বারে বারে যে সব অভিজ্ঞতা এসে জমা হয় একটাই আধারে, তারই আরও এক দিক এটা। “উনি এমন কীই বা লিখেছেন?”— এ প্রশ্ন এসে এসে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো পুনঃ পুনঃ আছড়ে পড়তেই থাকে মেয়েদের লেখালিখির তটভূমিতে। কবিতা সিংহের মূল পরিচয় কবির। শুধুই কবিতা লিখলেই তাঁর নাম পরবর্তী প্রজন্মের পর প্রজন্মের শিরোধার্য রাখার কথা। কিন্তু আমরা জানতে পারছি, শ্রেষ্ঠ কবিতা ধরলে তাঁর জীবদ্দশায় কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা মাত্র চার। এ দিকে গ্রন্থিত গল্প ও উপন্যাসের বই যথাক্রমে দুই ও সতেরো। এ ছাড়াও পাওয়া না-পাওয়া অগ্রন্থিত উপন্যাসের সংখ্যা দশ। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে ষাট বা সত্তর দশকে লেখা হয়ে যাওয়া এই আপাতবিস্মৃত উপন্যাসগুলিকে যে ভাবে গ্রহণ করতে পারছি আমরা, তা বলে যায় যে, ‘উনি কী লিখেছিলেন যেন?’ প্রশ্নটিকে বার বার তুচ্ছ করেছেন মহৎ সাহিত্যিকেরা, যাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য কবিতা সিংহ। তাঁর কথায়, “সাধারণত আমার লেখার উৎস ক্রোধ। প্রতিবাদ। নতুন আঙ্গিকে বিশ্বাসী বলেই কোনও উপন্যাসই এক ধাঁচে লেখা আমার স্বভাববিরুদ্ধ।”
এক ওয়েব-পত্রিকা ঘাঁটতে ঘাঁটতে দেখেছিলাম, কবিতা সিংহ সম্পর্কে বলা হয়েছে “তাঁর উপন্যাসগুলি সেভাবে নান্দনিক হয়ে ওঠেনি।” এক কলমের খোঁচায় কত সহজেই না যে কোনও সাহিত্যকর্মকে পায়রার খোপে নিক্ষেপ করা যায়! ‘শুধুই প্রতিবাদী’ বলে কবিতা সিংহের উপন্যাসের সাহিত্যগুণ ভুলে কেবল তাঁকে ‘অ্যাজেন্ডা-লেখক’এর (পড়ুন সামাজিক ভাবে দায়বদ্ধ স্লোগান-রচয়িতা) খোপে রাখি, যে ভাবে লীলা মজুমদারের উপন্যাসের শেষে নায়ক-নায়িকার মিলন দেখানো হত অবধারিত, তাই তাঁর প্রাপ্তবয়স্ক লেখাগুলিকে ‘ততটা প্রাপ্তবয়স্ক নয়’-এর দলে ফেলে দেওয়া যায়। এ ভাবেই কবিতা সিংহ সম্পর্কে তাঁর পৌরুষ নামের উপন্যাসটি (বিষয়ে তৃতীয় লিঙ্গভুক্ত মানুষের জীবনের গবেষণালব্ধ বিবরণ) বাদে বাকিগুলির কথা ঊহ্য থাকে। আবার প্রশংসার ছলে বলাও হয়, “হাতটি তাঁর পুরুষালি।”
চারজন রাগী যুবতী পড়তে পড়তে মনে হয়, এই যে অদৃশ্য পাঠকের প্রতি দ্বিতীয় পুরুষের বাচনভঙ্গির নির্মাণ শৈলী, এ কী ভীষণ গতিময়। সতেরো-আঠেরো বছর বয়সের চারটি মেয়ের চোখ দিয়ে দেখানো কলকাতা, নতুন করে ষাট-সত্তর দশকের উঠে আসা বিপণনধর্মী, উপভোক্তা-ভোলানো লাবণ্য-রং-ঢং, পার্ক স্ট্রিটের বড়দিনের আলো থেকে অভিজাত রেস্তরাঁর নরম গালিচার মোহ। এই ক্যালাইডোস্কোপিক দৃষ্টির চূড়ান্ত বৈপরীত্যে অবিশ্বাস সন্দেহ যৌন আক্রমণ এমনকি নকশাল আন্দোলনের বাত্যাবিক্ষুব্ধতা, যার আবহ রচনা করে শীতের ময়দানের ঝুপুস করে নেমে আসা প্রচণ্ড ভয়াবহ অন্ধকার। এমন এক অন্তর্বয়ন এ উপন্যাসকে সমৃদ্ধ করেছে। সমসময়কে এই নারীর অভ্যন্তরীণ চশমা দিয়ে কবিতা সিংহের মতো করে সম্ভবত আর কেউই দেখেননি।
কিন্তু কেবল লিঙ্গের চশমা দিয়ে দেখার কথা নয়। কথাসাহিত্যিক হিসাবে বিবরণে, আখ্যানে তুখোড় কবিতা সিংহ। জমিদারদের বিশাল বাড়ি ভেঙে ভেঙে পড়ে একটা গোটা বিশাল বাড়িই দক্ষিণ কলকাতার একটা পাড়া হয়ে যাওয়া— এই তথ্য-বিবরণ যে মুনশিয়ানায় পেশ করা হয়, তা অনন্য, স্মরণীয়। চিরচেনা কলকাতার একটা অঞ্চলের জীবন্ত হয়ে উঠে আসার নমুনা পেশ করেন কবিতা, সিনেমার ক্যামেরার গতিপথের ভঙ্গিমায়। মধ্যে মধ্যে গুঁজে দেওয়া সপাট অ্যাজেন্ডা-কথন।
কবিতা সিংহের উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মেয়েরা। মেয়েদের ভিতর দিক থেকে দেখানোতেই তাঁর নিজস্ব আগ্রহ। আর এই মেয়েদের অধিকাংশ হয় চাকুরে, লড়াকু, এবং একাকী। সম্পর্কচ্যুত অথবা সম্পর্কে ব্যথা পেয়েছে। আশ্চর্য ভাবে একটা শিক্ষিত আভিজাত্য ঝরতে থাকে, ঝরতেই থাকে এই চরিত্রগুলি থেকে। তাদের সবচেয়ে নিচু, সঙ্কীর্ণ, বাস্তব ও নৃশংস জীবনমুহূর্তেও তাদের অভিজাত লাগে। যেমন সরমা-র সুরমা, যে নাকি দেবীপ্রতিমার মতো। বয়সহীন দেবীপ্রতিমা। এই কাহিনি রহস্যকাহিনির ঢঙে লিখিত হলেও, বস্তুত দুই পুরুষ ও এক নারীর জটিল আখ্যান। খুনের সংখ্যা এক উপন্যাসের ভিত্তি পাপবোধের অনুভূতি। আবার এখানেও সেই রহস্য উপন্যাসের কথনশৈলী। রাত্রি ছিল পিশাচের অন্য ধারায় চলে। এখানে আছে পূর্বনারীদের মাতৃতান্ত্রিক ঋণস্বীকার কিন্তু প্রেত আবাহনের ঘেরাটোপ।
কবিতার গদ্য থেকে স্পষ্ট যে, তিনি সরল, প্রায় চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যের মতো মর্মভেদী কিন্তু দৃশ্যে দৃশ্যে উন্মোচিত কাহিনি লিখতে চাইতেন, পাঠকের ভিতরে যা সহজে প্রবেশ করে, কোনও আড়াল রাখে না। অযাচিত উপদেশ দান, লেখকের নিজের কণ্ঠস্বরের অনুপ্রবেশ কোনওটাই তাঁর অভিপ্রেত ছিল না। এবং মূলধারার লেখাই তাঁর অভিপ্রেত, যেখানে সমসময়ের বিজ্ঞাপন জগৎ, সিনেমার জগৎ, বিনোদন, বাজার অর্থনীতি কোনওটাই অপাঙ্ক্তেয় হয় না। বিখ্যাত সংস্থার জুতোর বিজ্ঞাপনের কপি লিখেছিলেন কবিতা পেশাদারিত্বের সঙ্গে, রেডিয়োর জন্য জিঙ্গলও। মেয়েদের পোশাক গয়নার খুঁটিনাটি বিবরণে তিনি সিদ্ধহস্ত। ডিটেলিং তাঁর আশ্চর্য ক্ষমতা, আর এক নিজস্বতা হল প্লট স্ট্রাকচারের কাঠিন্যহীন গড়গড় করে চলা এক ধরনের জৈব প্রক্রিয়ার কাহিনি। বাংলার মেয়েদের দেওয়া আলপনার মতো, বা বেড়ার উপর ফলিয়ে ওঠা লতাগাছের মতো দূরে দূরে ছড়িয়ে যেতে থাকা বিবরণ। এই পদ্ধতি খুব সিদ্ধি না থাকলে লেখক ভাল ভাবে ব্যবহার করে উঠতে পারেন না। কবিতা সিংহ বাংলা সাহিত্যের সহজসুন্দরী, কি কবিতা কি গদ্যে তাঁর কলম স্বতঃস্ফূর্ত।
কবিতা সিংহ: উপন্যাস সমগ্র
(২য় খণ্ড)
সম্পা: সুমিত বড়ুয়া
৫৫০.০০
এবং মুশায়েরা
নায়িকা প্রতিনায়িকা উপন্যাসের কেন্দ্রীয় বিষয় প্রেম ও বিয়ে। এই দ্বৈততাই নব্বই দশকের দিকে আস্তে আস্তে ভেঙে চুরচুর হয়ে গিয়েছে বাঙালির মূল্যবোধে। তাই কেন্দ্রটি খানিকটা নড়বড়ে লাগে। কিন্তু আবার সেই ডিটেলিং-এর গুণে, লাবণ্য নামে মেয়েটির হস্টেলবাসের বিবরণ ছুঁয়ে দেখা যায়। লাবণ্য, যার পরিচয় আড়াল থেকে একেবারে শেষে উন্মুক্ত হবে বলেই রহস্যকাহিনির ঢঙে এগোয় কাহিনিটি। বারে বারে টুপি খুলে অভিবাদন জানাতে হয় কৈশোরের নিষ্ঠুরতার বিশদ বর্ণনার জন্য, বা বৃষ্টির দিনে টানা বারান্দার এক প্রান্তে একটি জবুথবু গরিব মেয়ের এসে দাঁড়ানোর ছবিটি রচনার জন্য। গদ্যের ভিতরে উপমার কুশলী চোরাটানগুলি আলাদা করে বলার। মানুষের চুমুর মতো শব্দ করে পায়রাদের বকম বকম করে যাওয়া দীর্ঘ দুপুর, রোদ্দুরের কারিকুরি, উলের বোনা খুলে ফেলে কোঁকড়ানো উল কোলে বসে থাকা প্রৌঢ়ার বর্ণনা, কবিতা সিংহকে ‘কবি’ হিসাবে বারে বারে চিনিয়ে দেয়। জীবনানন্দের মতোই তাঁর ক্ষেত্রেও বুঝি এই উপন্যাসগুলি কবিতা লেখার প্রস্তুতিপর্ব বা নোট নেওয়ার খাতা।
প্রকাশককে ধন্যবাদ এই সুবিশাল কর্মকাণ্ডটি হাতে নেওয়ার জন্য। কিন্তু দু’-একটি কথা না বললেই নয়। দ্বিতীয় খণ্ড পড়তে পড়তে প্রথম খণ্ডের কথা মনে পড়ে যাওয়া, বা প্রথম খণ্ডের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়ার ভাবনা খুব অপ্রত্যাশিত নয় নিশ্চয়ই। অথচ দুই খণ্ড সম্পাদনা করেছেন দু’জন আলাদা মানুষ। দ্বিতীয় খণ্ডে প্রতিটি উপন্যাসের সাল-তারিখ দিয়ে শেষে যে অংশ যোগ করা হয়েছে তা চমৎকার, কিন্তু উপন্যাসগুলি গ্রন্থাকারে বেরোনোর আগে সেগুলি কোন পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছিল তার হদিস নেই, প্রথম খণ্ডে সম্পাদকের কথায় তা ছিল। প্রথম খণ্ডে কবিতা সিংহের কলমে পেয়েছি আমরা বেশ কয়েকটি উপন্যাস যার প্রায় প্রতিটিই অধুনা আলাদা ভাবে দুষ্প্রাপ্য। কিন্তু সেই উপন্যাসগুলির ভিতরে ১৯৬২-তে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস সোনারুপোর কাঠি যেমন আছে, তেমন অষ্টম উপন্যাস পতনের বিরুদ্ধে-ও (১৯৭৮) আছে। এই দ্বিতীয় খণ্ডে এল সরমা (১৯৬৭), খুনের সংখ্যা এক (১৯৭০), চারজন রাগী যুবতী (১৯৭৩), নায়িকা-প্রতিনায়িকা (১৯৮০), রাত্রি ছিল পিশাচের (১৯৮০)। অর্থাৎ উপন্যাস সমগ্রের খণ্ডগুলি কালক্রমানুসারে সাজানো নয়। এটা এই সমগ্রের একটা অন্যতম সমস্যা। এবং এই দুই খণ্ডের মধ্যে এখনও পৌরুষ উপন্যাসটির দেখা পাওয়া যায়নি কেন, তাও বোঝা যাচ্ছে না। হয়তো তৃতীয় খণ্ডে যাবে। হারিয়ে যাওয়া ও অগ্রন্থিত সব ক’টি উপন্যাসই দু’মলাটে আসুক।
বানানবিধি মেনে পুরনো বানান পরিবর্তনের সমস্যার কথা সম্পাদক লিখেছেন। কিন্তু এই গ্রন্থে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে: সব ‘কি’ কে ‘কী’ দিয়ে প্রতিস্থাপনের কম্পিউটার-কৃত কাণ্ড ঘটানোর ফলে, কিনা, কিবা, কিসে, কিছু, এই শব্দগুলি হয়ে দাঁড়িয়েছে কীনা কীবা কীসে কীছু। প্রচুর মুদ্রণপ্রমাদ থাকায় অনেক বাক্যের অর্থ বুঝতে ধন্দ তৈরি হয়।
যশোধরা রায়চৌধুরী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy