যদিও আনিসুজ্জামান এ-গ্রন্থের শুরুতেই জানিয়েছেন ‘এই সংকলনের অন্তর্ভুক্ত প্রবন্ধগুলোর সবই অনেক আগে লেখা’, তবু তাঁর মতো মনস্বীর রচনাদি ফিরে-পড়ার মধ্যে প্রতি মুহূর্তেই নতুন ভাবে ভাববার রসদ থেকেই যায়। এ-সঙ্কলনের লেখাগুলি অবশ্য এর আগে তাঁর কোনও প্রবন্ধগ্রন্থে ঠাঁই পায়নি। এত পুরনো রচনা, কিন্তু বিষয়ের দিক থেকে, আনিসুজ্জামানের দৃষ্টিক্ষেপের দিক থেকে রীতিমতো প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, দীনবন্ধু মিত্র, ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়, মীর মশাররফ হোসেন, শেখ আবদুর রহিম, শেখ ফজলল করিম— অখণ্ড বাংলার এই অবিসংবাদী ব্যক্তিত্বদের নিয়ে লিখেছেন তিনি। প্রথমটিই বিদ্যাসাগরকে নিয়ে: ‘‘মানবপ্রীতি এবং নারীত্বের প্রতি শ্রদ্ধা তাঁর স্বভাবজ ছিল; আর ছিল অমিত চরিত্রবল।... রামমোহনের মতো তিনি ধর্মবিষয়ক প্রশ্নে ব্যাকুল হননি, তাই বলা যায়, রামমোহনের চেয়ে নবযুগের আদর্শ তাঁর মধ্যেই অধিকতর প্রতিফলিত হয়েছিল।’’ ঈশ্বরচন্দ্রের জন্মদ্বিশতবর্ষে এমন মন্তব্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে আমাদের কাছে। এমন আরও লিখেছেন আনিসুজ্জামান, বিদ্যাসাগর ও বাংলা গদ্য নিয়ে: ‘‘বিদ্যাসাগরের পূর্ববর্তী বাংলা গদ্য ব্যবহারোপযোগী হওয়া সত্ত্বেও... গদ্যরীতিকে রসহীন করে রেখেছিল।... গদ্যের অন্তর্নিহিত ছন্দকে আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন বলে বিদ্যাসাগরের পক্ষে সুষম বাক্যগঠনরীতি প্রবর্তন করা সম্ভব হয়েছিল।... বিদ্যাসাগরই সর্বপ্রথম ‘সুশ্রব্য, সরস, ছন্দোময় অথচ গাম্ভীর্যপূর্ণ’ রচনা আমাদেরকে উপহার দিতে পারলেন।’’ মীর মশাররফ হোসেন-কে উনিশ শতকের বাঙালি মুসলমান সাহিত্যস্রষ্টাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে মানেন আনিসুজ্জামান। তাঁর রত্নাবতী, বসন্তকুমারী, জমীদার দর্পণ নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি আনিসুজ্জামান তাঁর অসাম্প্রদায়িক মনটি পাঠককে চেনানোর জন্যে তাঁর ‘গো-জীবন’ রচনাটিরও উল্লেখ করেছেন: ‘‘কালে আমরা রাজাকে পরিত্যাগ করতে পারি। রাজাও আমাদিগকে পরিত্যাগ করিতে পারেন। কিন্তু হিন্দু-মোসল্মানে কেহই কাহাকে পরিত্যাগ করিতে পারিবে না।... জানিবেন ভারতে হিন্দু-মোসল্মান একত্র হইয়া একযোগে কোন কার্য্য না করিলে কখনই তাহা সিদ্ধ হইবে না।’’
মীর মশাররফ হোসেন-এর রচনায় প্রাণিত হয়ে যে বাঙালি মুসলমান লেখকরা সাহিত্যক্ষেত্রে প্রবেশ করেছিলেন শেখ ফজলল করিম তাঁদের মধ্যে অন্যতম, আনিসুজ্জামান জানিয়েছেন ‘‘সুফি ভাবধারা তাঁর সাহিত্যসাধনাকে বিশেষভাবে প্রভাবান্বিত করেছে।’’ আর সে-যুগের ‘‘মুসলমান লেখক ও সাংবাদিকদের মধ্যে শেখ আবদুর রহিমের বিশিষ্ট স্থান।’’— আনিসুজ্জামানের মত।
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
প্রশাসক সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় থেকে কাতি পুজোর গান— এমন স্বতন্ত্র বিষয়বস্তু যখন একই সঙ্গে গ্রন্থবদ্ধ হয়, তখন তা বহুবিচিত্র খোঁজের সন্ধান দেয়। আর তাতে জড়িয়ে থাকে লেখকের আগ্রহ আর অনুধ্যানের বিচিত্রতা। জনগোষ্ঠীর সমাজ, ভাষা, ধর্ম, রীতিনীতি, গান-সহ সার্বিক সংস্কৃতির নানা বিষয়বিন্যাসে গড়ে ওঠে তখন লেখকের চর্চা আর মতামত। যে রাজবংশী সমাজ-সংস্কৃতির মধ্যে লালিত হয়েছেন লেখক, সে সব কথা আর উপলব্ধি তো আছেই; সার্বিক ভাবে উত্তরবঙ্গের জনসমাজ আর মেচ, রাভা, গারো, টোটো জনজাতির নানা উল্লেখে আত্মকথার বয়ানে লিপিবদ্ধ করেছেন। নানা পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন সময়ে মূলত আমন্ত্রিত লেখা এ সব। ইতিমধ্যে উত্তরবঙ্গের জেলাবিন্যাসও পাল্টেছে। সব মিলিয়ে দু’খণ্ডের ৭৭টি লেখায় এই প্রকাশনা। এ সব লেখা বিষয়ভিত্তিক সাজানো নয় বা লেখাগুলির প্রকাশসূত্র ও কাল উল্লেখ নেই। পাঁচটি ইংরেজি লেখাও আছে। সম্পাদনার এই ঘাটতি থাকলেও লেখাগুলি তথ্য, অভিজ্ঞতা আর কথকতার বয়ানে আকর্ষণীয়। পঞ্চানন বর্মা, আব্বাসউদ্দিন, প্যারীমোহন দাস, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় প্রমুখের কর্মযোগীর ভূমিকা নানা প্রসঙ্গে আছে। সুখবিলাস বর্মার প্রশাসনিক পদ-তৎপরতার পাশাপাশি গায়ক ও গবেষক সত্তা, সেই সঙ্গে প্রতিবাদী মানসিকতার ধাঁচ নানা ঘটনা প্রবাহকে সজাগ করে দেয়। ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’-র নাট্যরূপ নিয়ে বিতর্কও সঙ্কলিত হয়েছে এখানে। আলোড়ন তোলা বিতর্কে ব্যক্তিগত পরিসরের কথালাপে সতেজ সংবাদধর্মী বয়ান। এমন সব লেখার খোঁজে আঞ্চলিক বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সন্ধানী হওয়া বহুলাংশে অসম্ভব। এই প্রেক্ষিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন সম্পাদক ও প্রকাশক।
উত্তরবঙ্গ পরিক্রমায় প্রবন্ধ সংকলন (খণ্ড ১-২)
সুখবিলাস বর্মা ,৪৫০.০০ (প্রতি খণ্ড)
উপজনভুই পাবলিশার্স, কোচবিহার
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy