—প্রতীকী চিত্র।
ক্যানসার নিয়ে লোকসমাজে অবিরাম আলাপ-বিলাপ, বিজ্ঞানীদের কাছে আজও সে যেন এক বিপন্ন বিস্ময়, অথচ এমন একটা বিষয়ে বাংলার মতো সমৃদ্ধ ভাষায় আলোচনার সম্ভার নেই। ক্যানসার এক জটিল ব্যাধিসমষ্টি, বিচিত্র তার রূপ ও পরিচয়। সামাজিক, মানসিক, পারিবারিক, আর্থ-রাজনীতিক প্রেক্ষাপট তাতে নতুন মাত্রা যোগ করে। ভুক্তভোগীর সজল বালিশ শুকোতে চায় না। এমন দুর্মর সমস্যাসঙ্কুল পরিবেশে কী ভাবে ক্যানসারকে যাপন করে নেওয়া যায়, সেটাই সম্প্রতি প্রকাশিত ক্যানসার যাপন বইটির উপজীব্য।
ক্যানসারের সঙ্গে জড়িত সমস্যাগুলি বিতর্কিত, বিভ্রান্তিকর, সমাধানও অনিশ্চিত। লেখিকা যথার্থ বলেছেন, ক্যানসারকে শুধু একটা ‘অসুখ’ না, বরং এক বিপুল ‘মানবিক’ সঙ্কট হিসাবে বিবেচনা করা উচিত। কিন্তু তা নিয়ে আলোচনা করা দুরূহ। লেখিকা সেই দুরূহ কাজে হাত দিয়েছেন, অথচ তাঁর লেখনীতে অহমিকার লেশমাত্র নেই। ‘চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিন্দুবিসর্গ জানি না’, স্বাস্থ্য-সাংবাদিকতায় এমন বিনম্র স্বীকারোক্তি দুর্লভ। নির্ভার বাচনভঙ্গির স্বচ্ছন্দ চলনে সজাগ সংযম, যেন ‘ধীরে যায় ফিরে ফিরে চায়’! সঙ্কট নিরসনে তাঁর চিরায়ত পরামর্শগুলো পাঠককে সমৃদ্ধ করতে পারে। তবে ‘যোগা’ শব্দটি এমন সাবলীল বাংলা রচনায় বোধ হয় পরিহারযোগ্য।
ক্যানসার যাপন: ভাবনায় নয়, ভরসায় বাঁচার পাঠ
সোমা মুখোপাধ্যায়
৪৫০.০০
আনন্দ
এই অপৃথুল রচনার পরতে পরতে সাজানো ক্যানসারগ্রস্ত মানুষ আর বিপর্যস্ত পরিবারের মনের কথা। লেখিকা সেই অভিজ্ঞতাগুলো নিয়ে হাজির হন পাঠকের দোরে, অসহায় মানুষের প্রশ্ন শোনেন, উত্তর খোঁজেন চিকিৎসকদের কাছে। মানুষ মরণশীল, কিন্তু সে যেন অপমরণশীল না হয়, এই দুশ্চিন্তাই তাঁকে পীড়িত করে। সেই কাতরতা থেকে তিনি ক্যানসারের আধুনিক চিকিৎসার কথা বলেন, কিন্তু অগোছালো স্বাস্থ্য পরিষেবা, ‘নৈর্ব্যক্তিক হৃদয়শূন্যতা’ আর রোগীর মর্যাদাহানির যন্ত্রণা তাঁকে বিহ্বল করে। মানবিকতা এই রচনায় মূর্ত হয়ে ওঠে।
ক্যানসারের বনিয়াদি পরিচয়টি জৈবিক— দেহপ্রকৃতির অলঙ্ঘ্য ব্যত্যয়। ‘ক্যানসার যে কোনও সময়, যে কারও হতে পারে’, এখানে ‘শিক্ষিত-অশিক্ষিত বা সচেতন-অসচেতনের প্রশ্ন’ নেই, এই কথাগুলো ক্যানসারের জৈবিক পরিচয়কেই তুলে ধরে। ‘ক্যানসারের কোনও নির্দিষ্ট নিয়ম নেই’, ‘নির্দিষ্ট কোনও কারণ থাকে না’, ‘প্রত্যেকটি ক্যানসারের চরিত্র আলাদা’, এই অবিমিশ্র সত্যকথনও অধুনা বিরল। আজকাল যাঁরা ক্যানসার নিয়ে লোকসমাজে ‘সচেতনতা’ বিলি করতে উদ্গ্রীব তাঁদের শিক্ষণীয়, কী ভাবে সহজ ভাষায় নির্মম সত্যি কথাগুলো বলতে হয়।
আধুনিক চিকিৎসার সঙ্গে রাহুগ্রস্ত, বিকৃত অর্থনীতির অশালীন বন্ধনের কথা লেখিকা গোপন করেননি। অপর একটি সুরের গুঞ্জনও কানে আসে— আধুনিক ক্যানসার চিকিৎসায় বৈচিত্রের জৌলুস আছে, কিন্তু আমাদের ‘হৃদয়হরণ সাধ’, সেই সার্থকতা অধরা। ক্যানসারের ‘নিরাময়’ চিকিৎসার চেয়ে ‘উপশম’ চিকিৎসাই যে অনেক বেশি জরুরি, ক্যানসারের ‘আতঙ্ক’ যে ‘একটু একটু করে চারিয়ে দেওয়া হয়েছে আমাদের মধ্যে’, এই অনাবিল সত্যি কথাগুলোও তিনি নিঃসংশয়ে এবং নির্দ্বিধায় পাঠকের সামনে নিয়ে আসেন।
আর শুধু একটি কথায় শুনিয়ে রাখেন হাজার কথার প্রতিধ্বনি — ‘ক্যানসার… এক কল্প-শয়তান’। এই অমোঘ উচ্চারণেই হয়তো ক্যানসার নিয়ে লোকায়ত বাংলায় লেখা অঙ্গুলিমেয় বইপত্রের মধ্যে ক্যানসার যাপন পাঠকের আদরণীয় হয়ে উঠবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy