অপেক্ষমান: ২০১৮-র পঞ্চায়েত ভোটের লাইনে মেয়েরা। কোচবিহার।
ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির সোনালি আখ্যানটি বাতিস্তম্ভের মতো নিজেদের মাথায় ধারণ করে আছেন মেয়েরা। তাঁরা তাঁত বোনেন, চাষ করেন, বাগদা ধরেন, আনাজ বেচেন, বিড়ি বাঁধেন, কাজ করেন খাদানে, চটকলে, চা-বাগানে বা শহুরে বাবুদের বাড়িতে। কাজের জায়গায় ছেলেদের সমান মজুরি জোটে না মেয়েদের, কর্মক্ষেত্রে তাঁদের সুরক্ষাও অত্যন্ত নড়বড়ে। অতি কষ্টের যে উপার্জন তা-ও অনেক সময়ে চলে যায় অত্যাচারী, মাতাল স্বামীর হাতে। সে কাজও আবার অনেককে ছেড়ে দিতে হয় বাচ্চা হওয়ার পরে। ঘরের কাজ ও ‘চাইল্ডকেয়ার’ এ দেশে এখনও প্রায় পুরোটাই বলতে গেলে মহিলামহলের বিষয়।
সাংবাদিকতার সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতায় শ্রমজীবী এই মেয়েদের খুব কাছ থেকে দেখেছেন স্বাতী ভট্টাচার্য। সাক্ষী থেকেছেন তাঁদের লড়াইয়ের, কষ্ট পেয়েছেন তাঁদের যন্ত্রণায়, অবাক হয়েছেন তাঁদের সাহস, বুদ্ধি আর ঘুরে দাঁড়ানোর জেদ দেখে। গবেষণায় যাকে আমরা বলি ‘ফিল্ডে যাওয়া’, স্বাতীর সে অভিজ্ঞতা বিপুল। চাষের খেতে, নোনা নদীর ধারে, শহরের অবৈধ বস্তিতে বা মেয়ে-শ্রমিকদের মিটিং-এ তাঁর অবাধ বিচরণ। এঁদের লড়াইয়ের প্রতি অগাধ সম্মান থেকেই পত্রপত্রিকায় একের পর এক ক্ষুরধার প্রবন্ধ লিখে গিয়েছেন বহু বছর ধরে, ধারাবাহিক ভাবে।
অথচ সরকার বা নাগরিক সমাজ কী চোখে দেখে এই মেয়েদের? গরিব মেয়েরা ভোটের বাক্সে কোন বোতামটি টিপবেন তার উপরে যে অনেকটাই নির্ভর করে মসনদ দখলের সম্ভাবনা, তা বিলক্ষণ বোঝে রাজনৈতিক দলগুলো। সস্তায়, চটজলদি তাদের মন পেতে তাই ভূরি ভূরি প্রতিশ্রুতিও দিয়ে থাকেন নেতা-মন্ত্রীরা। এ রাজ্যেও রয়েছে কন্যাশ্রী, রূপশ্রী বা লক্ষ্মীর ভান্ডার-এর মতো প্রকল্প।
মেয়েদের ভোট
স্বাতী ভট্টাচার্য
২৫০.০০
অনুষ্টুপ
লেখিকা দেখেছেন, সামান্য সুযোগ পেলেই এই মেয়েরা অনেক কিছু করে ফেলতে পারেন। এই সুযোগটুকু কখনও তৈরি হয় কোনও একক ব্যক্তির উদ্যোগে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাষ্ট্র বা সমাজের দায়বদ্ধতায় নয়। পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হন বহু মেয়ে, একশো দিনের কাজে নিয়মমতো ক্রেশ থাকে না, ‘মাগিকল’ (চটকলের যে সমস্ত বিভাগে শুধু মেয়ে-শ্রমিকেরা কাজ করেন) থেকে নিউজ় রুম— মেয়েদের যৌন হয়রানি অবাধে চলে, সুন্দরবনের নোনা জলে স্ত্রীরোগে আক্রান্ত হয়ে গর্ভাশয় বাদ যায় অজস্র মেয়ের, ফাঁকা সিলিন্ডার ঘরে রেখে দিনে দু’ঘণ্টা ধরে কাঠকুটো কুড়োতে হয় ‘কলকাতার কাঠকুড়ুনি’দের। রাষ্ট্র বা সমাজ সে সব দেখেও দেখে না।
স্বাতী প্রশ্ন করেছেন, এ সব খবরই বা কতটুকু পৌঁছয় নাগরিক সমাজের কানে? সরকারের টাকা, যা কিনা জনগণেরই টাকা, তা কিসে খরচ হবে, সরকারি চাকুরেদের অপ্রাপ্তি মেটাতে না ‘খয়রাতি’র বোঝা টানতে— এই বস্তাপচা বিতর্কেই যেন এখনও মশগুল শহুরে গণমাধ্যম। এককালীন থোক টাকা হাতে পেলে দরিদ্র, প্রান্তিক মানুষের খানিকটা সুবিধা হয় ঠিকই, কিন্তু আধুনিক পৃথিবীতে টিকে থাকতে গেলে শুধুমাত্র সরকারি অনুদানের উপরে ভরসা করা চলে না। নিত্যদিন বাজারের সঙ্গে হরেক রকম লেনদেন চলতে থাকে এই গরিব মেয়েদের। সরকার যদি সেই লেনদেনে তাঁদের পাশে থাকে, দরকার মতো বাজারের শক্তিগুলিকে একটু নিয়ন্ত্রণ করে, তবে আত্মশক্তিতেই ঘুরে দাঁড়াতে পারে মেয়েরা। কেবল হাতে কিছু টাকা দিয়ে সে দায় সেরে ফেলা যায় না।
অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাওয়া, আঠারোর আগেই পড়া ছেড়ে দেওয়া বা কাজের বাজারে মেয়েদের অনুপস্থিতির নিরিখে পিছিয়ে পড়া রাজ্যগুলির তুলনায়ও পিছিয়ে আছে পশ্চিমবঙ্গ। এ নিয়ে প্রাত্যহিক সান্ধ্যকালীন টিভি বিতর্কে ‘তবু আগুন, বেণীমাধব, আগুন জ্বলে কই?’ নাগরিক সমাজ তো মনে করে এই মেয়েরা রাষ্ট্রের বোঝা, বিনা পরিশ্রমে হাত পেতে টাকা নেয়, ভোটের লোভে এদের ঘুষ বা দয়ার দান দিতে গিয়েই সরকারি চাকুরেদের হকের ডিএ মেটাতে পারে না সরকার!
মেয়েরা যখন মেয়েদের কথা লেখেন, সে লেখা আর নৈর্ব্যক্তিক থাকে না। সমস্ত লেখা জুড়েই যেন তৈরি হতে থাকে এক আশ্চর্য কর্মধারায় সমাস— যা ব্যক্তিগত তা-ই রাজনৈতিক। স্বাতী লেখেন, সাংবাদিকতার পেশায় তাঁর কর্মজীবন কেটেছে ‘অপমানের ভয়ে সিঁটিয়ে-থাকা মেয়ে, অপমানকে হেসে উড়িয়ে দেওয়া মেয়ে আর অপমানকে বুকে চেপে গুমরোতে থাকা মেয়ে’ দেখতে দেখতে। তবু তাঁর উপলব্ধি, নানা ভাবে বঞ্চিত আর অপমানিত এই মেয়েদের ভোটই বাংলার রাজনীতিকে বদলে দিয়েছে। তাঁর বিশ্বাস, আর একশো বছরে রামমোহন-রোকেয়ার উত্তরসূরি, আমাদের দৌহিত্রী আর তাদের কন্যাদের কালে আমূল বদলে যাবে সমাজ। রোকেয়ার সুলতানা’স ড্রিম মনে পড়ানো বইয়ের শেষ প্রবন্ধটি যেন সেই এগিয়ে চলার পথের ব্লুপ্রিন্ট। সে পথ কেমন হবে জানতে, মেয়েদের দুঃখ-দুর্দশা, জেদ আর জীবনীশক্তি, অধিকার আর লড়াই নিয়ে ভাবতে চাইলে পড়তেই হবে এই বই। বলিষ্ঠ, প্রত্যয়ী এবং অত্যন্ত সুলিখিত পঁচিশটি প্রবন্ধের এই সঙ্কলনের পরেরসংস্করণে মুদ্রণপ্রমাদগুলি থাকবে না, এই আশা রইল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy