বাস্তুহারা: দণ্ডকারণ্যে পূর্ববঙ্গের শরণার্থীরা। ষাটের দশকের ছবি
আজ যখন ১৯৪৭ সালের পঁচাত্তর বছর উপলক্ষে সাধারণ মানুষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দেশভাগ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক, আবেগ, অনুসন্ধান, তরজা বা উদ্যাপনের শেষ নেই, দেশভাগ সম্পর্কিত গবেষণার ক্ষেত্রে এই বছরেই যোগ হল এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। কেন গুরুত্বপূর্ণ? দেশভাগের পর পঞ্জাব ও বাংলায় বাস্তুচ্যুত মানুষদের অভিপ্রয়াণকে মূল বিষয় করে প্রকাশিত বই, নিবন্ধ এবং আত্মজীবনীমূলক লেখার সংখ্যা মোটেই কম নয়। কিন্তু সে সব লেখায় সাধারণত গুরুত্ব পায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের তৈরি ‘গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ’, ‘উচ্চ রাজনীতি’র তত্ত্ব, কিংবা অন্য দিকে, বাস্তুচ্যুতির পরবর্তী ‘ট্রমা’ বা সংবেদনশীলতা। সেই পটভূমিতে শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অনসূয়া বসু রায়চৌধুরীর গবেষণাগ্রন্থটি দেশভাগ-উত্তর সময়ে বাংলায় ‘জাতি’কে একটি বিশ্লেষণমূলক বিভাগ হিসাবে উপস্থাপন করেছেন। বইটি শুরু হয়েছে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন দিয়ে— বিভিন্ন ধর্মকে সমজাতীয় একক হিসাবে শ্রেণিবদ্ধ করে, তার মধ্যে বর্ণ, শ্রেণি বা লিঙ্গের অন্তর্নিহিত পার্থক্যকে উপেক্ষা করার যে প্রবণতা সমাজবিজ্ঞানীদের আছে— তার প্রতিই নিক্ষিপ্ত সে প্রশ্ন।
বইটির বিশেষত্ব, দলিত উদ্বাস্তুদের পশ্চিমবঙ্গ ও অন্যান্য রাজ্যে অভিবাসন এবং পুনর্বাসনের ইতিহাসের উপর জোর দিয়ে তা দেশভাগের ইতিহাস এবং দলিত আন্দোলনের ইতিহাসকে সফল ভাবে সংযুক্ত করতে পেরেছে। বর্ণ প্রশ্ন ও ‘দলিত উদ্বাস্তু’দের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে, দেশভাগের মূলধারার ইতিহাস থেকে এই প্রশ্নটির অন্তর্ধানের কারণ অনুসন্ধান করেন লেখকরা।
ভূমিকা এবং উপসংহার-সহ মোট পাঁচটি অধ্যায়ে বিভক্ত এই গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে দলিত উদ্বাস্তু সম্প্রদায়ের স্বদেশ থেকে বাস্তুচ্যুত হওয়ার পর তাদের সংগ্রামের বৃত্তান্ত। দুই লেখক এই সত্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন যে, বাংলার দলিতরা বিভাজনের রাজনীতি ও হিংসার ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় দর্শক ছিল না। বরং উদ্বাস্তু-শিবিরে দলিত নেতা এবং মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক নেতাদের মধ্যে তৈরি হওয়া আদর্শগত পার্থক্যগুলির মাধ্যমে লেখকরা দেখানোর চেষ্টা করেছেন, কী ভাবে বিভাজনের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের ফলে দলিত আন্দোলনের ঐক্য নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তী কালে বৃহত্তর উদ্বাস্তু ঐক্যের স্বার্থে জাতপাতের প্রশ্নকে যখন অবদমন করার চেষ্টা করা হয়, তত দিনে বাংলায় দলিত আন্দোলনের চরিত্র নষ্ট হয়ে গিয়েছে প্রায়।
কাস্ট অ্যান্ড পার্টিশন ইন বেঙ্গল: দ্য স্টোরি অব দলিত রিফিউজিস, ১৯৪৬-১৯৬১
শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অনসূয়া বসু রায়চৌধুরী
১৪৯৫.০০
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস
সূচনা অধ্যায়ে বাংলায় দেশভাগ এবং উদ্বাস্তু সম্পর্কিত প্রায় সব গ্রন্থ, সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করে গবেষণার ফাঁকফোকরগুলো ভরাট করার চেষ্টা করা হয়েছে, যা এই বইয়ের বড় এক সম্পদ। লেখকরা সংশোধনবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ করেননি, বরং পূর্ববর্তী গবেষকদের তাত্ত্বিক অন্তর্দৃষ্টি এবং অভিজ্ঞতামূলক তথ্য ব্যবহার করেছেন। ‘কাস্ট অ্যান্ড পার্টিশন’ শিরোনামের প্রথম অধ্যায়টি ১৯৪৭ সালের দেশভাগের প্রাক্কালে দলিত পরিচয়ের প্রশ্নকে বিশ্লেষণ করে। কী ভাবে নিম্নবর্গীয় অস্তিত্ব, ধর্মীয় বিশ্বাস, আত্মপরিচয়ের অনুভূতি, বাসভূমি সম্পর্কে ধারণা, রাজনৈতিক সংহতি ইত্যাদির মতো অসংখ্য কারণের একটি জটিল মিথস্ক্রিয়ার ফলাফল হয়ে ওঠে দলিত রাজনীতি— তার আখ্যান মেলে এখানে। স্বভাবতই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল বা পি আর ঠাকুরের মতো নেতাদের ভূমিকাও। দ্বিতীয় অধ্যায় ‘দ্য গ্রেট এক্সোডাস’-এ ‘অর্থনৈতিক অভিবাসন’-এর সরকারি তত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ করে দেখানো হয়েছে যে, অভিবাসী দলিত কৃষকরা তাঁদের নিম্ন সামাজিক অবস্থান ও ক্রমাগত সহিংসতার পরিস্থিতির দ্বারা সৃষ্ট নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি দ্বারাই চালিত হয়েছিলেন, অর্থনৈতিক কারণে নয়। লেখকদের মতে, ১৯৫০ সালের দিল্লি চুক্তির পর নেহরুর অনুমান ছিল, অভিবাসন বন্ধ হলে সাম্প্রদায়িক হিংসা রোধ করা যাবে। কিন্তু তাঁর ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। দিল্লি চুক্তি ব্যর্থ হয়।
তৃতীয় অধ্যায় ‘ক্যাম্পস অ্যান্ড বর্ডারল্যান্ডস’-এ দলিত শরণার্থী শিবিরগুলো কী ভাবে মূলস্রোতের রাজনীতির অংশ হিসেবে, বাস্তুহারা সমিতির মাধ্যমে নিজেদের সংগঠিত করে, সে সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। যে সব দলিত উদ্বাস্তু নদিয়া এবং চব্বিশ পরগনায় পুনর্বাসনের প্রচেষ্টায় বসতি স্থাপন করেছিলেন, তাঁদের সংগ্রামের বর্ণনা করা হয়েছে।
চতুর্থ অধ্যায় ‘স্টেট অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন’ ১৯৫০ সালের পরে আসা দলিত কৃষক উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নীতির বিবর্তন, তাঁদের বাংলার বাইরে বিহার, আন্দামান ও দণ্ডকারণ্যের মতো জায়গায় পুনর্বাসন প্রদানে ভারতরাষ্ট্রের ভূমিকা আলোচনা করে। পঞ্চম অধ্যায় ‘পলিটিক্স অ্যান্ড রেজ়িস্ট্যান্স’, ১৯৫৮ সালের শরণার্থী সত্যাগ্রহের পিছনে রাজনৈতিক দলগুলির ভূমিকা এবং তাঁদের নেতৃত্বের বিভিন্ন স্তরে দ্বন্দ্বের বিশ্লেষণ করে। তাঁদের সত্যাগ্রহ আন্দোলন ছিল মূলত ওড়িশা ও মধ্যপ্রদেশে (বর্তমান ছত্তীসগঢ়) দলিত উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য তৈরি করা দণ্ডকারণ্য প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ প্রচেষ্টা। এই অধ্যায়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা হয়েছে, কেন বাঙালি দলিত উদ্বাস্তুদের দণ্ডকারণ্যে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনও বিকল্প ছিল না।
আসলে ‘জাতি’ এবং ‘বিভাজন’, এই দু’টি বিষয় যেমন এই বইয়ের সব অধ্যায়কে জুড়ে রাখে, ঠিক তেমনই এই দুই ধ্রুবক বইয়ের শিরোনামকেও বিশেষ মান্যতা দেয়। নিম্নবর্গ-নিম্নবর্ণ দলিতদের সামাজিক আন্দোলনের নিজস্ব ধারাগুলি সে সময়ে দেশভাগের রাজনীতি দিয়ে ব্যাহত এবং প্রভাবিত হয়েছিল। মতুয়া মহাসঙ্ঘের উত্থানের সঙ্গে নমশূদ্র জাতি আন্দোলনের যোগ তাই সমাপ্তি অধ্যায়ে এত জরুরি। দণ্ডকারণ্য প্রকল্পের প্রথম অংশ শেষের সময়কাল অনুযায়ী এই বই শেষ হয়েছে ১৯৬১ সালে। কিন্তু বাস্তবে দলিত উদ্বাস্তুদের ‘বাস্তু’ খোঁজার লড়াই ও তাঁদের শুধুমাত্র বেঁচে সংগ্রাম ১৯৬৪ সালের দাঙ্গার পরে বেড়ে যায়, যা চলেছিল ১৯৭৮-৭৯ সালের মরিচঝাঁপি গণহত্যা পর্যন্ত।
সব রকম সম্ভাব্য ইতিহাস লেখার উপাদানকে ব্যবহার করে, একটা জটিল বহুস্তর-বিশিষ্ট ব্যাখ্যাকে সহজ ভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করে— দেশভাগ, অভিবাসন, শিবির জীবন, উদ্বাস্তু প্রতিরোধ, পুনর্বাসনের রাজনীতি এবং সেই রাজনীতিতে জাতি এবং বর্ণের ভূমিকা এই গবেষণার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। লেখকরা যথাযথ যুক্তি দিয়ে দেখানোর চেষ্টা করেছেন, দেশভাগের ফলে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক অবস্থা এবং সামাজিক অবস্থানের সম্মুখীন হয়েছিলেন এই দলিত উদ্বাস্তুরাই। এবং তাঁরা কোনও রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে তাঁদের ন্যায্য প্রাপ্তির কানাকড়িও পাননি।
সুতরাং বইটি বাংলার সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিভাজনকে জাতিগত অস্তিত্বের ইতিহাস বোঝার ক্ষেত্রে যে কত গুরুত্বপূর্ণ, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ ও দলিত ইতিহাসের চরিত্র বুঝতে আগ্রহী গবেষক ও পাঠকদের জন্য এই বই শুধু প্রাসঙ্গিক নয়, অপরিহার্যও বটে। কারণ, খুব সচেতন ভাবে এই বই ১৯৪৭-এর দেশভাগের আলোচনায় ‘জাতি’কে একটি বিতর্কমূলক বিষয় হিসাবে উপস্থাপন করেছে, যার ফলে দলিত এবং উদ্বাস্তু উভয় পরিচয়ের এক সংযুক্তিকরণ চিত্রিত হয়েছে। খুব সহজ ভাষায় দেশভাগের পর কয়েক দশক ধরে বাংলার দলিত উদ্বাস্তুদের বিরুদ্ধে সংগঠিত বৈষম্য ও অবিচারের আখ্যান তুলে ধরেছেন লেখকরা। অন্য দিকে এসেছে দেশভাগ-পরবর্তী সময়ে দলিত উদ্বাস্তুদের প্রতিরোধ ও প্রতিবাদের ধারার আলোচনা। এই মিশেল বইটিকে অনেক রকম পাঠকের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy