Advertisement
২১ ডিসেম্বর ২০২৪

নদী আর মানুষের শ্বাস

লক্ষ লক্ষ বছর ধরে এমনই নিয়মে চলে এসেছে নদী ও মানব, প্রকৃতির বিন্যাসকে অস্বীকার না করে। সেই বিন্যাসে মানুষ প্রকৃতির বিরুদ্ধতাও করেছে, কিন্তু আত্মভাবে।

কুমার রাণা
শেষ আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৭:২৭
Share: Save:

নদী ‘তুমি কোথা হইতে আসিতেছ?’ উত্তর, ‘মহাদেবের জটা হইতে।’ প্রকৃতির বিপুলতা ও জটিল বিন্যাস ভারতীয় লোকমনে যে রূপকল্পনা গড়ে তুলেছে, বিজ্ঞানীর নৈর্ব্যক্তিক চিন্তাজগতেও তার প্রতিফলন। শুধু ভাগীরথীর উৎস সন্ধানে-র কাহিনিই নয়, পৃথিবীর তাবৎ নদী নেমে এসেছে কোনও না কোনও জটাজাল থেকে। যেমন নর্মদা, যার জন্ম ‘সাতপুরা, বিন্ধ্য, ও মাইকাল পর্বতশ্রেণি যে মালভূমিতে মিশেছে তারই নীচের উপত্যকায়’, আর ‘মাইকাল পর্বত থেকে বারহয়ে অনেকগুলি সরু ধারা অরণ্যের মধ্যে নর্মদাকে জলদান করে বাঁচিয়েছে।’ নদী মানেই বহু ধারার সমাহার, সেটাই তার সমুদ্রমিলনের নিশ্চয়তা। মানবসমাজের সঙ্গে নদীর গভীর আত্মীয়-সম্বন্ধও বোধ হয় গড়ে উঠেছে বহুত্বের এই সাধারণ উপাদানে— মানবসমাজেরও প্রাণশক্তি তার বিবিধতা।

প্লাবন জল

অনিতা অগ্নিহোত্রী

৩৯৯.০০

দে’জ়

লক্ষ লক্ষ বছর ধরে এমনই নিয়মে চলে এসেছে নদী ও মানব, প্রকৃতির বিন্যাসকে অস্বীকার না করে। সেই বিন্যাসে মানুষ প্রকৃতির বিরুদ্ধতাও করেছে, কিন্তু আত্মভাবে। মানুষ যেমন নিজের দেহকে রাখার জন্য দেহকে পরিমিত ভাবে পীড়ন করে, তেমনই প্রকৃতিকেও পরিমিত ভাবে পীড়ন করে নিজেকে ও প্রকৃতিকে সুস্থ রেখে এসেছে। কিন্তু বাদ সাধল উন্নয়ন। প্রকৃতির উপর মানুষের প্রভুত্ব স্থাপনের নামে কতিপয় লোকের হাতে কেন্দ্রীভূত হল বিপুল ক্ষমতা। এই কতিপয় হল বৃহৎ পুঁজির মালিক, যাদের আরও চাই। প্রকৃতি কৃপণ নয়। সে মানুষকে দিয়েছে বুক উজাড় করে, কিন্তু পুঁজি তাতে সন্তুষ্ট নয়, তার সর্বস্ব চাই। সেই প্রকরণে এল নদীকে বাঁধার প্রকল্প। এমন নয় যে, পুঁজিবাদের বিকাশের আগে মানুষ নদীকে বাঁধেনি। বিশ্বের প্রাচীনতম নদীবাঁধের যে নিদর্শন পাওয়া যায়, তা তৈরি হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ সালে, মেসোপটেমিয়াতে। কিন্তু, আজকের বৃহৎ বাঁধ প্রকল্পের তুলনায় সেই সব বাঁধ ছিল নিতান্ত শিশু।

আমাদের আলোচ্য বইয়ের কাহিনি গড়ে উঠেছে যে বাঁধের বিধ্বংসী নির্মাণ ও তার বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রামকে কেন্দ্র করে, সেই নর্মদা নদীর উপর তৈরি সর্দার সরোবর বাঁধের উচ্চতা ১৩৯ মিটার, দৈর্ঘ্য ২১৪ কিলোমিটার। বিপরীতে মেসোপটেমিয়ার জাওয়া বাঁধের উচ্চতা ছিল পাঁচ মিটারেরও কম, আর দৈর্ঘ্য মাত্র ৮০ ফুট। নদীর ইতিহাস আমাদের জানাচ্ছে, মুক্তির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে যে হাজার হাজার নদী পর্বতকন্দর থেকে বেরিয়ে, পথে জলধারা, মানুষ, অরণ্য, প্রাণিকুল, নানা সঙ্গী জুটিয়ে বয়ে এসেছে লক্ষ বছর ধরে, পুঁজির উদগ্র লোভে এখন তাদের দুই-তৃতীয়াংশের প্রবাহ রুদ্ধ। বাঁধের ভারে, পৃথিবীর গতিতেও এসেছে পরিবর্তন। নদীবাঁধে পৃথিবীর যতটা ভূখণ্ড প্লাবিত হয়েছে তা পশ্চিমবঙ্গের ভূখণ্ডের পাঁচ গুণ, এবং যত মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন, তা আমাদের এই রাজ্যের মোট জনসংখ্যার সামান্য কম (সাড়ে আট কোটি)।

যে নর্মদাকে সর্দার সরোবর এবং আরও কয়েকশো বাঁধ দিয়ে বেঁধে ফেলার গর্বে পুঁজির স্বার্থবাহী শাসকদের গর্বে মাটিতে পা পড়ে না, তাতে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন অন্যূন আড়াই লক্ষ মানুষ, যাঁদের বেশির ভাগই আদিবাসী, এই দেশের নির্মাণে যাঁদের জ্ঞান এবং শ্রমের অবদান সব থেকে বেশি। আবার, যে ভাবে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ রুদ্ধ করে দেওয়া হল, সেই ভাবেই এই সব মানুষের নদী ও নদীতীরবর্তী প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগটিকেও ছিন্ন করে দেওয়া হল। শুধু নদী ও মানুষ না, গবেষণা দেখাচ্ছে, ইতিমধ্যে বৃহৎ নদীবাঁধের কারণে পৃথিবীর কয়েকশো প্রজাতির লতা-গুল্ম, বৃক্ষ ও প্রাণী অবলুপ্ত। যে সর্দার সরোবরের উপর বল্লভভাই পটেলের— পৃথিবীর উচ্চতম, ১৮২ মিটারের— মূর্তিটি বসানো হয়েছে, তার প্রভাবিত এলাকা জুড়ে উচ্ছিন্ন হয়েছে নানা প্রজাতির জলজ ও উভচর প্রাণী, নানা গাছপালা ও বন্যপ্রাণী। বিজ্ঞানীদের সতর্কতা, সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ, এমনকি সরকারের নিজের প্রণয়ন করা আইন ভেঙে গড়ে উঠেছে সর্দার সরোবর।

অনিতা অগ্নিহোত্রীর প্লাবন জল এক দিকে যেমন এই ধ্বংসের গড়ে ওঠার কাহিনি, তেমনই অন্য দিকে মানব-প্রজাতির অন্তর্লীন প্রকৃতিরও ভাষাচিত্র। পুঁজির লালসা, রাষ্ট্রের নিপীড়ন, প্রকৃতির উপর ক্ষুদ্র স্বার্থের দখলদারির জন্য বিকট সব ষড়যন্ত্র, আইন ও নৈতিকতার দলন, ইত্যাদির নিষ্কুণ্ঠ বর্ণনার পাশাপাশি লেখক গেঁথে চলেছেন নদী ও তার সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্কে জড়িয়ে থাকা মানুষের কাহিনি, তাঁদের হতাশা, প্রতিবাদ, আত্মত্যাগের বাক্যমালা। এ কথনে পাঠকের সামনে জীবন হয়ে উঠে আসে পৃথিবীর দীর্ঘতম ও বিস্তৃততম আন্দোলনগুলোর অন্যতম ‘নর্মদা বাঁচাও’ আন্দোলন। কেবল বাবা আমটে, মেধা পাটকরের মতো বিখ্যাত চরিত্ররাই নন, এ বই পড়ার সময় পাঠক সেই সব মানুষের শ্বাসের শব্দ শুনতে পাবেন, যাঁরা এই আন্দোলনের অন্যতম নির্মাতা। এ উপন্যাসে মেধা পাটকরের সঙ্গে লেখকের আদল পেয়ে যাওয়া এক চরিত্রের কথোপকথনে মেধার প্রশ্ন, তুমি ঘাটো খাবে নাকি খিচুড়ি? অর্থাৎ আন্দোলন করবে, না লেখালিখিতেই আটকে থাকবে? তাঁর উত্তর ছিল, খিচুড়ি। এই সততাই লেখকের অন্তর্ভূমি, যার টানে তাঁর হাত নেমে আসে পাঠকের কাঁধে, আর পাঠক নিজেও যেন হয়ে ওঠেন উপন্যাসের এক চরিত্র।

কুমার রাণা

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy