Advertisement
১৯ ডিসেম্বর ২০২৪
book review

তাঁর লেখায় লুকিয়ে থাকত গল্প

প্রকাশিত রচনার অধিকাংশ প্রসাদগুণে পূর্ণ হলেও কয়েকটি লেখায় স্মৃতিকাতরতার আধিক্য চোখে পড়ে।

সুশোভন অধিকারী
শেষ আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০২২ ০৯:৩৩
Share: Save:

তাঁর কাজ আর ভাবনার বিচিত্র বিস্তার নিয়ে নতুন করে কিছু বলার প্রয়োজন পড়ে না। যদিও তাঁর নিজের ভাষায় ‘গান আর গ্রাম’ই হল অনুসন্ধানের প্রধান ভরকেন্দ্র। কোন আশ্চর্য ম্যাজিকে সুধীর চক্রবর্তীর (ছবি) কলম প্রবীণ থেকে তরুণ সবার কাছে সমান আকর্ষণীয়, ভাবতে অবাক লাগে। সরস রম্যরচনাগুলির কথা সরিয়ে রেখেও বলতে হয়, গবেষণাধর্মী লেখার এমন স্বাদু পাঠ সহসা নজরে পড়ে না। শুধু কি তা-ই? সম্পাদক সুধীর চক্রবর্তী এক স্বতন্ত্র নজির, দক্ষ সংগঠক হিসাবেও তাঁর ভূমিকা স্মরণীয়। অন্য দিকে তাঁর মতো সুবক্তাও বোধ করি সহজে পাওয়া যাবে না। যে কোনও সভায় তাঁর বক্তৃতা শেষে মুগ্ধতার রেশ রয়ে যেত দীর্ঘ ক্ষণ। ঝকঝকে বক্তব্যের পাশাপাশি দীপ্র উপস্থিতির অমোঘ টান, বিশেষত রবীন্দ্রনাথ ও সমসাময়িক বাংলা গানের আলোচনা যে কত উপভোগ্য হতে পারে, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছাড়া উপলব্ধি করা শক্ত। রীতিমতো সুকণ্ঠের অধিকারী ছিলেন তিনি, সঙ্গীতের পাঠ নিয়েছিলেন গোবিন্দগোপাল মুখোপাধ্যায়ের কাছে। বক্তৃতার আসরে আলোচনার ফাঁকে উদাহরণ হিসেবে গান গেয়ে বোঝাতেন, সভা অন্য মাত্রা স্পর্শ করত। তাঁর মতো চিন্তকের অভাবে লোকসংস্কৃতি তথা ক্ষেত্রসন্ধানী সাহিত্য গবেষণার সামগ্রিক প্রেক্ষাপটটি বিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত, স্বীকার করতেই হবে।

সুধীর চক্রবর্তী: ধেয়ানে আলোকরেখা

সুধীর চক্রবর্তী স্মারকগ্রন্থ

সম্পা: রামকৃষ্ণ দে

৬০০.০০

শ্রীরামকৃষ্ণ পাঠাগার, কৃষ্ণনগর

সুধীরবাবুর চরিত্রের আর একটি দিক, নিজের দেশ-গাঁয়ের চার পাশের মানুষের প্রতি নিখাদ ভালবাসা। সবার সঙ্গে অনায়াস মিশে যাওয়ার এমন গুণ সহজে মেলে না। সেই কারণে কেবল কৃষ্ণনগর কলেজের বিশিষ্ট অধ্যাপক হিসাবে নয়, এক জন অনুভূতিশীল ‘কৃষ্ণনাগরিক’-এর মতো তিনি হয়ে উঠেছিলেন শহরের সাহিত্য-সংস্কৃতির অভিভাবক। যে উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে আজীবন গভীর ভাবে জড়িয়ে ছিলেন, কৃষ্ণনগরের শ্রীরামকৃষ্ণ পাঠাগার তার অন্যতম। উল্লেখ করা প্রয়োজন, আশি বছর অতিক্রান্ত এই পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কবি ও দেশব্রতী বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়। আলোচ্য বইটি সেখান থেকেই প্রকাশিত। প্রায় তিনশো আশি পৃষ্ঠা সম্বলিত গ্রন্থে সূচিপত্র অংশে বিভাগ-বিন্যাস নজরকাড়া, প্রতিষ্ঠানের প্রসঙ্গ, সম্পাদকীয় কথন ও তার পর সুধীরবাবুর ব্যক্তিত্বের বিভিন্ন দিক ছুঁয়ে যাওয়ার প্রয়াস রয়েছে এখানে। সূচিপত্রে মুদ্রিত বিভাগীয় শিরোনামগুলি যথাক্রমে— স্মৃতিচারণ, পারিবারিক, শিক্ষক, ক্ষেত্রসমীক্ষা, অবতল, গদ্যশৈলী, শব্দচয়ন, আখ্যান, কবিতাভাবনা, সম্পাদক, ধ্রুবপদ, পত্র-পত্রিকা, গানে গানে, বাগ্মী ইত্যাদি। রয়েছে আরও অনেক বিষয়— শিল্পভাবনা, সাক্ষাৎকার, এ ছাড়া সুধীরবাবুর জীবনপঞ্জি, গ্রন্থপঞ্জি এবং বংশলতিকার শেষে ‘নানামনে’ শীর্ষক বিভাগে রাখা হয়েছে এক গুচ্ছ সংক্ষিপ্ত অথচ জরুরি স্মৃতিচারণ; পরিশিষ্ট অংশে লেখক পরিচিতি ইত্যাদি।

বিষয়ের শিরোনাম এবং লেখক তালিকার দিকে নজর দিলে স্মারকগ্রন্থটির নির্মাণ সম্পর্কে সম্যক ধারণা হয়। লেখক তালিকায় রয়েছেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধায়, পবিত্র সরকার, ল্যাডলী মুখোপাধ্যায়, দেবদাস আচার্য, দেবাশিস ভৌমিক, স্বপ্নময় চক্রবর্তী, রুশতী সেন, আনসারউদ্দিন, প্রাণেশ সরকার, স্বপন সোম, তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়, সুমন ভট্টাচার্য, সৈকত মুখোপাধ্যায়, কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্ত, রামকৃষ্ণ দে, সৈকত কুণ্ডু, শিবশংকর পাল-সহ প্রবীণ-নবীন ও স্ব-স্ব ক্ষেত্রে কৃতী বিশিষ্টজন। গ্রন্থের ‘পারিবারিক’ অংশে মুদ্রিত লেখা দু’টির কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করতে হয়, যেখানে সুধীর চক্রবর্তীর সহাস্য মুখমণ্ডলের আড়ালে তাঁর ব্যক্তিজীবনের গভীর মর্মবেদনার সূক্ষ্ম আঁচড় চকিতে ফুটে উঠেছে। সুধীরবাবুর সাক্ষাৎকার গ্রহণের অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন দীপাঞ্জন দে। এ ছাড়া আরও দু’টি জরুরি বিষয়, গ্রন্থপঞ্জি ও বংশলতিকা প্রসঙ্গে আলোকপাত করেছেন অভিরূপ মুখোপাধ্যায় এবং দীপ্ত গঙ্গোপাধ্যায়। সব মিলিয়ে সুদৃশ্য এই স্মারকগ্রন্থে লেখক অধ্যাপক ও গবেষক সুধীর চক্রবর্তীর বহুধা ব্যক্তিত্বের বিচিত্র দিকে আলো ফেলার চেষ্টা হয়েছে।

এই প্রয়াস নিঃসন্দেহে সফলও। বিষয়গত ভাবে খেয়াল করে দেখলে, সুধীরবাবুর সামগ্রিক সাহিত্যজীবনের দিকে পাঠককে পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন পবিত্র সরকার, লেখাটি গ্রন্থের অন্যতম উল্লেখযোগ্য আলোচনা। সুধীরবাবুর গবেষণা ও অনুসন্ধানের স্বতন্ত্র অভিমুখটি পরিস্ফুট হয়েছে এই লেখায়। সে কথা বলতে গিয়ে আলোচক লিখেছেন— “তাঁর গবেষণা এবং অনুসন্ধানের বিষয়ও সাধারণ আর চেনা ছকের ছিল না। বাংলা সাহিত্যের এমএ, কাজেই অনেকের মতোই তিনি ‘আরামকেদারার গবেষণা’ করবেন, অর্থাৎ ‘মঙ্গলকাব্যের স্ত্রীচরিত্র’ বা ‘বাংলা উপন্যাসে নাগরিক জীবন/ পল্লী-জীবন’ জাতীয় বিষয় বেছে নেবেন, ঘরে বা বড় জোর লাইব্রেরিতে গিয়ে বইপত্র পড়ে অভিসন্দর্ভ লিখবেন এবং ডিগ্রির জন্য পেশ করবেন— এই সহজ রাস্তাও তিনি বর্জন করলেন। এই পথে-বেরিয়ে-পড়া লোকসাহিত্যের গবেষণায় তাঁর নাম সর্বাগ্রে উচ্চারিত হবে’। অধ্যাপক সরকার যথার্থ বলেছেন, “সুধীরদার এসব লেখা নিছক থিসিসের শুষ্ক গবেষণা নয়।” শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় লিখেছেন ব্যক্তি সুধীর চক্রবর্তীর রসময়তা নিয়ে, তিনি “আপাতগম্ভীর কিন্তু ভিতর যেন মধুভাণ্ড, মৌচাক...।” সেই সরসতা পরিবাহিত হত তাঁর কলমেও, ‘আখ্যান’ অংশে যেমন ‘গল্পময় সুধীর চক্রবর্তী’ শিরোনামে স্বপ্নময় চক্রবর্তীর লেখায় আলোচিত হয়েছে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত গ্রন্থের সঙ্গে সুধীরবাবুর রচনার সাদৃশ্য। তিনি লিখেছেন, “রামকৃষ্ণ কথামৃত-এর ভিতরে লক্ষ করে দেখেছি অনেক ছোটগল্প লুকোনো আছে। শ্রীরামকৃষ্ণের উপদেশের মধ্যে থাকত সামাজিক আখ্যানাবলি। লোকাশ্রিত শ্রুতিগল্প। সুধীর চক্রবর্তীর প্রসঙ্গগুলির মধ্যেও এরকম গল্প থাকে।” এই সূত্রে তিনি সদর-মফস্বল এবং নির্বাস নামের বই দু’টির কথা সবিশেষ উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, “এদুটি গ্রন্থের সব লেখাই গল্পময়। উনি যেন পাঠকের সঙ্গে গল্প করতেই বসেছেন।” আলোচকের মতে এ কথা চালচিত্রের চিত্রলেখা বা পঞ্চগ্রামের কড়চা-র ক্ষেত্রেও সমান প্রযোজ্য। তমাল বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর গদ্যরীতির অনন্যতা প্রসঙ্গে জানিয়েছেন— “সুধীর চক্রবর্তীর গদ্যের ফর্মটিকে সাধারণভাবে বলা যায় ‘কথা’। গল্প-উপন্যাস লিখনের প্রচলিত যে ‘কলোনিয়াল’ বা ঔপনিবেশিক স্টাইল, যেখানে লিখিত টেক্সটটির সুনির্দিষ্ট একটি সূচনা, একটি মধ্যভাগ ও একটি শেষ থাকে, সেই শৈলীটিকে সচেতনভাবেই বর্জন করেছিলেন সুধীরবাবু, তাঁর লেখায়। তার বিকল্প হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন লোকায়ত, দেশজ, সহজিয়া এক ঢং; অশোক সেন যাকে বলেছেন ‘অন্য গদ্য’।” বারোমাস পত্রিকায় প্রকাশিত সুধীর চক্রবর্তীর লেখাগুলির তালিকা সযত্নে তৈরি করে দিয়েছেন রুশতী সেন, অতি জরুরি কাজ। ‘বাংলা গানের একনিষ্ঠ সন্ধানী’ শীর্ষক নিবন্ধে স্বপন সোম আলোকপাত করেছেন সুধীরবাবুর সঙ্গীত সন্ধানের দিকটিতে। বিশেষত রবীন্দ্রনাথ এবং দ্বিজেন্দ্রলাল-সহ রজনীকান্ত ও অতুলপ্রসাদ ঘিরে সেই সাঙ্গীতিক পরিসরটি এখানে আলোচিত।

প্রকাশিত রচনার অধিকাংশ প্রসাদগুণে পূর্ণ হলেও কয়েকটি লেখায় স্মৃতিকাতরতার আধিক্য চোখে পড়ে। তবে প্রচ্ছদে অঙ্কিত সুধীরবাবুর প্রতিকৃতি-সহ বইয়ের সার্বিক অলঙ্করণে বেশ পরিশীলিত রুচি ফুটে উঠেছে। ছাপা ও বাঁধাই ইত্যাদি দিকেও যত্নের ছাপ স্পষ্ট। তবু মনে হয়, বইয়ের লেখক-তালিকায় আরও কয়েকটি নাম সংযুক্ত হলে গ্রন্থটি সমৃদ্ধ হত আরও— শক্তিনাথ ঝা, আবুল বাশার, জয় গোস্বামী বা সুবোধ সরকার। আবার ধ্রুবপদ পত্রিকা প্রকাশের সার্বিক পরিপ্রেক্ষিতটি মাথায় রেখে সুধীরবাবুর নিজস্ব শিল্পভাবনার দিকে প্রকৃত আলো ফেলতে পারতেন সোমনাথ ঘোষ, অনুপস্থিত তিনিও। তাই বলতেই হয়, মনের মধ্যে কোথাও যেন একটু বিষাদ রয়েই গেল।

অন্য বিষয়গুলি:

book review editorial
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy