তরুণ মজুমদারের দু’খণ্ডের সিনেমাপাড়া দিয়ে পড়তে পড়তে ব্যোমকেশের অনন্য স্রষ্টা ও আমার অন্যতম সাহিত্যগুরু শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগ মনে পড়ে গেল: সব শাড়ির দৈর্ঘ্য ছ’গজ, কিন্তু দাম কখনও কুড়ি, কখনও কুড়ি হাজার টাকা— অথচ লেখকের বইয়ের দাম পাতা গুণে, গীতাও যা, গীতাঞ্জলিও তা, আমরাও তা, ফলে অনেক সময় বাংলা লেখা হয় যথেষ্ট ফেনানো।
প্রায় ৯০০ পৃষ্ঠার দু’খণ্ড বই, কিন্তু তরুণ মজুমদার সেখানে যে বিশাল জটিল জীবনের নিখুঁত পরিমাপের চেষ্টা করেছেন, তা চলচ্চিত্রের সঙ্গে নিবিড় ভাবে জড়িত বিশেষজ্ঞরাই পারেন, কারণ তাঁরা কম শব্দে বেশি কথা বলতে অভ্যস্ত। সত্যজিৎ, শরদিন্দু, শৈলজানন্দ, প্রেমেন্দ্র মিত্র, তরুণ মজুমদার সবাই এই গুণের বিস্ময়কর অধিকারী।
এক জন গুণগ্রাহী ও বিস্মিত লেখক হিসাবে তরুণ মজুমদারকে আমার বিনীত প্রশ্ন— এত দিন কোথায় ছিলেন? চলচ্চিত্রই আপনাকে অধিকার করে রইল, বিপুল স্বীকৃতি, সাফল্য ও সম্মান দিল, কিন্তু সাহিত্য আপনাকে পেল খেলার মাঠের শেষ ওভারে।
আমি অনেক দিনই তরুণ মজুমদারের চলচ্চিত্রের ভক্ত, এ বার তাঁর লেখা পড়ে বিস্মিত। বাংলা সাহিত্যে অভিনেতা, নাট্যকার, চলচ্চিত্রকার ও চিত্রনাট্য-লেখকরা এত দিন যা দিয়ে এসেছেন, তাতে আপনার নতুন ও বিস্ময়কর সংযোজন। অনেকে ভাগ্যবান, অনেক কম দিয়ে অনেক বেশি পান, কালের কষ্টিপাথরে নাম লিখে যান চিরকালের জন্য, আবার কেউ কেউ তাঁদের সমগ্র জীবনকালে যথেষ্ট পান না। তরুণ মজুমদার সেই দলের— তিনি যথেষ্ট লাজুক, প্রচার-নির্ভর শিল্পের সঙ্গে জীবন কাটিয়েও তিনি প্রচারধর্মী হওয়ার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করলেন না, তাঁর দু’খণ্ডের আত্মকথায় তার যথেষ্ট প্রমাণ রেখে গেলেন।
সিনেমাপাড়া দিয়ে (১ ও ২)
তরুণ মজুমদার
৯৯৯.০০
দে’জ
সিনেমাপাড়া দিয়ে এমনই এক আত্মকথা, যার মধ্যে টাইট ডকুমেন্টারি ছবি যেন নিঃশব্দে ছড়িয়ে রয়েছে। সেই সঙ্গে সমকালের চলচ্চিত্র ইতিহাস— যেখানে রবীন্দ্রনাথ রয়েছেন, নিউ থিয়েটার্স রয়েছে, বীরেন্দ্রনাথ সরকার রয়েছেন, আবার কানন দেবীও রয়েছেন, সুচিত্রা সেনও রয়েছেন, এবং অবশ্যই উত্তমকুমারও রয়েছেন।
তরুণ মজুমদারের লেখায় পরিমিতিবোধের সঙ্গে তাঁর স্বভাবলাজুক চরিত্রটি ফুটে উঠেছে। ভূমিকাতেই তিনি নোটিস দিয়ে দিয়েছেন— ‘এ আমার আত্মজীবনী’ নয়। তা হলে এটি কী? বোধ হয় এক কঠিন, অনিশ্চিত ও প্রায়শই ব্যর্থ নতুন এক শিল্পের বড় হয়ে ওঠার ইতিবৃত্ত। এক জন অসামান্য কৃতী লেখকই এমন ভাবে বলতে পারেন— “নদীর এপারে আমি, আর আমার বানানো ছবির ফ্রেমগুলো সব নদীর ওপারে। মাঝখানে দাঁড়িয়ে আধুনিক টেকনোলজি— দুর্লঙ্ঘ্য একটা ব্যবধান তৈরি করে দিয়ে মিটিমিটি হাসছে।” লেখক তরুণ মজুমদার তাঁর বিস্মিত পাঠকদের জানিয়েছেন, “কলেজের পাট চুকিয়ে যখন ভাবছি এবার কী করব, কোন পথ ধরা যায়, এমন সময় বলা নেই কওয়া নেই মনের মধ্যে একটা পুরনো পোকা কুটুস করে কামড় বসালো। এই পোকাটির নাম যে সিনেমা পোকা তা বুঝতে সময় লাগছে।”
রিভিউ করতে বসে সমস্ত নাটকীয়তা লিক করে দিয়ে হাজার পাতার এক আত্মকথাকে ছিবড়ে করে দেওয়াটা আমার কাজ নয়। আমাদের চলচ্চিত্রশিল্প যে সীমিতবিত্ত মানুষকে কৌতূহলী করলেও তাকে টানতে পারেনি, তার কারণ “ফিল্মলাইনে ঢুকলে ভবিষ্যৎ ভীষণ অনিশ্চিত। খুব কম লোকের বরাতে ভাগ্যদেবীর বর জোটে।”
সিনেমা কি আর্ট? এই প্রশ্নের উত্তরে দুঃসাহসী শিল্পী সত্যজিৎ রায় বলতেন, ‘কমপোজ়িট আর্ট’-এর মধ্যে কথাসাহিত্য আছে, নাটক আছে, সঙ্গীত আছে, ফোটোগ্রাফি আছে— এক কথায় কী না আছে! সবচেয়ে মুশকিল, অতি মাত্রায় সীমিত সময় আছে, কেউ অঢেল সময় দিতে রাজি নয়। এবং সবচেয়ে যা ভয়ঙ্কর, পর্দায় প্রস্ফুটিত হওয়ার নির্ধারিত সময় আছে। যা হওয়ার, তা দু’সপ্তাহেই নির্ধারিত হয়ে যায়; কবি নাট্যকার কথাসাহিত্যিকের মতো বলা যায় না যে, কাল অনন্ত, আজ আমাকে পাঠ না করলেও, সব কিছু শেষ হয়ে যায় না। চলচ্চিত্রে তাই জন্মমুহূর্ত থেকেই প্রাণান্ত হুড়োহুড়ি, প্রাণান্ত ঢাকের বাদ্যি, প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চরিত্রদের। আর, রিভিউয়ারের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা। সব সময় তাঁরা উঁচু দরের নিষ্ঠাবান মানুষ নন। সত্যজিৎ দুঃখ করতেন, বিদেশের রিভিউয়াররা একটা ছবি চার-পাঁচ বার দেখে তবে লিখতে বসেন, এখানে অনেক সময়েই তা হয় না। ফলে ভাল ছবি দর্শকের অভাবে আগেই শূন্য হলঘরে শেষ হয়ে যায়। অর্থাৎ দর্শক-অন্ত সীমিত প্রাণ, যার সঙ্গে তুলনা করা চলে একমাত্র স্টক মার্কেটের স্পেকুলেশন খেলাকে। আরও যা ভয়ঙ্কর, এক দিস্তে কাগজ ও একটি কলম থাকলেই ছবি হয় না, এর জন্যে প্রয়োজন পরের টাকা, পরের প্রেক্ষাগৃহ, পরের অভিনয়, পরের মন্তব্য, এবং আরও অনেক কিছু।
এই সব সমস্যা থেকে বাংলা চলচ্চিত্র কোনও দিন মুক্ত হয়নি। তাই মানুষ এসেছে, আবার যথাসর্বস্ব হারিয়ে চলে গিয়েছে; সামান্য কয়েক জন টিকে গিয়েছেন। আমাদের আনন্দ যে, তরুণ মজুমদার তাঁদেরই এক জন। অথচ তাঁর মধ্যে দাম্ভিকতা নেই, বাজারি মনোবৃত্তি নেই, তিনি যে সৃষ্টিধর্মী চলমান সাহিত্যের সাধক, জীবনসায়াহ্নে তারও অগ্নিপরীক্ষা দিলেন।
নানা বিচিত্র মানব-মানবী এসে পড়েছেন তরুণ মজুমদারের সিনেমা পাড়ায়, গ্রন্থ সমালোচনার নাম করে সেই সব বহুখ্যাত, অর্ধখ্যাত, কখনও বিস্ময়কর নরনারীদের কাহিনি নষ্ট করে দেওয়া সাহিত্য সমালোচকের কাজ নয়— তাঁরা অনেক সময় বই পড়ার আনন্দ ও বিস্ময়টা সূতিকাগারেই নষ্ট করে দেন। সেই কাজ করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমার নেই।
আমার নিবেদন, সার্থক চলচ্চিত্রকার, নানা বিস্ময়কর সফল চলচ্চিত্রের স্বল্পভাষী স্রষ্টা এ বার যা লিখে গেলেন, তা সকলের পড়ার মতো। সহজেই বলা যেতে পারে, সিনেমাপাড়া দিয়ে তিনি দীর্ঘস্থায়ী ক্লাসিক সাহিত্যের অঙ্গনে প্রবেশ করলেন। এমন লেখককেই এক সময় বলা হত ‘অগ্রপথিক’। তাঁকে আমার অভিনন্দন, নানা আশঙ্কায় বিড়ম্বিত এক কঠিন সময়ে আমাদের বাংলা সাহিত্য একটি স্মরণীয় বই পেল, আমরা শুধু অন্যদের বলতে পারি— তরুণ মজুমদার পড়ো।
মনে পড়ছে, বুদ্ধদেব বসু প্রসঙ্গে এক বার বলা হয়েছিল, ছেঁদো কথার পুনরাবৃত্তি বুদ্ধদেব বসুর স্বভাব নয়। সেই একই মন্তব্য অতি সহজে করা যায় বাংলাদেশের বগুড়ার স্কুলে পড়া, কলকাতার স্কটিশ চার্চ ও সেন্ট পলস কলেজের ছাত্র তরুণ মজুমদার সম্বন্ধেও। কোভিড-কণ্টকিত এক কঠিন সময়ে বাঙালি পাঠক পেল এক অভিনব সাহিত্যসৃষ্টি, যা এক কথায়, অতুলনীয়। লেখককে ধন্যবাদ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy