজকের নিয়োলিবারাল অর্থনীতি নয়, ধনতন্ত্র বিভিন্ন সময়ে এবং বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রূপ নিয়েছে, এখনও তার চেহারা পুরোপুরি এক ছাঁচে ঢালা হয়ে যায়নি। একটি দৃষ্টান্ত— জার্মানি। সে দেশের শিল্পবাণিজ্য সংস্থার পরিচালনায় শ্রমিক-কর্মীদের অনেকখানি ভূমিকা আছে। ‘কো-ম্যানেজমেন্ট’ নামে পরিচিত সেই রীতির পিছনে কাজ করে পুঁজি সম্পর্কে দেশের সংবিধানে নিহিত একটি মৌলিক ধারণা। সেই ধারণা অনুসারে, সম্পত্তির অধিকার তখনই সার্থক, যখন সেই সম্পত্তি সামাজিক কল্যাণের কাজে ব্যবহার করা হয়। নিয়োলিবারাল পুঁজি এবং তার নির্দেশিত অর্থশাস্ত্র এই ধারণা একেবারেই মানবে না, তার বিধান হল: সম্পত্তির মালিকানা সার্বভৌম, সর্বাধিক মুনাফার সন্ধানই পুঁজির একমাত্র ধর্ম, সমাজকল্যাণ সেই ধর্মে অপ্রাসঙ্গিক। স্পষ্টতই, এটাই ধনতন্ত্রের এক এবং অদ্বিতীয় আদর্শ নয়, অন্য নৈতিক ভিতও আছে, সেই বিকল্প ভিত্তিভূমিতে দাঁড়িয়ে জোরদার দাবি গড়ে তোলা যায় যে, শিল্পবাণিজ্য তথা অর্থনীতির পরিচালনায় শ্রমিক-কর্মীদেরও অধিকার দিতে হবে, যার নাম কর্মক্ষেত্রে গণতন্ত্র— ডেমোক্র্যাসি অ্যাট ওয়ার্ক।
বিকল্প ধারণার পিছনে কেবল নৈতিকতার জোর নয়, কার্যকারিতার জোরও আছে। জার্মানির পাশাপাশি স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলির দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে পিকেটি মন্তব্য করেছেন, কোম্পানির পরিচালনায় শ্রমিকদের অংশীদার করা হলে পরিচালনার মানও উন্নত হয়— হওয়া স্বাভাবিক— কারণ কাজটা তো তাঁরাই করেন। সাধারণ ভাবেও, তাঁর মতে, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সাম্য প্রসারিত হলে বহু মানুষ নানা ক্ষেত্রে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করার, এবং বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ পান, তার ফলে কর্মদক্ষতা বাড়ে। দক্ষতা ও উন্নতির জন্য বিপুল অসাম্য জরুরি— এমন একটা তত্ত্ব এ কালের কর্পোরেটবান্ধব প্রচারমাধ্যমে বহুলপ্রচলিত হলেও এর পিছনে কোনও সুযুক্তি নেই, বাস্তব প্রমাণও নেই। ঠিক যেমন, শিক্ষা বা স্বাস্থ্যের মতো বনিয়াদি সংসাধনগুলি বাজারদরে কিনতে হবে, তবে সেগুলির প্রসার ঘটবে— এই বিচিত্র ধারণাটি নিয়োলিবারাল দর্শনে যত জোরেই প্রচারিত হোক, বাস্তব দুনিয়ায় সেটি ইতিমধ্যে ‘প্রমাণিত মিথ্যা’।
এই মিথ্যাগুলি বাজারে চলছে, তার কারণ সেগুলিকে চালানো হয়েছে। অর্থনীতিতে নিয়োলিবারাল পুঁজির দাপট যত বেড়েছে, তার ধারণাগত আধিপত্যও ততই জোরদার হয়েছে। তার বিরুদ্ধে লড়াইটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে এই আধিপত্য ভাঙতে হবে। নাগরিকের মনে এই বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে যে— সামাজিক ন্যায়, সুযোগের সাম্য এবং অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের ভিত্তিতে এমন একটা ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়, যেখানে কেবল অসাম্য কমবে না, দক্ষতাও বাড়বে। সমাজ বদলের প্রকল্পে ধারণার লড়াইটা অত্যন্ত জরুরি। সেই লড়াইয়ে পিকেটি বড় সহায় হতে পারেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy