১৯৭০-এর দশকে মহারাষ্ট্রে দলিত প্যান্থার আন্দোলন এক মাইলফলক। সবর্ণ ইতিহাস ও সাহিত্যে তথাকথিত নিচু জাতের স্বরের ঠাঁই ছিল না। দলিত প্যান্থাররা সেই ব্রাহ্মণ্য ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে একটি প্রতিস্পর্ধী বয়ান নিয়ে এসেছিলেন সাহিত্যে। তৈরি হয়েছিল দলিত সাহিত্য। অনেকটাই এই আন্দোলনের অনুপ্রেরণায় ১৯৯০-এর দশক থেকে গুজরাতি, কন্নড়, তামিল ও তেলুগুতে, এবং বাংলা ভাষায় দলিত সাহিত্য আত্মপ্রকাশ করল। মূলস্রোতের সমান্তরালে ও সবর্ণ অধ্যুষিত বাংলা সাহিত্যের অন্তরালে চলতে থাকা দলিত লিটল ম্যাগাজিনের মধ্য দিয়ে।
দেবী চট্টোপাধ্যায় ও শিপ্রা মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ও অনূদিত আন্ডার মাই ডার্ক স্কিন ফ্লোজ় আ রেড রিভার: ট্রান্সলেশন অব দলিত রাইটিংস ফ্রম বেঙ্গল-এর গুরুত্ব এখানেই যে, এই বইটি অ-বাংলাভাষী পাঠকের কাছে বাংলা দলিত সাহিত্যের এক নির্বাচিত সম্ভার তুলে ধরে, যা এমনকি বাংলা সাহিত্যেও এক অনুন্মোচিত অধ্যায়। এই সঙ্কলনটি আবার খেয়াল করিয়ে দেয় যে, বাংলার ইতিহাসে সামাজিক বৈষম্য, ভূমি ও সম্পত্তির অধিকারের অসম বণ্টনকে শ্রেণিসঙ্কটের উদাহরণ হিসেবে পড়ার ধাঁচাটি পর্যাপ্ত নয়। বৈষম্য ও শোষণের ভয়ঙ্কর চক্র কেন ক্রমান্বয়ে চলতে থেকেছে, সেটা জাতপাতের নিরিখে না দেখলে বোঝা যাবে না। এখানে দলিত সাহিত্য জাতপাতভিত্তিক সামাজিক নিপীড়নের ‘টেস্টিমনি’, এবং একই সঙ্গে নিপীড়নকে পড়ার সেই বিশ্লেষণী ‘লেন্স’টি দিতে পারে। সম্পাদক-অনুবাদক দু’জন আমাদের সেই পঠন-প্রক্রিয়ার দিকে নিয়ে যান।
দেবী চট্টোপাধ্যায় শুরুতেই আলোচনা করেন, কী ভাবে ব্রাহ্মণ্য স্মৃতিশাস্ত্রের বর্ণব্যবস্থা থেকে কালক্রমে জাতপাতের জটিল ও স্তরান্বিত অসাম্যের থাকবন্দি কাঠামো তৈরি হল, যার প্রধান হাতিয়ার অস্পৃশ্যতা। বাংলায় দলিত চেতনা উন্মেষের পরম্পরাটি ধরতে তিনি কয়েকটি ঐতিহাসিক মুহূর্তকে চিহ্নিত করেন। উনিশ শতকের শেষভাগে মতুয়া গণজাগরণ; ১৯৩০-এর দশক থেকে যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের নেতৃত্বে অবিভক্ত বাংলায় অল ইন্ডিয়া শেডিউলড কাস্টস ফেডারেশন-এর রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ ও নমশূদ্র চেতনা গঠনে তাঁর ভূমিকা; ও ১৯৪৭-এর বাংলা ভাগ। ১৯৯২-এ তৈরি হয় বাংলা দলিত সাহিত্য সংস্থা। দলিত বিশ্লেষণী স্বর ও সাহিত্যিক অভিব্যক্তি উঠে আসতে থাকে চতুর্থ দুনিয়া, দলিত কণ্ঠ, জাগরণ, ঐকতান গবেষণা পত্রিকা, নিখিল ভারত ইত্যাদি লিটল ম্যাগাজিনে। তার প্রকাশের মধ্যে কথ্যভাষার শব্দ ও গড়ন, মৌখিক সাহিত্যের ঝোঁক, লোক-আঙ্গিকের চলন থাকায় দলিত সাহিত্যের লিখন-আঙ্গিকে মূলস্রোতের সাহিত্য থেকে আলাদা একটা ঝোঁক দেখা যায়।
যেখানে লেখকরা আসছেন শ্রেণিগত ভাবে প্রান্তিক সমাজ থেকে, গ্রামীণ জাতপেশার পরিবার থেকে, সেখানে প্রাত্যহিকতার বিন্যাস সবর্ণ সমাজ থেকে আলাদা বটেই। দলিত জীবনে জাতনির্ভর বৃত্তি থেকে ‘রিচুয়াল’ যাপন তার সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞানগুলি তৈরি করে। এখানেই শিপ্রা এ রকম অনুবাদ সঙ্কলনের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি তোলেন— যে হেতু অন্যান্য ভারতীয় ভাষার জাতপাতের সমধর্মী সামাজিক অভিজ্ঞতা রয়েছে, রয়েছে একই ভাষার মধ্যে উচ্চ ও নিম্নকোটির ভিন্ন ভিন্ন পরিসর, দলিত সাহিত্যের দলিতত্ব ও অঞ্চল-নির্দিষ্টতা অন্য ভারতীয় ভাষায় অনুবাদ সম্ভব হলেও তা ইংরেজি ভাষায় করা সম্ভব কি না। এখানে সম্পাদক ও প্রকাশকের একত্র অবস্থানটি লক্ষণীয়। তাঁরা শুধু কিছু নির্বাচিত লেখার অনুবাদ সঙ্কলন প্রকাশ করছেন না, তাঁরা এটিকে একটি ‘অ্যাকাডেমিক’ অবস্থান দিচ্ছেন, এবং তা সরাসরি ও সহজবোধ্য আঙ্গিকে। তা উৎসুক পাঠককে দলিত সাহিত্য পড়ার একটি ‘ওরিয়েন্টেশন’ দিচ্ছে, তেমনই অনুবাদকে নিছক এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় নিয়ে যাওয়ার থেকে অনেক বেশি ক্রিটিক্যাল ও রাজনৈতিক একটি ক্রিয়া করে তুলছে। সে ক্ষেত্রে পাঠ নির্বাচন ও অনুবাদের পন্থা, উভয়ই দলিত অভিজ্ঞতার ও চেতনার অপরত্ব, তার ভাষার অনুবাদ-অসাধ্যতাকে দেখিয়ে দিতে থাকে।
মোনালিসা দাসের কবিতা আলোচনা করে শিপ্রা দেখান যে, দলিত অভিজ্ঞতার বর্ণনার সময় কী ভাবে কথ্য ‘কাইটছে কাল’ ব্যবহার করে তিনি শ্লেষ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এই কথ্য বা আঞ্চলিক শব্দ কবিতায় বেশি ব্যবহার হয়, মহিলাদের লেখায় নিবিষ্ট ভাবে উপস্থিত হয়, স্মৃতিকণা হাওলাদার ও কল্যাণী ঠাকুর চাঁড়ালের লেখায় যেমন। শিপ্রা বলেন, দলিত জীবনের অপরত্ব— বিষয় হিসেবে— অনুবাদ-অসাধ্য নয়। কিন্তু অন্য দিকে, জাতপাতের অভিজ্ঞতায় নির্দিষ্ট শব্দগুলি দেখায় যে, ইংরেজি থেকে ঝটিতি যে কোনও তুল্য শব্দ বেছে নেওয়া সম্ভব নয়, তেমনই অনুবাদককে সচেতন করে দেয় তাঁর নিজের সামাজিক অবস্থানের সীমা বিষয়ে। সম্পাদকরা জানান, কী ভাবে তাঁরা বুঝতে চেষ্টা করেছেন যে, দলিত সাহিত্যের নান্দনিকতা বলে যদি কিছুকে তত্ত্বায়ন করতে হয়, তা হলে তা শুধু ভাষা-শৈলী-রূপকের মহড়ায় দেখলে হবে না, দেখতে হবে অবরুদ্ধ দলিত স্বরের আত্মপ্রকাশের দলিল হিসেবে, জাতপাতের নিগড়ের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে, গোষ্ঠীর কাছে মুক্তির প্রতিশ্রুতি নিয়ে আসার ক্ষমতায়।
দলিত সাহিত্যের রূপরেখা নির্ণয় করতে সম্পাদকেরা বেছে নিয়েছেন নানা বর্গের রচনা, প্রবন্ধ, গদ্যসাহিত্যে উপন্যাস ও ছোটগল্প, কবিতা, চিঠি, আত্মজীবনী, ধর্মীয় কথকতা সঙ্গীত যেমন রামায়ণ গান। অনুবাদে রয়েছে কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর, সনৎ কুমার নস্কর, অচিন্ত্য বিশ্বাস, মঞ্জু বালা, রূপকুমার বর্মণ প্রমুখ প্রাবন্ধিকের লেখার সঙ্গে অদ্বৈত মল্লবর্মণ, যতীন বালার উপন্যাস, ১৮টি ছোট গল্প, ২৮টি কবিতা, ৭টি আত্মজীবনী-সহ দলিত লিটল ম্যাগাজিন বিষয়ে কপিলকৃষ্ণ ঠাকুরের একটি আলোচনা।
ঔপনিবেশিক আধুনিকতা থেকে আজ অবধি এই সঙ্কলনের সীমা বিস্তৃত থাকলেও সম্পাদকেরা বার বার উল্লেখ করেছেন যে, ‘দলিত’ বর্গনামটি না থাকলেও দলিত চেতনার প্রকাশকে বহু আগেই লক্ষ করা যায়। যেমন সাহিত্যিক মনোহর মৌলি বিশ্বাস চর্যাপদের অব্রাহ্মণ গুরু ও তাঁদের কবিতায় ব্যাধ, কুম্ভার জাতের জীবন দেখেছেন, তেমনই শিপ্রা দেখান যে, ১৯৯২-এ দলিত সাহিত্য সংস্থানের নেতৃত্বে ছাপার হরফে দলিত স্বর প্রকাশ পেলেও তার অনেক আগে থেকেই কর্তাভজা ইত্যাদি সাধনায়, ধর্মনিষ্ঠায়, ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রবিরোধী উচ্চারণকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব। এবং পাওয়া সম্ভব মৌখিকতায় অনুষ্ঠিত রিচুয়ালে। অনেক সময়ই সেই সাধনসঙ্গীতের কবির নাম পাওয়া যায় না, কিন্তু শিপ্রা বলেন, গত কিছু শতাব্দী ধরে প্রান্তিক ও অব্রাহ্মণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিপুল ভাবে বহমান এই ধারাগুলির শক্তি ও জনপ্রিয়তা থেকে তাদের দলিত বিভবকে আন্দাজ করা যায়। সঙ্কলনটি এই ভাবে দলিত অবস্থানের বহুত্বকে চিহ্নিত করে। সেখানে মূলস্রোতের সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্ম হতে চেয়েছেন কেউ, কেউ সম্পূর্ণ বিরোধাভাস চেয়েছেন। এক দিকে রয়েছে আঞ্চলিক গ্রামীণ জীবনের কথ্যবুলি, অন্য দিকে মূলস্রোতের লিখিত বাংলা। অন্য দিকে, এই সঙ্কলনে মুসলমান ও খ্রিস্টান সমাজেও জাতপাতের সমধর্মী গঠনকে চিহ্নিত করে আত্মপরিচয়ের বর্গ হিসেবে দলিতকে অনেক বেশি প্রসারিত ও জটিল করে তোলা হয়েছে।
ভারতীয় ভাষায় রচিত দলিত সাহিত্যের ইংরেজিতে অনুবাদে স্ত্রী-সাম্য প্রকাশনার গুরুত্ব লক্ষণীয়। নবায়ন প্রকাশনা আম্বেডকরের দি অ্যানাইহিলেশন অব কাস্ট ছাপাতে সবর্ণরা তাঁকে নিয়ে নিল বলে দলিত সাহিত্যগোষ্ঠীর মধ্যে যে ‘গেল গেল’ রব উঠেছিল, এখানে দলিত স্বরের আত্মপ্রকাশ বিষয়ে সেই অবস্থানে থেকে যাওয়া সমীচীন নয়। এখন গুরুত্বপূর্ণ অ্যাকাডেমিক-অনুবাদক ও দলিত সাহিত্যিকদের মধ্যে ‘কোল্যাবরেশন’, যাতে দলিত সাহিত্য ও দলিত স্টাডিজ় দুই-ই বিস্তার পায়।
শেষাবধি, বৈদিক শূদ্র ও অতিশূদ্র অবস্থানগুলি কী, সেখান থেকে অস্পৃশ্য জাতগুলির উদ্ভব বিষয়ে আর একটু আলোকপাত প্রয়োজন ছিল। নমশূদ্র, বারুই, মালো এই ভাবে কিছু লেখকের জাত নাম উল্লেখ আছে। সেটি অন্য সব লেখকের ক্ষেত্রে থাকলে দলিত সাহিত্য নির্মাণে কোন কোন জাত প্রতিনিধিত্ব করছে, তার একটা ধারণা তৈরি হত। রাইচরণ সরকারের জাত নাম পৌণ্ড্র উল্লেখ করার সময় আচমকা ‘অস্পৃশ্য’ বিশেষণটি না ব্যবহার করলেও চলত (পৃ ৩২৭)।
প্রচ্ছদটি বিশেষ উল্লেখ করার মতো। ছাঁচ-ভাঙা ফর্মে পারমিতা ব্রহ্মচারী দেখান রক্তাক্ত স্রোতের মধ্যে একটি অ্যান্ড্রোগাইনাস শরীর, মজ্জমান ও বহমান। তাকে শ্রম ও ক্ষুধার শরীর বলে চিনতে ভুল হয় না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy