Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪
book review

সাম্য ও স্বাধীনতার কথা

বইয়ের অনেক অধ্যায়ে আমরা খুঁজে পাই এমন ইতিহাস ও পাঠ-পদ্ধতি যা নিম্নবর্গের ইতিহাস বা মূলধারার সাহিত্যের থেকে আলাদা।

দমন: সাঁওতাল বিদ্রোহের পর। ১৮৫৬ সালের ছবি। উইকিমিডিয়া কমনস

দমন: সাঁওতাল বিদ্রোহের পর। ১৮৫৬ সালের ছবি। উইকিমিডিয়া কমনস

রজত রায়
শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০২৩ ০৯:৪২
Share: Save:

দেখেও না-দেখা জাতপাত-বিভক্ত বঙ্গসমাজে দলিত সাহিত্য এক নতুন রাজনীতির ইস্তাহার। মৃন্ময় প্রামাণিক সম্পাদিত দলিত সাহিত্য চর্চা বইটি এমন এক নতুন ভাবধারাকে ব্যক্ত করে, যা কেবল অধ্যয়ন-গবেষণার ক্ষেত্রে এক নতুন সংযোজন নয়, তার সমাজ-রাজনৈতিক গুরুত্বও অনেক।

বইটির প্রধান প্রশ্ন হল দলিত কে, ও দলিত সাহিত্য কী এবং কেন। বঙ্গসমাজে শিক্ষা, সংস্কৃতি, ভাষা, ঐতিহ্য এবং মূলধারার সাহিত্যে উচ্চবর্ণের যে আন্তঃপ্রজন্ম সংরক্ষণ রয়েছে, তার বিরুদ্ধে সুনিপুণ বিশ্লেষণ করেছেন বইটির লেখকেরা। তাঁরা তুলে ধরেছেন, কী ভাবে বাংলা ও বাঙালির সাহিত্য-শিক্ষা-ভদ্রতার পিছনে লুকিয়ে রয়েছে জাত-অস্পৃশ্যতার এক নিরবছিন্ন অপরায়ণ (আদারাইজ়েশন)। আর এই অপরায়ণের মধ্যে কেবল হিন্দুসমাজের অস্পৃশ্য ও নিচু-জাতের মানুষই নয়, নিহিত রয়েছে দলিত নারী, মুসলমান ও ভূমিহীন কৃষকের প্রশ্নও।

এখান থেকেই পাওয়া যায় দলিত কে, এই প্রশ্নটির উত্তর। সামগ্রিক ভাবে বইটিতে ‘দলিত’ শব্দটির দুই ধরনের সংজ্ঞা পাওয়া যায়: এক, দলিত বিশেষ্য অর্থে অতিশূদ্র বা তফসিল জাতির মানুষের কথা বলা যেতে পারে, আবার দলিত বিশেষণ অর্থে এক চেতনাবোধের কথা বলা যেতে পারে, যা ব্যক্তি-জাত পরিসরের ঊর্ধ্বে। প্রথম সংজ্ঞাটি জীবন এবং জীবন-লব্ধ অভিজ্ঞতাসূচক, দ্বিতীয়টি সংগ্রামসূচক। তিনিই দলিত, যিনি তাঁর জন্মগত জাত-পরিচয়ের কারণে সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বীকৃতি থেকে সর্বদা বঞ্চিত। এটাই তাঁর জীবনলব্ধ অভিজ্ঞতা ও চেতনা, তাই জীবনের মতো তাঁর এই চেতনার ভাষাও নেতিবাচক এবং একই সঙ্গে আন্দোলনসূচক।

এখানেই জুড়ে যায় দলিত বিশেষ্য-বিশেষণমূলক দু’টি সংজ্ঞাই— সঙ্কীর্ণ অর্থে দলিত কেবল সে-ই যে অতিশূদ্র, আর সামগ্রিক অর্থে দলিত হল সাংস্কৃতিক জড়তার বিরুদ্ধে চেতনালব্ধ লড়াই, যা সকল প্রান্তিকতাকে নাকচ করে এবং সাম্য ও স্বাধীনতার কথা বলে। বইটিতে এই দু’টি ধারণাকে পরিপূরক ভাবে দেখানো হয়েছে। কেবল ‘দলিত’ শব্দটির ব্যঞ্জনা নয়, বইটি তুলে ধরেছে দলিত সাহিত্যের মৌলিকতাকেও।

দলিত সাহিত্য চর্চা

সম্পাদনা: মৃন্ময় প্রামাণিক

৯৭৫.০০

গাঙচিল

দলিত সাহিত্য তত্ত্ব, দলিত ইতিহাস এবং দলিত-জীবন পাঠ, এই তিনটি বিষয়ে বিভক্ত বইটিতে বাহান্নটি অধ্যায় আছে। বইটিতে ঠিক যে ভাবে দলিত শব্দের ব্যাখ্যা আছে, অনুরূপ ভাবে চেষ্টা করা হয়েছে দলিত সাহিত্যের স্বতন্ত্র একটি নন্দনতত্ত্ব এবং পাঠের পরিসর তৈরির। এক কথায় যা হল ‘দলিত স্টাডিজ়’। সম্পাদকের মতে, দলিত সাহিত্যের এবং দলিত পাঠের পদ্ধতির একটি নিজস্বতা আছে— যেমন আছে এর নিজস্ব তত্ত্বদর্শন, তেমন আছে এর স্বতন্ত্র ইতিহাস ও ইতিহাস পাঠ-পদ্ধতি, সর্বোপরি একটি ‘অ্যাফেক্টিভ মেথড’। বেশ কিছু অধ্যায়ে পাঠক খুঁজে পাবেন এই পাঠ-পদ্ধতির প্রয়োগ, যা বইটিকে বেশ আকর্ষক করে তোলে।

সমসাময়িক দলিত স্টাডিজ়ে মনে করা হয় যে, দলিত সাহিত্য কেবল একটি তথ্যপূর্ণ জ্ঞানভান্ডার নয় বা কেবল ব্যক্তিকেন্দ্রিক জীবন-অভিজ্ঞতার অভিব্যক্তিই নয়, দলিত সাহিত্য আদতে হল ব্রাহ্মণ্যবাদী সামাজিক বঞ্চনার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মর্যাদা ও সামাজিক সম্মানের জন্য লড়াই। আর তাই, দলিত সাহিত্যের পরিসর এক রূপ রাজনীতিরও স্থান। বইয়ের অনেক অধ্যায়ে আমরা খুঁজে পাই এমন ইতিহাস ও পাঠ-পদ্ধতি যা নিম্নবর্গের ইতিহাস বা মূলধারার সাহিত্যের থেকে আলাদা। এই ভিন্নতার প্রধান কারণ হল, উচ্চবর্ণ সৃষ্ট নিম্নবর্গের ইতিহাস বা সাহিত্যে নিম্নবর্গের মানুষ কেবল গবেষণার বা সহানুভূতিময় আলোচনার বিষয়, যার নিজস্ব কোনও ‘এজেন্সি’ বা প্রতিনিধিত্ব নেই। এখানে সে মূলত নির্বাক দর্শক। অন্য দিকে, দলিত সাহিত্য ও দলিত পাঠ-পদ্ধতি হল দলিত প্রান্তিকতার বিরুদ্ধে আত্মসম্মান ও সামাজিক মর্যাদার চেতনার আখ্যান। এ রূপ অ্যাফেক্টিভ মেথডে (পাঠে), জাতপাতের প্রশ্ন থাকে সাহিত্যে বা বিশ্লেষণের কেন্দ্রবিন্দুতে। আর তাই, বইটিতে যেমন ভবিষ্যতের গবেষণার জন্য দলিত নন্দনতত্ত্বের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, তেমনই নথিভুক্ত হয়েছে বাউরি, পৌণ্ড্র, নমশূদ্রের মতো জনজাতির সমাজ-সংস্কৃতির আন্দোলন এবং লিখিত ও মৌখিক সাহিত্য। সেই সঙ্গে ব্রাহ্মণ্যবাদকে প্রশ্ন করে বর্ণন হয়েছে দেশভাগ ও ছিন্নমূল দলিত জীবনের অভিশাপের আখ্যান, বা দলিত মহিলার সাহিত্যিক হয়ে ওঠার পাঠ, কিংবা দেবব্রত বিশ্বাস বা কান্তি বিশ্বাসের মতো সফল ব্যক্তিত্বের জাত-হিংসার কবলে পড়ার ইতিকথা।

মোট ষোলো জন বিশিষ্ট লেখকের দলিত সাহিত্য ‘তত্ত্ব’ অংশে বিস্তারিত ভাবে এবং বিভিন্ন আঙ্গিক থেকে সাহিত্যের দর্শন, ভাষাতত্ত্ব, তার আলোচনা ও পাঠ-পদ্ধতি বিবৃত হয়েছে। এই অংশে যেমন রয়েছে ব্রাহ্মণ্যবাদী মান্যরূপ ভাষা ও বাক্যবিন্যাসের সমালোচনামূলক মূল্যায়ন, তেমনই তুলে ধরা হয়েছে বাংলা উপভাষাগুলির মর্যাদাহীনতার কথা। নানা অধ্যায়ে বলা হয়েছে দলিত নারীবাদ ও তার আন্দোলনের ঐতিহ্যের প্রসঙ্গ, দলিত মুসলমানের বহুস্তরীয় প্রান্তিকতার কথা, কিংবা কৃষ্ণাঙ্গদের আন্দোলনের সঙ্গে দলিত আন্দোলনের আদর্শগত সাদৃশ্য, বা মার্ক্স এবং উদারবাদের সঙ্গে দলিত তত্ত্বের তুলনামূলক বিশ্লেষণ। উঠে এসেছে সাহিত্যের অনুবাদ তত্ত্ব প্রসঙ্গ, বা একাঙ্ক নাটক ও আত্মজীবনী পাঠের পদ্ধতি। সব মিলিয়ে দলিত নন্দনতত্ত্ব ও কাব্যশাস্ত্রকে স্বতন্ত্র ভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে তিনটি বিষয়ের মধ্য দিয়ে: ‘সাফারিং’ বা ক্লেশ, ‘নেগেশন’ বা প্রত্যাখ্যান এবং ‘রিভোল্ট’ বা বিদ্রোহ।

ইতিহাস প্রসঙ্গে মোট বারোটি অধ্যায়ে বইটি তুলে ধরেছে কৈবর্ত বিদ্রোহ, চুয়াড় ও সাঁওতাল বিদ্রোহ, চাকমা ও গারো বিদ্রোহ, মতুয়া আন্দোলন, বা পৌণ্ড্র জাতি আন্দোলনের মতো জাতপাত-বিরোধী সংগ্রাম ও দলিত জাগরণের আখ্যান। এ ছাড়া রয়েছে বৃহত্তর দলিত আন্দোলনে দলিত পত্রপত্রিকার ইতিহাস, বিশ্লেষণ ও পাঠ, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ইতিহাস, সংস্কৃতি, আত্মজীবনীমূলক প্রবন্ধ। এর সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রান্তিক মানুষের মৌখিক ও লিখিত সাহিত্য, গান। চব্বিশটি প্রবন্ধে উঠে এসেছে তুলনামূলক পরিপ্রেক্ষিতে দলিত সাহিত্যের পাঠভিত্তিক আলোচনা।

দলিত সাহিত্য ও সংস্কৃতির মৌলিক তথ্যে সমৃদ্ধ লেখাগুলি প্রান্তিক জীবনের মর্যাদার লড়াইকেই কেবল স্বীকৃতি দেয় না, পাঠকমনে আরও অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। আরও সমালোচনামূলক বিশ্লেষণের আশায় থাকে সে। কেবল সাহিত্য-সংস্কৃতির বর্ণনা নয়, পাঠক ও বিশ্লেষক হিসাবে আমাদের চাই আরও অনেক নতুন ধারণাগত সামগ্রী/ নকশা (‘টুল’) এবং শব্দভান্ডার, যা দলিত লড়াইকে আরও সুদৃঢ় করবে। তবু দলিত সাহিত্য চর্চা বইটি সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতির পরিসরে যে নতুন ভাষা নিয়ে এসেছে তা অপরিহার্য এবং কাঙ্ক্ষিত।

অন্য বিষয়গুলি:

book review Dalit group Literature
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy