রূপদান: চালচিত্র আঁকছেন কৃষ্ণনগরের শিল্পী রেবা পাল। ছবি: সৈকত মুখোপাধ্যায়, বই থেকে নেওয়া
শিল্প-গবেষক প্রয়াত ভোলানাথ ভট্টাচার্য গত শতাব্দীর ষাটের দশকে বঙ্গ-সংস্কৃতির নানা দিক নিয়ে সরেজমিনে অনুসন্ধান শুরু করেন। বহুমুখী এই অনুসন্ধানের বিভিন্ন পর্বে যে সব ক্ষেত্র তাঁকে বিশেষ ভাবে আকর্ষণ করেছিল, তার মধ্যে বাংলার ঐতিহ্যবাহী একচালা দুর্গাপ্রতিমার মাথার উপরের অর্ধবৃত্তাকার চালচিত্র অন্যতম। এই চালচিত্রের শিল্পীদের খোঁজে তিনি কুমোরটুলির প্রতিমাশিল্পীদের কাছে গিয়ে যে তথ্য সংগ্রহ করেন, নিতান্ত আফসোসের কথা, তার সামান্য অংশই মুদ্রিত আকারে রক্ষিত হয়েছে। ১৯৭২ সালে তারাপদ সাঁতরা সম্পাদিত কৌশিকী পত্রিকায় ভোলানাথবাবু লেখেন, ‘কুমারটুলির লেখা ও চাল’। হ্যাঁ, চালচিত্র শিল্পীদের লব্জে চাল ‘লেখা’ হয়, ‘আঁকা’ নয়। পরে একই পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর আরও একটি লেখা, ‘কুমারটুলির চাল’। এই দু’টি ছোট নিবন্ধে লুকিয়ে আছে বাংলার শিল্প-ইতিহাসের অনেক হারানো সূত্র। আমরা জানতে পারি যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত কুমোরটুলির চালচিত্রের খ্যাতি অটুট ছিল। কাঙ্গালি পাল বা হরিজীবন পালের মতো বাঘা বাঘা শিল্পীরা তখন বাংলা চালের গৌরব এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন যে, ভোলানাথবাবুর সমীক্ষার সময়েও “কুমারটুলির নিজস্ব চাল সনাতন বৈশিষ্ট্য সর্বাংশে হারায়নি।” এই সঙ্গে কুম্ভকার ভাস্কর লক্ষ্মীকান্ত পালের আনুকূল্যে কুমোরটুলির কিছু সনাতন চালচিত্র দেখার সুযোগ পান ভোলানাথবাবু, যার কোনও কোনওটি তখনই শতাধিক বছরের পুরনো; জানতে পারেন তার শৈলীগত বৈচিত্রের কথা, এমনকি শিল্পীদের নামও। দুঃখের বিষয়, এই দু’টি লেখার সঙ্গে কোনও ছবি না থাকায় বাংলার সনাতন চালচিত্রের সেই বৈচিত্রের বিবরণ শুধু নামসর্বস্ব হয়েই রইল, অরূপ থেকে রূপে ধরা দিল না।
আমাদের সৌভাগ্য, ভোলানাথ ভট্টাচার্যের কাজের দু’দশক পর প্রকাশ পেল এই বিষয় নিয়েই সবিস্তার আলোচনা, সুধীর চক্রবর্তীর চালচিত্রের চিত্রলেখা (১৯৯৩)। আশির দশকে সেন্টার ফর স্টাডিজ় ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস-এর গবেষণা-প্রকল্প ‘কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্প ও মৃৎশিল্পী সমাজ’ সুধীরবাবুকে যে স্থানিক অনুসন্ধানে ব্রতী করে, চালচিত্রের ইতিবৃত্ত সংগ্রহের প্রণোদনা এসেছিল সেখান থেকেই। শুধু কলকাতা নয়, বছর পাঁচেক ধরে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে দুর্গাপুজোর সময় আর তার কিছুটা আগে বর্ষাকালে (ঘরবন্দি শিল্পীরা সেই সময়েই ‘লেখা’র কাজ বেশি করতেন) খুঁজে বার করেন বাংলার লোকায়ত ঐতিহ্যের এই লুপ্তপ্রায় ধারার শেষ উল্লেখযোগ্য শিল্পীদের বেশ কয়েক জনকে। তাঁর কথায়, “একেক অঞ্চলের চিত্রকরদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে তাঁদের ভাবনা ও চিত্ররূপায়ণের কৌশল, বাজারের হালচাল, ক্রমক্ষয়মানতার অনিবার্য ব্যাধি, সমঝদারির অভাব, অবহেলা, উপেক্ষা ও অভিমানের নানা বৃত্তান্ত জানা হল।”
চালচিত্র
সুধীর চক্রবর্তী
৬৫০.০০
হরপ্পা
কিন্তু শুধু শিল্পীদের বিবরণ তুলে ধরেই দায়িত্ব শেষ করেননি সুধীরবাবু। অনালোচিত এই শিল্পধারার সার্বিক পরিচয় তুলে ধরতে পৌঁছনোর চেষ্টা করেছেন আরও গভীরে। শুরুটা সেই মৌলিক প্রশ্নে, বাংলায় দুর্গামূর্তি গড়ে পুজোর রেওয়াজ কবে থেকে? লেখক বিতর্কে যাননি, মতামত আর কিংবদন্তি তুলে ধরেছেন। অন্তত সপ্তদশ শতকের সূচনা থেকে যে মাটির প্রতিমা গড়ে দুর্গাপুজোর নজির পাওয়া যাচ্ছে, তাতে বিশেষ সন্দেহ নেই। বিষ্ণুপুরি বা কংসনারায়ণী, দুই রীতিতেই চালচিত্রের ব্যবহার আছে, তাই প্রথম থেকেই চিত্রিত চাল দেবীপ্রতিমার অঙ্গাঙ্গি।
কিন্তু প্রশ্ন আরও আছে। ভারতীয় মূর্তিভাস্কর্য শিল্পের ধারাবাহিকতায় বাংলায় পাল-সেন আমলে আমরা যে দুর্গামূর্তি দেখতে পাই, সে তো একক সিংহবাহিনী মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি, সেখানে দুর্গার পুত্রকন্যারা কোথায়? অথচ চালচিত্র-সহ একচালা যে প্রতিমার রূপকে আমরা প্রাচীন বলে মানি, সেখানে তো লক্ষ্মী সরস্বতী কার্তিক গণেশ সকলেই উপস্থিত। মাটির প্রতিমার সুপ্রাচীন নমুনা আমাদের হাতে নেই, কিন্তু অন্য মাধ্যমে তার পরোক্ষ উপস্থিতি চোখ এড়ায় না। আলিবর্দির সময় প্রতিষ্ঠিত মুর্শিদাবাদের ভট্টবাটির টেরাকোটা মন্দিরে চালচিত্র সমেত সপরিবার দুর্গার রিলিফ ভাস্কর্য এটুকু অন্তত প্রমাণ করে যে, আঠারো শতকের প্রথমার্ধেই এই ধরনের মূর্তি পূজিত হচ্ছিল। সঙ্গে আঁকা হচ্ছিল এক দিকে গণেশ, অন্য দিকে কার্তিকের মাথা ছাড়িয়ে নেমে আসা বিশাল এবং বহুবিচিত্র চালচিত্রও। অর্থাৎ, দ্বাদশ শতক থেকে সতেরো শতকের মধ্যেই বাঙালি শিল্পীদের মননে ঘটে গেছে বিরাট পরিবর্তন, সৃষ্টি হয়েছে বাংলার নিজস্ব রূপকল্পনা, যার সূত্রগুলি পাথুরে প্রমাণের অভাবে আজও আমাদের কাছে অনেকটাই অধরা।
কী ভাবে এটা সম্ভব হল, সে সম্বন্ধে ‘সঠিক বস্তুগত পাকাপাকি’ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে না পারলেও সুধীরবাবু কিন্তু শিল্পীমনের এই ক্রমবিবর্তনের বিচিত্র যাত্রাপথের নানা দিকে আলো ফেলার চেষ্টা করেছেন, উস্কে দিয়েছেন বেশ কিছু নতুন ভাবনা। সে অনুসন্ধানের প্রস্থানবিন্দু মূলত তিনটি, বাংলার ভাস্কর্য, পটচিত্র ও পুঁথিচিত্র। পাথরের মূর্তির শিরশ্চক্র/ প্রভাবলীয়/প্রভামণ্ডলের বিবর্তন উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, “দশম-একাদশ শতাব্দীতে বঙ্গীয় ভাস্কর্যে পশ্চাদপটটির উপরের দিক হয়ে উঠল কৌণিক, অনেকটা পদ্ম-পাপড়ির মতো। সেন যুগের দেবদেবীর মূর্তির পশ্চাদফলকে কিছু কিছু মোটিফ দেখা গেল। যেমন পাদপীঠ থেকে ক্রমশ উপরের দিকে ওই ফলকের গায়ে খোদিত হল গজশার্দূল, মকরমুখ প্রাণী, বীণাধারী, নৃত্যরত গন্ধর্ব, মালাধারী বিদ্যাধর এবং সর্বোপরি কীর্তিমুখ— যার মুখগহ্বর থেকে ঝরে পড়ছে মণিমাণিক্য। সেই সঙ্গে ফুল-লতাপাতার অলংকরণও।” এই বৈচিত্রময় পশ্চাৎপটেই কি রয়ে গিয়েছে পরবর্তী কালের চালচিত্রের সৃষ্টি-ইঙ্গিত?
আরও আছে। দশম থেকে দ্বাদশ শতক পালযুগের পুঁথিচিত্রকলার পরিপূর্ণ বিকাশের যুগ। সমসাময়িক ভাস্কর্যের মতো চিত্রকলায় দেখা যায়, বুদ্ধমূর্তি ও বুদ্ধপুরাণের চিত্রাবলিতেও প্রভামণ্ডলের আকার বদলে গিয়েছে, সংযোজিত হয়েছে অলঙ্করণ, ফুলপাতা, উড়ন্ত মানুষ ও নানা রকমের সহচরমূর্তি। কাজেই বাংলা চালচিত্রের অলঙ্করণে বৌদ্ধ প্রভাবকেও একেবারে অস্বীকার করা যায় না। আবার সতেরো-আঠারো শতকের পটচিত্রের সামান্য কয়েকটি নিদর্শনের মধ্যে দুর্গাপটগুলি সংযোজক সূত্র হিসেবে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
তাই শাস্ত্রোক্ত ধ্যানে নয়, চালচিত্র-সহ সপরিবার দুর্গার এই রূপকল্পনার পিছনে আছে বাংলার ‘অন্তঃশীল শিল্পগত দেশীয় পরম্পরা’। সুধীরবাবুর কথায়, “চালচিত্রের কাঠামোতে যে বাংলা চালারীতির মন্দির স্থাপত্যের একটা আদল আছে এ তো স্পষ্ট। সেই চালার মধ্যে মহিষমর্দিনী মূর্তি গড়ে চালার বাকি অংশ পূরণের জন্য আনা হয়েছে পরিবার-দেবতাদের। এবারে চালচিত্রের অর্ধবৃত্তে আঁকা হল গতিশীল পৌরাণিক ঘটনার পট আর সেই সঙ্গে শিব ও শিবানুচর। তবে পূর্ণ হল বৃত্ত। মূর্তির ভারসাম্য ফুটে উঠল।”
অনুমান করা যায়, এই প্রাথমিক কাঠামোর উপরে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে গড়ে উঠেছে চালচিত্রের নানা প্রকারভেদ, চিত্র-রূপায়ণের অসীম বৈচিত্র। সবই এই বইয়ে আলোচিত। গত শতকের আশি-নব্বইয়ের দশকে যে শিল্পীদের খুঁজে পেয়েছিলেন সুধীরবাবু, লিপিবদ্ধ করেছিলেন তাঁদের কথা, আজ যখন প্রয়াত এই গবেষকের বইটি সম্পূর্ণ রঙিন ছবিতে সমৃদ্ধ হয়ে নতুন করে প্রকাশ পেল, তখন তাঁরা আর কেউই নেই। এই সংস্করণে সংযোজিত ‘হালচিত্র’ অংশে সৈকত মুখোপাধ্যায় এখনও টিকে থাকা ক’জন ঐতিহ্যবাহী শিল্পীর কথা তুলে ধরেছেন, আছে ভবতোষ সুতার আর পার্থ দাশগুপ্ত, দুই আধুনিক শিল্পীর চালচিত্র-ভাবনাও। সোমনাথ ঘোষের শিল্পনির্দেশনায় বইটির অঙ্গসৌষ্ঠব অন্য মাত্রা পেয়েছে। সব মিলিয়ে দুই মলাটে ধরা রইল বাংলার এক লুপ্তপ্রায় শিল্পধারার অনন্য ইতিবৃত্ত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy