প্রাচীন: শহর ও বন্দর। চার্লস ডয়লির আঁকা ১৮১২ সালের কলকাতা। ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স
দেবযানী ভট্টাচার্যের নতুন বই এম্পায়ার অ্যান্ড ইকোলজি ইন দ্য বেঙ্গল ডেল্টা: দ্য মেকিং অব ক্যালকাটা শহর কলকাতার এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ভিন্ন ইতিহাস। এমন নয় যে, শহরের ইতিহাসবিদদের কাছে এই ইতিহাস সম্পূর্ণ অজানা, কিন্তু দেবযানী তাঁর সমগ্র তত্ত্ব ও নথিভিত্তিক আলোচনার মাধ্যমে এই পরিচিত তথ্যগুলিকে নতুন ভাবে দেখানোর প্রয়াস করেছেন। এই বইটির নাম থেকেই আমরা সেই ইঙ্গিত পাই।
কলকাতা শহরের ইতিহাস বাংলার ব-দ্বীপের ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত। দেবযানী প্রথমেই বুঝিয়ে দিতে চাইছেন যে, শহরের ইতিহাস বুঝতে গেলে শহরের মাটির নীচে জলজ জমির ইতিহাসটি থেকেই শুরু করার প্রয়োজন আছে। বইটির প্রধান উদ্দেশ্য কলকাতা শহরের বিস্মৃত জলজ সূত্র আবার নতুন ভাবে জানা এবং বোঝা, কেননা এই জানা বোঝার মধ্যেই লুকিয়ে আছে শহরের জিয়নকাঠি।
সাম্রাজ্য বা ঔপনিবেশিকতার ইতিহাস সর্ব ক্ষেত্রেই জড়িয়ে থাকে ভূসম্পত্তি অধিগ্রহণ, শাসন ও পণ্যীকরণের ইতিহাসের সঙ্গে। কিন্তু অন্যান্য জায়গার ইতিহাসের থেকে কলকাতার এই ইতিহাস খানিকটা ব্যতিক্রমী। কলকাতা শহরের অবস্থান বাংলার ব-দ্বীপের বিশাল ক্ষেত্রে। এখানে নদী-নালা, খালবিল-সহ এক বিস্তৃত স্থলজ জমির সহবাস। জোয়ার ভাটার দৈনন্দিন খেলায় স্থলজ জমি আর জলজ জমির অবিরত রূপান্তর হয়। বাংলার পঞ্জিকায়, ধর্মীয় আচারে, ব্রতকথায়, সাহিত্যে, গানে আমরা তার পরিচয় পাই। কিন্তু এই ইতিহাস আজ প্রায় বিস্মৃত। আধুনিক নগরায়ণের চটকে আর আকাশচুম্বী অট্টালিকায় বাসের প্রলোভনে আমরা সেই জমির নীচের অশান্ত ইতিহাসের থেকে সম্পূর্ণ ভাবে বিচ্যুত।
হুগলি নদী কলকাতা শহরের পশ্চিমে, আর বাকি শহর পুব দিকে, সেখানে নানা খাল-বিল-হ্রদ ইত্যাদির সঙ্গে মিলে যায়। কলকাতা শহর গঙ্গা, মেঘনা, পদ্মা নদীর সম্মিলিত নদীব্যবস্থায় অবস্থিত। প্রতি বছর এই নদীগুলি প্রায় ৪০০০ কোটি কিউবিক ফুট পলিমাটি জমা দেয় বঙ্গোপসাগরে। এই তথ্যের সঙ্গে এটাও মনে রাখা প্রয়োজন যে, কলকাতার অবস্থান বিশ্বের বৃহত্তর ম্যানগ্রোভ অরণ্যের কিনারে। সপ্তদশ শতক থেকে হুগলি নদী ইতিহাসে প্রবেশ করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের এক প্রধান জলপথ হিসেবে। কলকাতার জন্ম হয় এই ইতিহাসের একেবারে প্রথম ভাগে, যখন বহুলপরিমাণে পণ্য যেমন আফিম, রেশম ও সুতির কাপড়, পাট, চা ও চাল যাতায়াত করে ভারতের পুব থেকে পশ্চিমের জলপথে। বাংলার ব-দ্বীপের মধ্য দিয়ে পণ্যবাহী জাহাজের জন্য সবচেয়ে সহজ এবং নিরাপদ জলপথ নির্ধারণ ও বন্দর স্থাপনের প্রচেষ্টা শুরু হয় এই বাণিজ্যিক যুক্তি থেকেই। আর এই প্রচেষ্টা দিয়েই শুরু হয় কলকাতার নগরায়ণের ইতিহাস।
সেই বাণিজ্যিক যুক্তি এবং আধুনিক বিজ্ঞানের প্রয়োগের ফলস্বরূপ সপ্তদশ শতাব্দী থেকে দেখতে পাই, একের পর এক পরিকাঠামোর পরিকল্পনা ও স্থাপন— প্রথমে ব্যক্তিগত পুঁজি ও উদ্যোগে, এবং পরে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের মাধ্যমে। দেবযানী বইটির ভূমিকায় এই মূল অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য খুব স্পষ্ট ভাবে বিশ্লেষণ করেছেন, কিন্তু অর্থনীতির সঙ্গে স্থান পেয়েছে বাংলার ব-দ্বীপের ইকোলজির সুচিন্তিত আলোচনাও।
দেবযানী আমাদের মনে করিয়ে দেন যে, এই বাণিজ্যিক ইতিহাসের প্রচ্ছন্নে আছে এক জল, পলিমাটি আর জোয়ার-ভাটার জটিল ইতিহাস। যারা এই পরিবেশে থেকেছেন, তাঁদের কাছে এই ইতিহাস জল, স্থল, গ্রহ-নক্ষত্রের চরাচর এক আদি-অনন্তের খেলা, যার দৈনন্দিন আচার-বিধি পঞ্জিকার অক্ষরে পরিচিত। কিন্তু এক দল ব্রিটিশ বণিকের কাছে এই নদী-নালা, খাল-বিলের নকশা এক নিরন্তর ধাঁধা। এই ধাঁধাকে আইন, প্রযুক্তি, প্রকৌশল, বাণিজ্যিক পুঁজি, ও আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার দ্বারা অতিক্রম করার অদম্য প্রয়াসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ঔপনিবেশিক কলকাতার নগরায়ণের ইতিবৃত্ত।
বইটি তিন ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগ ‘এনভায়রনমেন্টাল কনসোলিডেশনস’, যেখানে দু’টি প্রবন্ধে আলোচ্য বিষয় কলকাতার নগরায়ণে পলিমাটির ভূমিকা ও তার সঙ্গে মোকাবিলা করার কাহিনির যোগ, এবং বাংলার ব-দ্বীপকে শুকনো করার হাইড্রলিক প্রকৌশলের নানা প্রয়াস। দ্বিতীয় ভাগের দু’টি প্রবন্ধে জলজ জমির স্থলজ রূপান্তর ও তার ভূসম্পত্তি রূপে পর্চাপ্রাপ্তির আইনি প্রক্রিয়ার নানা মারপ্যাঁচ নিয়ে আলোচনা। এই সদ্য-রূপান্তরিত জমির মানচিত্রকরণ, নথিকরণ ও দলিলিকরণের আইনি লড়াই আর আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার নানা কলাকৌশলের জটিলতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা। বইটির শেষ ভাগের আলোচনা নগরায়ণের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ আখ্যান নিয়ে। এই অংশটি ভূসম্পত্তির বাজার ও পণ্যায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করে। এই আলোচনায় সবচেয়ে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হল জমির অনুমানমূলক বা ফাটকা বাজার নিয়ে দেবযানীর বিস্তারিত বিশ্লেষণ। বইয়ের এই শেষ ভাগের আলোচনা কলকাতার নগরায়ণের ইতিহাসের একেবারে শেষ পরিণাম নিয়ে আলোচনা করে। নতুন করে চোখ খুলিয়ে দেয় বর্তমান নগরায়ণের উৎস এবং তার অনির্বার্য পরিণতি বিষয়ে।
দেবযানী বইটি মূলত গঠন করেছেন ঔপনিবেশিক কলকাতার বন্দর ও ঘাটকেন্দ্রিক কিছু পরিকাঠামোগত পরিকল্পনার বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে। যার মধ্যে হুগলি নদীর উপর শুষ্ক ও ভেজা পোতাশ্রয় প্রকল্প, স্ট্র্যান্ড রোড প্রকল্প, ময়দান প্রকল্প, টালি নালা প্রকল্প ইত্যাদি রয়েছে। দেবযানী এই সমস্ত প্রকল্পের মাধ্যমে খুব দক্ষতার সঙ্গে দেখিয়েছেন যে, কী ভাবে এই প্রকল্পগুলির সঙ্গে জড়িয়ে ছিল একাধিক বাণিজ্যিক, ধার্মিক, আইনি ও বৌদ্ধিক সংঘাত। তবে এটি শুধু সংঘাতের বা লড়াইয়ের গল্প নয়— এতে আছে এক নতুন ভাবে জলজ জমি, পরিবেশ, প্রযুক্তি ও আইন ব্যবস্থা রচনা করার ইতিহাস।
দেবযানীর এই বিস্তারিত গবেষণা ও আলোচনার মধ্যে সামগ্রিক ভাবে তা হলে আমরা কী পাই? যদিও এই ইতিহাস প্রধানত ঔপনিবেশিক নথিভিত্তিক, তবু এই বইটি থেকে আমরা কলকাতার নগরায়ণের কেবলমাত্র আইনভিত্তিক বা আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার ইতিহাস পাই না— পাই এক বলিষ্ঠ পরিবেশভিত্তিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, প্রযৌক্তিক ও বৌদ্ধিক ইতিহাসের নিবিড় সম্পর্কের আলোচনা। দেবযানী নানা যুক্তি ও তথ্যের মাধ্যমে বলতে চেষ্টা করেন যে, কলকাতার নগরায়ণের ইতিহাস আসলে বাংলার ব-দ্বীপ ও নদীকেন্দ্রিক পরিবেশ, সমাজ ও সংস্কৃতি ব্যতীত বোঝা যাবে না।
কলকাতার ঔপনিবেশিক নগরায়ণের ইতিহাস নতুন করে ভাবতে হলে দেবযানী দাবি করেন যে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের এই জলা জমির উপর ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াসকে নতুন ভাবে দেখা প্রয়োজন, কেননা কলকাতার নগরায়ণের মূল ধারাবাহিকতা লুকিয়ে আছে এই ব-দ্বীপকেন্দ্রিক বিশিষ্ট ঔপনিবেশিক সম্পত্তির শাসনে।
বর্তমান বিশ্বের জলবায়ু পরির্তনের প্রেক্ষিতে কলকাতার অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ এই বিস্মৃত অতীতের মধ্যেই অবস্থান করে।
এম্পায়ার অ্যান্ড ইকোলজি ইন দ্য বেঙ্গল ডেল্টা: দ্য মেকিং অব ক্যালকাটা
দেবযানী ভট্টাচার্য
৯৯৯.০০
কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy