বইটি হাতে নিয়েই একটু মন খারাপ হল। এই বইয়ের তৃতীয় প্রুফ পর্যন্ত দেখে দিয়েছিলেন স্বপন চক্রবর্তী। কিন্তু বইটির প্রকাশ তিনি দেখে যেতে পারেননি। বইটির চরিত্রও এমন নয় যে, লেখকের উপস্থিতি বিস্মৃত হয়ে পাঠক শুধু বিষয়ে মগ্ন হয়ে থাকবেন। এখানে সঙ্কলিত প্রতিটি রচনাই ২০১৭ সালে একটি সংবাদপত্রের সাপ্তাহিক ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হয়। স্বপনের ইচ্ছে ছিল ‘ব্যাপ্তার্থে সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ে নিয়ে কিছু কথা’ বলবেন, ‘তবে পণ্ডিতদের হাটে কেনা উক্তিরাশির কিছুটা পাশ কাটিয়ে’ (সূচনা পৃ ৭)। করেওছেন তাই, পাঠকের সঙ্গে গল্প করার মেজাজে লিখেছেন লেখাগুলো। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের নানান অসঙ্গতি নিয়ে স্বপনের কুশলী পর্যবেক্ষণ বিশ্বসাহিত্যের, কলাবিদ্যার, ভারতীয় ও পাশ্চাত্যের অলঙ্কার ও রসশাস্ত্রের বিভিন্ন মাত্রা অনায়াসে ছুঁয়ে যায়। তাঁর পাণ্ডিত্য বিস্মিত করে, কিন্তু পাণ্ডিত্যের ভারে ঝুঁকে-পড়া কোনও বই নয় এটি।
সমস্ত পাতা জুড়েই যেন পণ্ডিত, রসগ্রাহী, কৌতূহলী, অসাধারণ পর্যবেক্ষণকারী এক মনের সঙ্গে রসিক বাঙালি পাঠকের আড্ডার সমারোহ। আর সর্বোপরি চোখে পড়ে স্বপনের কৌতুকবোধ। তাতে ব্যঙ্গ নেই, সহৃদয়তা আছে। আর আছে একটা সূক্ষ্ম বেদনাবোধ। তা হতাশা নয়। বরং আশাব্যঞ্জকই বলতে হয়। নতুন চলন এসে পুরনো চলনের জায়গা নেয়, আমাদের চাল বদলায়, কিন্তু কোথাও সেই পুরনো চলনেরও একটি ভৌতিক অস্তিত্ব থেকেই যায় আমাদের জীবনে। আজকাল একটা কথা রাজনৈতিক মহলে চালু হয়েছে, ‘পুরনো চাল ভাতে বাড়ে’। স্বপন যেন তাঁর পাণ্ডিত্য ও সাহিত্যবোধকে কাজে লাগিয়ে আমাদের দেখাতে চান যে, সেই পুরনো চাল— যাকে আমরা ভাবি যে আমরা ভুলে গিয়ে বিস্মৃত কোন অতীতে ফেলে এসেছি— তার ভূতুড়ে ম্যাজিক আমাদের জীবনে কী ভাবে কাজ করে।
কেবল একটা কথা মনে রাখতে হয়: স্বপন সাহিত্যের জগতে বিশ্বনাগরিক। কোনও সঙ্কীর্ণ বাঙালিত্বের সন্ধান নেই স্বপনের লেখায়। তাঁর রচনা শেক্সপিয়র, মিলটন থেকে চণ্ডীদাস, চৈতন্যচরিতামৃত— সবই ঘুরে আসে। আর বাঙালির খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন থেকে সাহিত্য বা ছায়াছবিতে রুচি বদল, সবই স্বপন যেন একেবারে পাকা রসপণ্ডিতের ইন্দ্রিয় সব কাজে লাগিয়ে বিচার করেন। কিন্তু পাড়ার আড্ডাবাজ মানুষটিকে চিনে নিতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না। কিছুটা তো আবাক লাগেই: ইংরেজি সাহিত্যের ডাকসাইটে অধ্যাপক ছিলেন স্বপন, এক সময় জাতীয় গ্রন্থাগার ও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের দায়িত্ব এক সঙ্গে সামলেছেন। কিন্তু নিজের ছেলেবেলা, পরিবারের ও পাড়ার মানুষ, কারও সঙ্গেই সম্পর্কচ্যুত হননি কোনও দিন। বইটি কিছুটা যেন আজকের নাগরিক বাঙালি-জীবন নিয়ে— কমলকুমারের ভাষায়— উচ্চকোটির হাস্যকৌতুক।
বইটিতে আমরা যাকে একেবারে মধুর ফিচলেমি ভাবব, এমন উদাহরণের অভাব নেই। বহু জায়গায় পড়তে পড়তে নিজের মনেই হেসে উঠেছি। পাড়ার বড়লোক দেবযানী বৌদি ‘ব্ল্যাক লেবেল হুইস্কি ছাড়া কেনেন না’, তাই “পড়শিরা আড়ালে বলেন, ‘স্কচ ও দেবযানী’” (পৃ ২০২) (আমার সন্দেহ হয় এই পড়শিটি স্বপন নিজেই কি না, কিন্তু আজ তো আর তা যাচাই করার উপায় নেই)। ‘দেবযানী বৌদির’ খণ্ড-কাহিনি মাঝখানে প্রক্ষিপ্ত হলেও এই রচনাটি কিন্তু বাঙালির ‘শাকান্ন’ খাওয়ার ট্র্যাডিশন নিয়ে, এবং সেখানে ‘কৃষ্ণদাস কথিত মহাপ্রভুর স্বপ্নে পাওয়া কৃষ্ণের’ খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে স্বপন মহাভারতের কৃষ্ণের একটি ভারী সুন্দর তুলনা টেনেছেন। অথবা ধরুন ‘বারোয়ারি কথা’ রচনাটিকে। বাঙালির ‘চাঁদা’র ট্র্যাডিশন স্বপনের আলোচ্য বিষয়, তাতে বাঙালির নানা অনুষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানে চাঁদা, প্রণামী, ডোনেশন ইত্যাদির ভূমিকার প্রসঙ্গ ন্যায্যতই এসে গেছে।
আবার ফুট-কাটা হাসিও আছে। এক কালে নরেন্দ্রপুরে পড়াতেন স্বপন। সেখানে অনেক কিছুই ডোনেশনের পয়সায় চলত। তাই নিয়ে ফুট কাটত ছাত্ররাই। “হস্টেলে অসুখ সহজে না সারলে তারা বলত, ‘ডোনেশনের ডাক্তার-বদ্যি স্যর’।” এখানেই শেষ নয়, স্বপন ম্যালেরিয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন হলে, তারা স্বপনকে আশ্বস্ত করত এই বলে যে, “ঘাবড়াবেন না, স্যর। ম্যালেরিয়া হবার চান্স নেই। ফিমেল অ্যানোফিলিস আশ্রমে ঢুকতেই পারবে না।” (পৃ ১৫৫)! আচ্ছা বলুন তো, এ একেবারে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেন্স অব হিউমার নয়?
এই রকম হাস্যকৌতুকের ছটা ছড়িয়ে আছে বইটি জুড়ে, পাঠকের সেটি একটি বড় লাভ। সেই সঙ্গে মুগ্ধ হয়ে দেখতে হয় স্বপন কী অনায়াসে এই সব ফিচেল গল্প বুনে দেন তাঁর পাণ্ডিত্যপূর্ণ অথচ সহজগম্য আলোচনার জমিনে। ‘বহু বর্ণ ও অসবর্ণ’ রচনাটির কথা একটু বলি। এখানে স্বপন (বাংলা) ভাষা নিয়ে ‘তালিবানি গোঁয়ার্তুমি’র বিরোধিতা করেছেন: “রান্না আর ভাষা টেকে তখনই, যখন তার বিস্তারের আর বহুগামিতার পথ খোলা থাকে।... কলকাতার অনেকে চান বাংলা ভাষা ক্ষমতার ভাষা হয়ে উঠুক। কিন্তু সেটা... গায়ের জোরে... হয় না।” (পৃ ১০১)
এই আলোচনা করতে গিয়ে দৈনন্দিন অনেক উদাহরণের সঙ্গে স্বপন তুলেছেন ইংরেজির ‘ম্যাকারনিক ভার্স’ ও গদ্যের ইতিহাস। কয়েকটি বাক্য, কিন্তু তাতেই ভাষার ইতিহাসে স্বপনের আগ্রহের বিস্তার ও তাঁর বিচরণ সম্বন্ধে একটা ধারণা হয়: “ইংরেজিতে ‘ম্যাকারনিক’ শব্দটির মানে পাঁচমিশেলি, শব্দটি এসেছে ইতালির হেঁশেল থেকে।... মধ্যযুগের ইউরোপে লাতিন আর আধুনিক ভাষার খিচুড়ি-পদ্যে জন্ম নিলেও, ফারসি-আরবিতেও এর দিব্যি চল ছিল, যেমন পাই সাদি বা হাফেজের লেখায়। রুমি তো ফারসি-আরবির সঙ্গে তুর্কি আর গ্রিকও মেশাতেন।” (পৃ ৯৫)। মনে করিয়ে দিচ্ছেন, “মধ্যযুগের ইওরোপে ও পরে রেনেসেন্স পর্বে... মেয়েরা শিখতেন ইতালীয় ছাঁদের লিপি, যার আদলে ছাপার কালে ‘ইটালিকস’ হরফ ঢালাই হয়।” (পৃ ৯৬)। এই ধরনের অনায়াস মন্তব্যে মনে পড়ে যায়, স্বপন ছিলেন ভারতে বইয়ের ইতিহাস রচনার জগতে এক নামী ও গুণী পথিকৃৎ।
সবচেয়ে আশ্চর্য লাগে স্বপনের কৌতূহলের বহর দেখে। ভাষাতত্ত্ব, গদ্য, কবিতা, ভাষার ইতিহাস, রস ও অলঙ্কারের বিচার তো আছেই, সেই সঙ্গে আছে শাড়ি, পিঁড়ি, আলপনা, গান, ও বাঙালির খাওয়াদাওয়া। আর আছে কলাবিদ্যা। সবেতেই ডিটেলের কারুকার্য। একই রকম বিস্ময় নিয়ে খেয়াল করি, বইখানি গোছাতে গিয়ে কী ভাবে সাজিয়েছেন স্বপন। খবরের কাগজের লেখা। এক সঙ্গে ছাপা হওয়ার দায়িত্ব তাদের ছিল না। কিন্তু তাদের একত্রিত করে প্রকাশ করতে গিয়ে স্বপন শুধু তাদের দু’টি মলাটবদ্ধ করে ছেড়ে দেননি। কী সূত্রে তাদের গ্রন্থিত করা যায়, তাই নিয়ে ভেবেছিলেন। ভেবে তাদের পাঁচ ভাগে ভাগ করেছেন: প্রাণ, চক্ষু, শ্রোত্র, মন, অন্ন। প্রতিটি ভাগের মাঝখানে আছে দিশি ও বিদেশি প্রাসঙ্গিক রঙিন ছবি। ভাগের সূত্রটিও উল্লেখ করেছেন, তৈত্তিরীয় উপনিষদের, ভৃগু বল্লী অধ্যায়ের প্রথম অনুবাক। ঔপনিষদিক চিন্তায় এগুলি ছিল ব্রহ্মোপলব্ধির প্রবেশপথ বা দ্বার। এখন বঙ্গসংস্কৃতিজ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রেও এই পাঁচটি পথই সর্বোপযুক্ত কি না, সেই তর্কে না গিয়েও আমরা বলতে পারি যে, স্বপনের এই গ্রন্থনার সূত্রটিও অভিনবত্বের দাবি রাখে এবং সমসাময়িকের সঙ্গে গত সময়ের অদৃশ্য বন্ধনগ্রন্থি আবিষ্কারে তাঁর মনের যে আগ্রহ অনবরত কাজ করে চলে, তার সাক্ষ্যও বহন করে।
বইটি ইংরেজিতে যাকে বলে একটি ‘ভার্চুয়োসো পারফরম্যান্স’। আবার স্বপনের বক্তব্য আমাদের নিজেদের দেখতে সাহায্যও করে। বইটির উপস্থাপনা সুন্দর। ভিতরকার মলাটেও পুরনো চাল, হুতোমের মতো উনিশ শতকের মজাদার বইয়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে। এই পুরনো চালও ভাতে বাড়বে, তা নিয়ে আমার তিলমাত্র সংশয় নেই।
এমন একটি বইতে ছাপার ভুল না থাকলেই স্বপনের যে মন সব বিষয়ের পুঙ্খ ও অনুপুঙ্খ নিয়ে ভাবত, তার প্রতি সম্মান দেখানো হত বেশি। কিন্তু যে কারণেই হোক, পৃ ৩৭, ৭২, ৮৮, ৮৯, ৯১-তে ও অন্যত্র বেশ কিছু মুদ্রণপ্রমাদ চোখে পড়ে। আশা করি প্রকাশক পরবর্তী সংস্করণে শুধরে নেবেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy